ইদানিং লক্ষকরছি ,মৌবনি ,আমার মেয়ে ক্লাশ নাইনে পড়ে খুব অন্যমনস্ক থাকছে।স্কুল থেকে ফিরে বই ব্যাগ যেখানে সেখানে রাখছে, স্কুলে যাবার আগে চুলের ক্লিপ পাওয়া যাচ্ছেনা তো ওড়নার পিন গায়েব। কি ব্যাপার কে জানে বাবা।
আজ মৌ সব হোমটাস্ক ও করেনি , অঙ্কের স্যার কমপ্লেন করলেন । এত কেয়ারলেস হলে ওকে হয়তো উনি আর বাড়িতে আলাদা কেয়ার নিয়ে পড়াবেন ই না, জানি আমি ঠিক। ভালো লাগেনা মা হয়ে এত যত্ন করে সন্তান কে মানুষ করতে গিয়েও কি আমার ত্রুটি হচ্ছে যে মৌ এত পাল্টে যাচ্ছে।
মা.. আজ আমার পড়া শেষ হতে দেরী হবে , তুমি আর জেগে থেকোনা।
তাই কি হয় মৌ? তুই পড় আমি এখানেই আছি।
যাওনা মা প্লিজ।
ব্যাপার কি বলতো? আমাকে সরাবার এত চেষ্টা করছিস কেন?
আরে.. তুমি এত ভুল বোঝ কেন?
আমি থাকলে তোর কি সমস্যা বুঝিনা।
তাছাড়া তোর বাবাও লক্ষ্য করছেন সারা রাত আলো জ্বলে তোর ঘরে।
তো কি হবে মা? আমি ঘুমিয়ে যাই আলো নেভাতে মনে থাকেনা।
কোন অজুহাত দিওনা মৌ।আজকাল তোমার পড়াশোনা তে ও মন থাকছেনা। আমার ঠিক ভালো মনে হচ্ছে না। তুমি যেন কিছু ভাবছো।
কি যে বলো না মা, এরকম কিছুই না।
মৌ রাগ করে উঠে গেল ।
জানিনা আজকালকার বাচ্ছারা কেমন। কি করে এদের সামলাবো।
অদ্ভূত ব্যাপার বিগত দুটো রাত লক্ষ্য করেছি মৌ আলো না নিভিয়ে ঘুমিয়েছে। আজ রাতে যা দেখলাম আমি হতবাক হয়ে গেছি। আস্তে আস্তে ওর ঘরের দিকে গেলাম, তখন প্রায় ১২ টা। সবাই ঘুমের দেশে , রাস্তার কুকুর গুলি মাঝে মাঝে অকারণ ডেকে উঠছিল। চুপটি করে আমি ঘরের দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনলাম মৌ কথা বলছে। দরজা ঠেলবো ভাবলাম কিন্তু সাহস হোল না। যদি আওয়াজ পেয়ে সতর্ক হয়ে যায়।
ফিস ফিস করে কি সব যেন বলছে। কোনো পারসোনাল ফোন তো আমি দিইনি মৌকে। কি যে কথা বলছে ঠিক বুঝতে পারছিনা। নিজেকে কষ্ট করে হলেও সামলে নিলাম। মেয়েটা তো আমার, ও কেন আমাকে লুকাবে । ওর কোনও মানসিক সমস্যা হয়নি! অজানা আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠল।নাঃ আজ একবার ডাক্তার জ্যেঠুর সাথে পরামর্শ করে দেখি তারপর মৌকে বলব।
ডাক্তার জ্যেঠু ভয় পেতে মানা করলেন। ওর সাথে বন্ধুর মত ব্যাবহার করে মনের ভিতর ঢুকতে হবে। না যদি পারি তাহলে কিছু কাউন্সেলিঙ করতে হতে পারে। আমিও চুপচাপ আছি, আজ রাতে দেখবো।
এখন ভোর পাঁচটা ছাব্বিশ। মৌ আমার কোলে মাথা দিয়ে পরম সুখে ঘুমাচ্ছে। সারারাত জেগে আমার চোখ জ্বালা করছে। মৌ আমার জীবনে এক অসাধারন কাজ করেছে যা আমি ভাবতেও পারিনি ।
গতরাতে মৌ এর ঘরে আড়িপেতে যথারীতি সেই ফিসফাস পেলাম। থাকতে না পেরে আমি দরজা সরিয়ে আস্তে করে ভিতরে ঢুকতেই মৌ চিত্কার করে উঠলো..কি করছো মা কেন এলে এখানে তুমি? ও যে চলে গেল। তোমার কি দরকার ছিল এঘরে আসার?
কে চলে গেল মৌ? কে চলে গেল? কি বলছিস তুই? পাগল হয়ে গেছিস নাকি.. আবোল তাবোল কি বকছিস?
ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
মা .. আমার আর একজন বোন ছিল না? তুমি বলেছিলে আমরা যমজ বোন হয়েছিলাম।আমি মৗ আর সে ছিল সৌ।…কি হোল মা..বলো আমাকে..দু চোখে টল্ টলে জল নিয়ে তাকিয়ে আছে ।
হ্যাঁ তো, তুই মৌবনি আর সে সৌমিলি। তোদর একসাথে পেয়েছিলাম । খুব আনন্দে ছিলাম রে কিন্তু ইশ্বরের হয়তো পছন্দ হয়নি আমার খুশি । সৌ চলে গেল মাত্র ছয়মাস বয়সে।
না মা , ও কোথাও যায়নি তোমাকে ছেড়ে।
কি বলছিস কি তুই মৌ? ছয়মাস বয়সে ওকে আমাদের চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেতে হয়। হৃৎপিন্ডে ফুটো ছিল তাই ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হয়েছিল। তবুও তাকে বাঁচানো যায়নি।
মা.. ওই দেখো তুমি জানলার দিকে তাকিয়ে ..দেখো একটা ছোট মেয়ে বসে আছে আর অপলকে তোমাকে দেখছে।
কি সব বলছিস মৌ? আমাার বুকটা কনকন করে উঠ্লো। কিছুতো দেখতে পাচ্ছিনা।
ভালো করে দেখো মা, ও যে আমার কাছে আসে। কত কথা বলে , তোমার কথা জানতে চায়।
আমি অনাগত ভয়ে শিউরে উঠি.. চিত্কার করে উঠি..কে তুমি .. কেন আমার মৌ কে বিরক্ত কর? আমি একজন কে হারিয়েছি বটে কিন্তু আর একজনের কিছু হতে দেবোনা। দূর হয়ে যাও। আমি দেখি কত বড় সাহস তোমার।
ঘরটা হঠাৎ আলোময় হয়ে উঠ্লো। মিষ্টি গলায় একটা শিশু কলকল করে বল্লে.. ভয় পেওনা মা, আমি তোমার সৌ।
আমি যখন হসপিটালে অন্তিম শয্যায় তখন তুমি বলেছিলে আমায়.. যাসনে যাসনে সোনা আমায় ছেড়ে। তোমাকে সবাই নিয়ে চলে গেল কিন্তু আমি যেতে পারিনি। মৌ আর তুমি কেমন আছো দূর থেকে দেখে যাই। তুমি আমাকে হাসি মুখে বিদায় দিও মা তবে আমি মুক্তি পাবো । আমি মৌয়ের কোন ক্ষতি করিনি মা আর হতেও দেবোনা।
আলো টা মিলিয়ে গেল। মৌ যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল।
মনে মনে বল্লাম… আমার সোনা তোর জন্য সারাজীবন আমার বুকের ক্ষত থেকে যাবে তবু আমি চাইবো তোর মুক্তি হোক আর তুই নতুন করে কারো সন্তান রূপে আয়। ..
রাত ভোর হয়ে গেল। আজ একবার দক্ষিণেশ্বর যেতে হবে।