গাড়িটা যখন থামল শ্মশানের সামনে, সবার আগে নামলাম আমি।আস্তে আস্তে দেহ নামল, ৫-৬ জন আত্মীয়, সব শেষে শ্রেয়া।দেখলাম ওকে, সেই ভোর থেকে কাঁদছে।কাজল আর টিপের অনেকদিন আগে থেকেই আড়িই ছিল।চোখের নীচটা লাল হয়ে গেছে।জল গুলো সব শুকিয়ে গেছে।দেখছিলাম ওকে শুধু,ভেতরে ঢুকল সবার শেষে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে।চাউনিতে মনে হলো এটা চাইনি ও, হয়ত খুব প্রার্থণা করেছিল যে ওর রাগ করে নেওয়া সিদ্ধান্তটা যেন পূর্ন না হয়।কিন্তু নিয়তি…
খণ্ডাবে কে?
দেহটা রেখে একে একে সবাই ওর মাথায় হাত দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে।ওর ভাই করবে কাজটা।মাথার কাছে বসে আছে ও, এক গালে হাত।উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।খুব অসহায় লাগছে আজ।সব শেষ হয়ে গেল, কাল থেকে সকালে উঠলে ওকে আর দেখতে পাব না।চা টা রেখে ঠক করে আওয়াজটা ও শুনতে পাব না।গরম জলের বালতিটা কেউ মুখ বুজে এগিয়ে দেবে না..কেউ একবার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলে আড়াল দিয়ে শেষ যাওয়া টুকু দেখবে না।বাঁ চোখটা কখন ভিজে গেছিল এসব ভাবতে ভাবতে।ঘাড়ের কাছে এক হিমেল স্পর্শে ঘাবড়ে গিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখি বছর ২৫-২৬ হবে একটা ছেলে, পরনে ফরমাল , উঁকি ঝুঁকি মেরে কি দেখার চেষ্টা করছিল।বিরক্ত হয়েই বললাম,
-একটু সরে দাঁড়ান।
না শুনতে পাইনি সে, খুব মনোযোগ দিয়ে মাটিতে শুয়ে রাখা দেহের মুখটি দেখছিল।তারপর মাথা নীচু করে চলে গেল।অবাক হলাম একটু, কারণ জিজ্ঞেস করতে যাব, চিৎকার উঠল,
-মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা??ও মা, ফিরে আসো… ও মা…
কান্নায় মাটিতে শুয়ে পড়ল শ্রেয়া।আজ সকাল ৪টের সময় ওর মা চলে গেলেন।পারল না বুঝলেন আর লড়তে।কিডনি ফেল অনেকদিন, পারলাম না বাঁচাতে।সবটা দিয়েছিলাম জানেন, হয়ত ভগবান চান না।বাইরে চলে এলাম, মিনিট ৪৫ তো লাগবেই।ঘাটের কাছে এসে বসলাম, শ্রেয়া ওর বাড়ীর লোকের সাথেই বসল।হঠাৎ শুনতে পেলাম তাকে,
-এখানে?
দেখলাম সেই ছেলেটা, অবাক হয়েই বললাম,
-হু , দেহ নিল ভেতরে এখন।
লক্ষ্য করলাম, বেশ শান্ত নম্র চেহারা।চোখ দুটো যেন কোটরে ঢুকেছে অনেকদিন।কেমন কেমন একটা পচা পচা গন্ধ যেন, তখন ও পেয়েছিলাম।হাসিটা ভালো বেশ। বলল,
-কে হয় আপনার?
-মা, মানে শাশুড়ী মা।
বলল,
-খুব ভালোবাসতেন, চোখে জল যে থামছেই না।
চোখ মুছতে মুছতেই বললাম,
-না মানে, সবটা শেষ।কাল থেকে আবার একা আমি।
সে বলল,
-বউ আছে যে!
কিছু বললাম না আর।বুঝতে পারল হয়ত, বলল,
-কী হয়েছে বলা যাবে?
ঠান্ডা হাওয়াটা যেন বাড়ছে।না তাকিয়েই শুরু করলাম সেই হাতের ওপর হাত রেখে আমারগল্পটা…
শ্রেয়ার ফটোটা যখন পেলাম হাতে , নতুন চাকরীটা সবে পেয়েছি।মাইনে ৩০০০০,সরকারী ক্লার্কের।একেই সরকারী, তারপর বয়স বেড়ে হালকা সাদা চুল বেড়িয়ে গেছে মাথায় আর গোঁফে।বাবা আর দেরী না করে, দেখেই ফেলল সম্বন্ধটা।যা হয় আর কি!সব ঠিক হওয়ার পর ফটো পেলাম ওর।শুনতে কেমন লাগল না! আজকের ছেলে হয়েও …কি করব! প্রেমটা হল না বুঝলেন! তাই এটাও মা কালীর দিব্যি র মত তাঁর কাঁধেই ফেলে রেখেছিলাম।যাকগে সেই তখনই দেখেছিলাম ওকে।না ,ভালোবাসার মত নয় ও, শুধু কোমর অব্দি লম্বা চুলে আর কপালে টিপ দেওয়া ফটোটা বুকের বাঁ দিকটা নাড়া দিয়েছিল অজান্তেই।রাজী হয়েছিলাম , ওকে কাছ থেকে না দেখেই।না, জেনেই বুনেছিলাম আমার না হওয়া ইচ্ছে গুলো।
বিয়ের দিন যখন ওর হাত ছুঁয়ে আগুনকে সাক্ষী রেখে ছিলাম, হয়ত নতুন কোনো অধ্যায় লেখা হচ্ছিল, হয়ত..
শ্রেয়ার বাবা নেই,মার কাছে মানুষ।হাজার বারণ করেছিল মা, একা থাকবে, ঠিক পারবে।শ্রেয়া মানেনি, নিয়ে এসেছিল আমাদের কাছে।ভালোই কাটছিল বেশ।এক আগন্তুক আস্তে আস্তে জায়গা করছিল আমার শহরে।সমস্যাটা ছিল অনেকদিন আমার, সেই ৫ বছর বয়স থেকে।হঠাৎ হঠাৎ রাগ হত, বাড়ী মাথায় করতাম।যে সামনে থাকত, হয় ধাক্কা নাহলে কিছু ছুঁড়ে মারতাম।ভয়ে সবাই দরজা বন্ধ করে রাখত ওই টুকু সময়।অনেক ওষুধ খেয়েছি।আস্তে আস্তে কমতে রাগল রাগ যত বড় হলাম।দু মাস বয়স ছিল আমাদের বিয়েটার।সেদিন সকালে,
-শ্রেয়া নীল ফাইলটা কোথায়?
রান্নাঘর থেকে বলে,
-খাটের ওপর
তাকিয়ে দেখলাম খাটের ওপর ঠিক, কিন্তু পাশে রাখা কাপটা থেকে সব চা…
জোরে একটা চিৎকার শুনে দৌড়ে এল ও।বললাম,
-একটুও বুদ্ধি নেই তোমার??কাল সারারাত জেগে বানালাম কাজটা।বিছানায় চা রেখে গেছ একবার বলতে নেই??
কাপটা ওঠাতে যাবে, রেগে বললাম,
-করতে হবে না যাও!
ধাক্কাটা আস্তেই ছিল, মনে হয় আমাদের সম্পর্কে গিয়ে লাগল।সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলল , বুঝলাম বড্ড ভুল করে ফেলেছি।
তারপর থেকে অনেক ঝগড়া হয়েছে এই দু বছরের বিয়েটার।থাকতে পারল না আর ও, ডিভোর্স পেপারটা সই করে একদিন বলল,
-সই করে দিও।পারলাম না তোমায় ভালো রাখতে।মাকে কিছু বলো না, বড্ড ভালোবাসে তোমায়,এক ঘরে থাকি ততদিন?
এবারেও কিছু বলিনি আমি, না সই করিনি।ভাবছিলাম এত তাড়াহুড়ো আমায় ভালো রাখার জন্য!!না সেটা হতে দেব না..
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল সে,
-তা আপনাদের সম্পর্কের সেতুটা আর নেই, তাই ভাবছেন কাল থেকে আপনার “সে” চলে যাবে, তাই তো??
মাথা নীচু করে আছি, সে বলল ,
-চা খাবেন?
হ্যাঁ বলার আগেই দেখি একটা ভাঁড় সামনে।বললাম,
-আপনার চা?
বলল,
-ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন।আমার গল্প শুনবেন?
চুমুক দিয়ে বললাম,
-আচ্ছা।
শুরু করল সে কাশতে কাশতে..
কোন্নগরের কাছেই তখন থাকত ও।পড়ত ওই মনীন্দ্র কলেজটায়।আমি তখন জয়পুড়িয়া তে পড়ি।আসতে যেতে দেখতাম ওকে।আমায় দেখত যখন, পিছিয়ে পড়তাম সবার অলক্ষ্যে।লঞ্চে উঠে যখন দেখত একবার বড্ড ভালো লাগত জানেন।একদিন সাহস করে হাত টেনে বললাম,
-সময় হবে দশ মিনিট?
দাঁড়িয়ে পড়ল ও।পাশের চায়ের দোকানে বসলাম দুজনে।শুরু করলাম আমি,
-কী নাম তোমার?
-মৌসুমী, আপনার?
একটু থামিয়ে বললাম,
-আপনি বলল?
সে আমায় থামিয়ে বলল,
-আঃ , তখন এসব দিয়েই শুরু হত।গল্প শুনবে?
চুপ করতেই বলল,
-সুদীপ
“মৌসুমী “ডাক শুনতেই পালিয়ে গেল ও, লুকিয়ে পড়লাম আমি।তারপর থেকে প্রায় দেখা হলে লুকিয়ে লুকিয়ে আলাদা হয়ে যেতাম।এই পাড়ে বসে একসাথে হাতে হাত রেখে ওর আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে বসে থাকতাম শুধু ।ভালো লাগত ওকে, ওর চুলের গন্ধটা, খিমছে ধরা আমার শার্টের হাতাটা।যাওয়ার সময় ওর চোখ ছল ছল, আর টিউশুনির টাকায় ওর জন্য ছোট্ট হলেও গিফ্ট কেনা। চাকরী পেলাম একটা, প্রাইভেট ফার্মে।সেদিন খবরটা নিয়ে গেছিলাম ওর সাথে ওর বাবাকে বলার জন্য।লঞ্চে উঠে হাত বাড়িয়েছিলাম ওর দিকে, বে খেয়ালে পাইনি ওর পা টা লঞ্চের পাটাতন।ঝাঁপ দিলাম সঙ্গে সঙ্গে,কি আশ্চর্য, কেউ পেল না বডি।তারপর থেকে রোজ ঘুরে যাই এই সময় ।এখানে আসা সমস্ত দেহ দেখি, মৌসুমী কিনা।অপেক্ষা করছি যে।কি জানি! এল কিনা ও আমায় দেখতে! কথা দিয়েছিল ও, আমার হয়েই থাকবে।কত বছর দেখিনি, জানিনা কেমন দেখতে হয়েছে!
মনটা আরো ভার হয়ে গেল শুনে।তাকিয়ে বললাম,
-ভালো করে খোঁজেন নি?এভাবে হারিয়ে গেল মৌসুমী আপনার? পারলেন আমার মত হারতে?
হাসতে হাসতে বলল,
-হারালাম তো আমি।কথা রাখতে পারলাম কই?সেদিন যদি পা টা ও ভাবে না পিছলাত!
শিরদাঁড়া দিয়ে যেন ঠান্ডা কিছু বয়ে গেল শুনে।ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তাকে।গায়ে হাত দিতেই মিলিয়ে গেল যেন।
দৌড় মারলাম উঠে শ্রেয়ার কাছে।নাঃ, বড্ড চড় মারল সুদীপ যেন।তেমন হলে আবার বিয়ে করবে শ্রেয়াকে, আর একবার হাতে হাতে ছুঁয়ে ওকে নিজের করে রাখবে।