বালতির মধ্যে এক বালতি কাপড় ভিজিয়ে রেখে রুমে এসে দেখি আমার পাগলটা কি যেন হাদিসের বই পড়তেছে। আমি তার কাছে গিয়ে বলতে লাগলাম,- ‘এই ওঠো না প্লিজ, আজকে কাপড়গুলো তুমি ধৌত করো। প্লিজ প্লিজ!’
– ‘ঢং বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি কাপড় ধুয়ে রোদে দেও। ‘ ‘আমার হাতে ব্যাথা করতেছে।’ ‘আর কত মিথ্যা ঢং করবা? কথা বাদ দিয়ে যাও জলদি কাপড় ধুয়ে নাও। জুমুয়ায় যেতে হবে তো!’ ‘অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ…”ভ্যাঁ, মায়া কান্না বন্ধ করো! যত্তসব অদিখ্যেতা!’ ‘হ বুঝেছি।’ ‘কি বুঝেছো?’ ‘তুমি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না। যতই দিন যাচ্ছে ততই ভালোবাসাগুলোতে মরিচা ধরে যাচ্ছে। ‘পাগলী কোত্থাকার! আমি তোমাকে ভালোবাসি না, কে বলেছে?’ ‘হ আমি বুঝি।’
‘কি বুঝো? তুমি কচু বুঝো!’ ‘হ কচুই বুজি। আগে তো আমাকে প্রায়শই বাসার কাজে হেল্প করতে, কিন্তু এখন!’ ‘হাহাহা, এটা দ্বারাই ভালোবাসার প্রমাণ করতে চাচ্ছো?’ ‘তো নয় তো কি? যে ভালোবাসার মানুষের কষ্ট বুঝে না, সে কি করে তাকে ভালোবাসতে পারে?’ ‘আসলেই তুমি একটা পাগলী। আস্ত একটা পাগলী! খালি সব সময় এক লাইন বেশি বুঝে।’ ‘হ আমি পাগলী! তুমি ভালো মানুষ! তাহলে পাগলীকে নিয়ে সংসার করো কেন? যত্তসব! যাও তোমার সাথে আর কোনো কথা নাই।’ ‘এই প্লিজ শুনো না?’আমি কোনো কথা না বলে লুকিং গ্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবং অভিমান করে চুপ থাকলাম। সে চেয়ার থেকে আস্তে করে উঠে এসে আমার ঘারে হাত রেখে বলতে লাগলো,- ‘রাগ করেছেন মহারাণী? প্লিজ রাগ করবেন না। তিন তারিখে অফিস খুলবে। তাই তিন তারিখের আগেই ঢাকায় চলে যাব। তখন কার সাথে রাগ করবেন?’
তার কথা শুনে বুকটা দুমরে-মুচরে উঠলো। কলিজায় যেন একটা কঠিন আঘাত লাগল। এ যেন শূন্যতার আঘাত! তাকে না দেখলে আমার চোখের ঘুমই হারাম হয়ে যায়। এতদিন তো তার সাথে ঢাকাতেই ছিলাম। সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশেই ছিলাম। কিন্তু এবার তো শ্বশুর বাড়িতে থাকতে হবে। খুব কষ্ট লাগছে। বাস্তবতা বড়ই কঠিন। তবুও তা মেনে নিতেই হবে। ইতোমধ্যে আমার চোখে জল এসেই গিয়েছে। আমার একটা কমন সমস্যা হচ্ছে- সামান্য কিছু হলেই কেঁদে দেই। আমি তার হাত দুটো ধরে বললাম,- ‘প্লিজ, এমনভাবে বলে আমাকে কষ্ট দিবেন না। আমি নির্দ্বিধায় কাপড় ধুয়ে রাখতেছি।’ সে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগলো,- ‘পাগলী একটা! চলো কাপড় ধোয়ার কাজে তোমাকে হেল্প করি।’ ‘না, তোমাকে যেতে হবে না। আমি একাই পারব।’ ‘মন খারাপ করব কিন্তু।”আচ্ছা হুজুর সাহেব চলেন।’
‘হ্যোয়াট! কে হুজুর? আমি আবার হুজুর হলাম কবে?’ ‘কারণ, তোমার হুজুর হওয়ার যোগ্যতা আছে।’ ‘পাগলী একটা!”এত পাগলী পাগলী করো কেন? আমি কি দেখতে পাগলীর মতো নাকি?’ ‘না, কিন্তু তোমার পাগলী হওয়ার যোগ্যতা আছে।’ ‘হ্যোয়াট?’ ‘নিউটন’ ‘মানে?’ ‘আরে নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়েছো কচু খাওয়ার জন্য। এটাও বুঝো না যে, তুমি যেহেতু আমাকে হুজুর বলতেছ, সেহেতু আমি তোমাকে পাগলী বলবই। বলতেই থাকব, ইচ্ছে মতো বলবো- তুমি আমার পাগলী।’ ‘আহারে বিজ্ঞানী হুজুর! এত বুদ্ধি মাথায় নিয়ে ঘুমাও কেমনে?’ ‘তুমি পাশে থাকলে এমনিই ঘুম আসে।’
‘হাহাহা ‘হাসতেই থাকো। তোমার প্রত্যেকটা হাসিই আমার কাছে ক্রাশ!”আহারে! আরো কত কি যে শুনব!’ ‘হিহিহি ‘আচ্ছা, তুমি কি জানো? স্বামী-স্ত্রী যখন একে অপরের দিকে নেক দৃষ্টিতে তাকায়, তখন আল্লাহ্ তায়ালা উভয়ের জীবনের সমস্ত সগিরা গুনাহগুলো মাফ করে দেয়।’ ‘সুবহানাল্লাহ্! না, এটা জানা ছিল না তো। তবে আমি এটা জানতাম যে, কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর দিকে দয়া ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায়, তাহলে আল্লাহ্ তায়ালা তার প্রতি দয়া ও রহমত বর্ষণ করে।’ ‘সুবহানাল্লাহ! আল-হামদুলিল্লাহ্।’ ‘সত্যিই তুমি আমার নিকট একজন আদর্শবান স্বামী। কারণ, রাসূল (স.) বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন, যার চরিত্র সুন্দর, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ [রিয়াদুস সালিহিন, ১/১৯৭]
‘এ জন্যই তো তোমাকে পাগলী বলি। আর এই পাগলীটাকে যতবার দেখি, ততবার তার প্রেমে পড়ে যাই।’ ‘বরাবরই পাম মেরে যাচ্ছ কিন্তু! ‘আচ্ছা, চলো আগে কাপড়গুলো ধুয়ে নিই। নইলে নামাজ পড়তে যাবো কিভাবে? চলো চলো অতঃপর দুজনে যৌথভাবে অনেক আনন্দ ও হাসি-তামাশার সহিত কাপড় ধুইলাম। অবশেষে কাপড় ধোয়ার ইস্যু শেষ। জুমার নামাজের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ফ্রি সময়ের আনন্দগুলো এভাবেই চলল। এই দিনটি আমার নিকট স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমৃত্যু পর্যন্ত।
এই যে কথায় কথায় আমাদের রাগ-অভিমান, ঝগড়া ও খুনসুটি! এটা সংসার জীবনে থাকবেই। একটু অভিমান, একটু মিষ্টি হাসি ও অতি নগন্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া- এরই নাম ভালোবাসা। দাম্পত্য জীবনে রাগ-অভিমান বা ঝগড়া হবে না, এটা সম্ভব না। এই পৃথিবীতে এমন কোনো দম্পতি নেই যে তারা ঝগড়া-বিবাদ করেনি। এটা থাকবেই। এটা না থাকলে ভালোবাসার মর্মটা বোঝা যায় না। তবে ঝগড়াটা হতে হবে সহনীয় পর্যায়। সীমাতিক্রম করে নয়।