মানুষ মরলে “ভূত” হয়! আর ভূত মরলে?
ভূত মরলে হয় “টূত”! -আমার বান্ধবী প্রমির কথা!
স্বভাবতই প্রশ্ন থেকে যায়- টূত মরলে কী হয়?
প্রমির “টূত থিওরি ” মতে, টূতেরা মরে গিয়ে আবার মানুষরূপে জন্ম নেয়! কাজেই অবস্থাটা বুঝুন!
আমাদের চারপাশে টূত পরবর্তী কতো মানুষ আছে- কে জানে!!
তবে ভাগিস, “টূত সাইকেল “এর মানুষজনদের আগের কথা মনে থাকেনা। থাকলে যে কী হতো! কতোদিন যে……..এইভাবে মাথাঘুরে কপালে আমার গম্বুজ গজাতো!
আ! কপালের ডানদিকটা আমার ফুলে আছে! কিভাবে হলো? বলছি। তার আগে বলি,শুনে কেউ বলতে পারবেন না- আমি গুলপট্টি দিচ্ছি! লেখালেখি
করি বলে তো আর সবসময় গুলবাজি করতে পারিনা, বিশেষ করে এই “টূপমা (টূত পরবর্তী মানুষ) “-দের ব্যাপারে একদমই না!!
এই গত বৃহস্পতিবারের কথা।
সকাল সাতটায় ক্লাস,অলরেডি ঘড়িতে ছ’টা পঞ্চাশ। কাঁধে ব্যাগ ফেলে ‘পড়ি কি মরি’ করে ছুটছি! বাসা থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা মসজিদ আছে, তার সামনে একটা পুকুর। এই দু’টোর মাঝখানে রাস্তাটা একটা মোড় নিয়েছে। মোড় ঘুরতে যাবো, এমন সময় -“এই যে হবু ডক্টর! ”
পায়ের ব্রেক কষতে কষতে পিছনে ফিরলাম, দেখি তোফায়েল দাদু!
ইনি কোন আত্মীয় সম্পর্কের দাদু না,ডাকাডাকি করতে করতে “দাদু” হয়ে গেছেন!
এক মহল্লাতেই আমরা থাকি। প্রতিদিন ভোরে দাদু তার মিসেসকে নিয়ে মর্নিং ওয়াকে বের হন। আমার প্রতিদিন -ই সকাল সাতটায় ক্লাস থাকে। রিক্সাওয়ালারা তো আবার মহাসুখী মানুষ, এতো ভোরে তাদের দেখা পাওয়া যায়না -বাধ্য হয়ে আমাকে প্রতিভোরে খরগোশ টাইপ দৌড় দৌড়াতে হয় মেইন রোড পর্যন্ত! সেই সুবাদেই এই দম্পতির সাথে পরিচয়, আমাকে দেখলেই দাদু ডাক দেবেন – “এই যে হবু ডক্টর! ”
আমি হাটার গতি কমালাম, দাদু প্রায় ছুটে এসে আমার সাথে তাল মিলিয়ে ফেললেন!
ঃ আজ একা যে দাদু!
ঃ গিন্নী বাড়িতে,ঘর সাজাচ্ছেন।
ঠাট্টা করে বললাম,
ঃ এই বয়সে হঠাত ঘর সাজানো, আবার বিয়ে টিয়ে করছেন নাকি?!
ঃ তা বলতে পারো!
মজা পেয়ে বললাম –
ঃ তা কনেটা কে শুনি!
ঃ কে আবার! আছে তো একজনই-তোমার দিদিভাই!
ঃ বাব্বা! এই বয়সেও এতো রোমাঞ্চ!
দাদু একেবারে ইয়াংদের মতো লজ্জা পেলেন!
ঃ কতোইবা বয়স! আজ আমাদের পঞ্চাশতম বিবাহ বার্ষিকী। আরেকবার তো করাই যায়- কি বলো!
পঞ্চাশতম!! আচমকা থেমে দাদুর হাত ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলাম –
ঃ তাই! কনগ্রাচুলেশন, দাদু,কনগ্রাচুলেশন!!
প্রত্যুত্তর করে দাদু বললেন –
ঃ আজ সন্ধ্যায় কিন্তু তুমি আমাদের গোল্ডেন জুবিলী সেলিব্রেশনে আসছো!
যদিও বাসা চিনিনা,তবু “না” বলতে পারলাম না। কিছু মানুষের সাথে হৃদ্যতা এতো বেশি হয়ে যায় যে,তাদের কথা ফেলা যায়না!
সন্ধ্যাবেলা সেজেগুজে ফুলেরতোড়া হাতে বের হলাম। বাসার এ্যাড্রেস আর ফোন নাম্বার সকালে নিয়ে নিয়েছিলাম। বেশি খুঁজতে হলো না,সহজেই পেয়ে গেলাম বাসা।
আরে বাহ! বাসার বাইরেটাও দেখছি বেশ সাজানো! বোঝাই যাচ্ছে, চুল সাদা হয়ে গেলেও এদের মনের রঙটা এখনো কমেনি!
কলিংবেল চাপলাম, তখনো জানতাম না- এই দরজার ওপাশেই আমার
জন্য অপেক্ষা করছে বিশাল এক থ্রিল!!
অবশ্য “বিশাল ” থ্রিল কিনা সেটা ঠিক করার দায়িত্ব পাঠকের!
যাইহোক, দরজা খোলা হলো, কে খুললো ঠিক দেখতে পেলাম না! লিভিং রুমের শেষ মাথায় তোফায়েল দম্পতি দাঁড়িয়ে, ওয়েস্টার্ন সাজে সজ্জিত! অবাকের ওপর অবাক হলাম -এই বয়সেও তাদের এতো ….!
দরজাতেই স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিলাম। দাদু হাত নেড়ে ডাকলেন, আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দু’জনের মুখে! এগিয়ে যাচ্ছি শুভেচ্ছা জানাতে, রুমের মাঝামাঝি পৌঁছাতেই খেলাম এক ধাক্কা! চোখ দম্পতির দিকে ছিলো, কার সাথে যে সংঘর্ষ হলো! ঘুরে “স্যরি” বলতে গেলাম -ওমা! কেউ নেই আশেপাশে! বুঝতে পারছিনা কি হলো!!
দাদুদের দিকে তাকালাম, ব্যাপারটা তাদের চোখেও পড়েছে। দাদুর হাসিটা কেমন মলিন হয়ে গেলো, চোখে-মুখে একটা শঙ্কিত ভাব! পাগল ভাবছে নাকি আমাকে!
আজগুবি চিন্তা সরিয়ে এগিয়ে গেলাম। ফুলের তোড়া বাড়িয়ে দিতেই দিদিভাই মিষ্টি একটা হাসি দিলেন, খেয়াল করলাম তার দাঁতগুলো বাঁধানো!
আমি এদিক ওদিক তাকালাম-
ঃ দাদু, আর গেস্টরা?
একটু ইতস্তত করলেন তিনি-
ঃ আসলে, হবু ডক্টর, আজকে আমাদের মানুষ গেস্ট বলতে শুধু তুমিই।
“মানুষ ” শব্দটার ওপর বাড়তি জোর দিলেন! অদ্ভুত!
ঃ মানুষ গেস্ট আমি একা….বুঝলাম না,দাদু!
ঃ বুঝবে,তুমি বুঝবে! একুশ শতকের ছেলেমেয়ে তোমরা, সায়েন্সের সাথে প্রকৃতির রহস্যও তোমাদের বুঝতে হবে!
কথার মাথামুণ্ডু কিছু না বুঝে বোকার মতো চেয়ে রইলাম!
দাদু বললেন –
ঃ তুমি পাশের রুমে যাও। আমরা আসছি,বাকি গেস্টদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।
আমি একা মানুষ গেস্ট …. বাকি গেস্ট …… বুঝতে পারছিনা … কিন্তু পাশের রুমের দরজার কাছে যেতেই ভেতর থেকে টুংটাং আওয়াজ, কথাবার্তা শুনতে পেলাম। ঢুকলাম রুমে,উজ্জ্বল আলো নেই,হালকা আলো দিয়ে পার্টি ইফেক্ট আনা হয়েছে! উজ্জ্বল আলো থেকে আসার জন্য চোখে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আবারো গোল বাঁধালাম, কাকে ধাক্কা দিয়ে তার ড্রিংকের গ্লাস ফেলে দিলাম! স্যরি, স্যরি, এক্সট্রেমলি স….বলতে বলতে থেমে গেলাম, আশেপাশে কোন মানুষের অস্তিত্ব চোখে পড়ছে না! হালকা অন্ধকার হলেও মানুষের অস্তিত্ব তো আর উবে যাবেনা!
একদিকে ফ্লোরে ভাঙা গ্লাস ছড়ানো, অন্যদিকে কেমন একটা খটকা লাগছে! পাশের দেয়ালে সুইচবোর্ড দেখতে পেলাম। লাইটের সুইচটা খুঁজতে হাত বাড়াচ্ছি, অমনি দাদু ছুটে এলেন-
ঃ দাঁড়াও, দাঁড়াও! লাইট জ্বালিয়ো না!
ঃ কেন?!
ঃ আমাদের গেস্টরা তীব্র আলো সহ্য করতে পারেনা।
ঃ কি……!
ঃ আসলে….বলছি, শোন, মানুষ মরলে ভূত হয়,তাইনা! আর ভূত মরলে কি হয় বলো তো!
ঃ ভূ …ভূত মরলে ….
এইরকম আলো-আঁধারিতে ভূতের কথা শুনে হঠাত কাঁপুনি এসে গেলো ঠোঁটে!
দাদু নিজেই বলতে শুরু করলেন –
ঃ ভূত মরলে টূত হয়- এটা দু’একজন মাত্র জানে। কিন্তু টূত মরে যে আবার মানুষ হয়-এটা কেউ জানেনা!
দিদিভাই পাশ থেকে বললেন –
ঃ জানবে কী করে,সেসব কথা টূপমা মানে টূত পরবর্তী মানুষদের কারোরই মনে থাকেনা!
দাদু বললেন –
ঃ কিন্তু আমাদের মনে রয়ে গেলো! প্রথমবার মানুষ হিসেবে আমরা ছিলাম আমেরিকার সানফ্রানসিসকো তে, ভূত হয়ে একত্রে বসতি নিয়েছিলাম ভেনেজুয়েলায়। টূত জীবনটা একদম বিরক্তিকর, আমাজানের বনে বনে থাকতে হয় সব টূতদের। তারপর আবার মানুষ হয়ে জন্ম নিলাম এই বাংলাদেশে।
আমি স্পীচলেস! কি শুনছি এসব!
ঃ দাদু একটু থেমে আবার শুরু করলেন-
ঃ তো আজ মেইনলি আমাদের গেস্টরা হলো -পরিচিত ভূত এবং টূতেরা। যেসব টূতেরা মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছে তাদের খোঁজ অবশ্য আর পাইনি। এইজীবনে খুব বেশি ফ্রেন্ড আমাদের ছিলোনা, যারা ছিলো তারাও মরে ভূত হয়ে এসেছে। তাই মানুষ ফ্রেন্ড বলতে তুমি আজ একা।
এতোক্ষণে আমার ডার্ক অ্যাডাপ্টেশান হয়ে গেছে, ধীরেধীরে সয়ে আসা চোখে আলো-আঁধারিতে রুমভর্তি ছায়া ছায়া অবয়ব গুলো চোখে পড়লো!
ও আল্লাহ! আমি এমনিতেই যথেষ্ট ভীতু -অ্যানাটমীর ডেডবডি থেকে একশ হাত দূরে থাকা মানুষ, ফরেনসিক ক্লাসে ক্ষতবিক্ষত লাশের ছবি দেখে চোখ ঢেকে ফেলা মানুষ, সার্জারি ওয়ার্ডে মাথাঘুরে পড়ে যাওয়া মানুষ! এতোক্ষণ শুধু ঠোঁট কাঁপছিলো,এখন পুরো মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে।
যার সাথে একটু আগে ধাক্কা খেলাম, পাশেই ছিলেন। ভূত কিংবা টূত! দাদু তার দিকে ফিরে বললেন –
ঃ এসো পরিচয় করিয়ে দেই- রোজারিও,মিট মাই লিটল হিউম্যান ফ্রেন্ড, ফাগুন।
দেখতে পেলাম ছায়া ছায়া একটা হাত এগিয়ে আসছে….”হ্যালো” শব্দটা কানে আসতে আসতে আমি ধপাস!
তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই,কিভাবে বাসায় এলাম, কি করলাম – কিচ্ছুনা! দরকারও নেই….বাব্বা!