অর্জুন মৌবনীকে চোখে হারায়।ছোটবেলায় মৌ-এর চিবুকের তিলটা দেখে মেজদিদা বলেছিল-
‘মৌ তুই স্বামী সোহাগী হবি।’
তখন মৌ সবে পনেরো কি ষোলো।চন্দ্রকলার মত মৌ এর কাছে তখন আস্তে-আস্তে জীবনের রঙ প্রকাশ পাচ্ছে।প্রেম পাপড়ি মেলছে স্বপ্নে।অস্তরাগের লালিমা যেন ফুটতে শুরু করেছে মৌ-এর গালে।গ্র্যাজুয়েট হওয়ার আগে একদেখাতেই মৌবনীকে পছন্দ করেছিল অর্জুন।মাসীমণির মেয়ে রঞ্জিনীর বিয়েতে দেখা আর দু-চারটে কথা অর্জুনের সঙ্গে।সুপুরুষ লম্বা সুঠাম দেহের অধিকারী অর্জুনকে পছন্দ না হওয়ার মত কোনো কারণও ছিল না।মৌবনীর বাবা নির্মল চক্রবর্ত্তী।ছা-পোষা কেরানী।এমন সুপাত্রকে হাতছাড়া করতে চাননি তিনিও।রঞ্জিনীর বিয়ের পর-পরই তাই অর্জুনের সঙ্গে মৌবনীর বিয়েটা হয়ে গেল।
দুজনের বয়সের ফারাকটা একটু বেশী তাতে আর কি এসে যায়! অর্জুন সাহিত্যের লোক।কথার জাদুগর।কলেজে পড়ানোর সূত্রে অল্পবয়সী মেয়েরা কি পছন্দ করে বা করেনা তা তার নখদর্পণে।মৌবনী খুব সাধারণ ভাবে বড় হয়েছে।পড়াশোনাতেও খুব সাধারণ মান ছিল তার।মেয়েদের জীবনে বিয়েটাই সব।বিয়ের পর স্বামী- শ্বশুরবাড়ী-বাড়ী-গাড়ী-গয়নাগাটির মধ্যেই জীবন আবর্তিত হয়,স্বামী বলে একজন মানুষের হুকুম তামিল করতে হয়,স্বামীর ভাল মন্দই নারী জীবনের সারাৎসার-এই মন্ত্রই শিখে এসেছে সে মা-মাসীর কাছে এতদিন।স্বামী রাগ করলে বিরক্ত হলে তার মনতুষ্টি করাটাই স্ত্রীদের কাজ,স্বামীর জন্য স্বার্থত্যাগ এমনকি আত্মত্যাগেই স্ত্রী জীবনের মোক্ষ।এসব কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে এতটুকু কুন্ঠা নেই মৌ এর।
ফর্সা পানপাতার মত মুখ, বড় বড় টানা দুটি চোখ,টিকলো বাঁশীর মত নাক আর একরাশ কালো চুলে মৌবনী যেন সোনার হরিণী।ভালবেসে ইচ্ছে করে রামচন্দ্রের কাছে ধরা দিয়েছে।ছা-পোষা বাবার হিসেবের সংসার থেকে অর্জুনের অগাধ বিলাস সমুদ্রে এসে পড়েছে মৌবনী।অর্জুন মৌবনীর রূপে দিশেহারা!মৌবনী কি শাড়ী পরবে,কি গয়না পরবে,কি খাবে সবদিকে অর্জুনের তীক্ষ্ণ নজর।যতক্ষণ অর্জুন মৌবনীর সামনে থাকে ততক্ষণ-
‘মৌ তুমি খেয়েছো?’
‘মৌ তোমার ঠাণ্ডা লেগেছে?’
‘তুমি বেশী বেলা করে স্নান করবে না।’
‘রান্নাঘরে আগুন তাপে আমার জন্য খাবার বানাবে না।’
‘বিকেলে আমার সাথে বেরোতে হবে দুপুরে রেস্ট নিও।’
এরকম নানা খুঁটি-নাটি বিষয়ে অর্জুন অসম্ভব মনঃসংযোগ করে থাকে।
প্রথম-প্রথম মৌবনী অর্জুনের প্রেমে আপ্লুত ছিল।বিয়ের চার -পাঁচ বছর নিমেষে কোথা দিয়ে কেটে গেছে বুঝতেই পারেনি মৌ।রূপা মৌ এর স্কুলের বন্ধু।বিয়েতে আসতে পারেনি বলে বিয়ের কিছুদিন পর একবার ফোন করেছিল মৌকে।ভেবেছিল মৌ এর সাথে একদিন দেখা করতে আসবে।কিন্তু অর্জুনের গল্প আর প্রশংসা শুনতে-শুনতে রূপা বেচারী নিজের কথা আর কিছু বলার সুযোগ পায়নি।রূপা শুধু মৌবনীকে জিজ্ঞাসা করেছিল-
‘কিরে মৌ শ্বশুরবাড়ী কেমন লাগছে?আর নতুন বরকে?’
ব্যস্ আর কিছু বলার সুযোগ পায়নি রূপা।
‘বাবা আর বলিস না অর্জুন তো আমাকে পাগল করে দেবে!একটা কাজও করতে দেয় না জানিস!’
‘ রূপা বলে ‘ওমা তাই’।
আবার বলতে শুরু করে মৌবনী-
‘ওর বাবা-মা তো থাকে দেশের বাড়ীতে।এখানে আমি আর ও।ওর তো মর্নিং কলেজ।কলেজ থেকে সেই যে বাড়ী ফিরল;তারপর হি- হি- হি-হি আর কি বলব!আমি না খেলে খাবে না সে।ঘুমোবার সময় আমার গায়ের চাদরটা পর্যন্ত তার নিজের হাতে দিয়ে দেওয়া চাই।’
রূপার মুখটা কেমন অন্ধকার হয়ে যায়। চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়ে একটা।ওর ও তো পার্থের সাথে—-যাইহোক, হঠাৎ খেয়াল হতে শোনে মৌবনী বলে যাচ্ছে তখনও-
‘দোকানে গিয়ে একটা শাড়ী পছন্দ করলে পাঁচটা কিনে দেয়!কিছু বলার আগেই সব এসে যায় জানিস রূপু।দুজন মানুষের চারটে কাজের লোক।আমি কাজ না করে-করে কি মুটিয়েছি এসে দেখে যা।গাড়ী ছাড়া চলতে দেয় না আমায়!এবার হাঁটতে ভুলে যাব রে রূপু।’
সুখী অহঙ্কারী হাসি তরঙ্গায়িত হয়েছিল ফোনের এক প্রান্তে,অপর প্রান্তে চাপা ঈর্ষার আগুনে পুড়তে-পুড়তে রূপা বলেছিল-
‘মৌ এখন রাখছি পরে ফোন করব।ভাল থাকিস।’
পার্থকে রূপা ভালবাসে। কিন্তু মাস্টার্স করে বেকার বসে আছে পার্থ।কোথাও চাকরি জোটাতে পারছে না।চাকরির যা অবস্থা।রূপার বাবা-মা-ও তাই কিছুতেই বিয়েতে রাজী হচ্ছে না।রূপার তো সামান্য টিউশানিই ভরসা।এরকম অবস্থায় এমন প্রাচুর্যের নির্লজ্জ গল্প শুনতে কার আর ভাল লাগে?মৌবনী যেন সুখকে হাতের মুঠোয় ভরে ফেলেছে।
মৌবনী কোনোকালেই পড়াশোনায় ভাল ছিল না।প্রায় ফেল করতে-করতে প্রতি বার ক্লাসে উঠত।পড়াশোনায় মন ছিলনা বলে মৌবনীর মা সবসময়ই বলত ভাল পাত্র পেলেই মৌবনীর বিয়ে দিয়ে দেবে।উচ্চমাধ্যমিকও পাশ করতে পারেনি মৌবনী এক চান্স এ।দ্বিতীয় বার কোনোরকমে পাশ করে।প্রথম বর্ষে কলেজে ভর্ত্তি হওয়ার কিছুদিন পরই মৌবনীর বিয়ে হয়ে গেল।রূপার তখন দ্বিতীয় বর্ষ।পাড়ার বন্ধু হওয়ার সুবাদে রূপার সঙ্গে মৌবনীর বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়নি।উচ্চমাধ্যমিক পড়তে-পড়তেই মৌ এর মা মারা গেল লিভারের ক্যানসারে।সামান্য রোজগারী নির্মলবাবু স্ত্রী এর চিকিৎসা সেভাবে করাতে পারলেন না।যেটুকু চেষ্টা চরিত্র করলেন তাতেই পথে বসার জোগাড়।কিন্তু মৌবনীর অসামান্য রূপ পুরুষদের নজর এড়াতো না।দিনকালও ভাল না;কখন কি বিপদ ঘটে সে ভয়ে সদা চিন্তিত নির্মলবাবু তড়িঘড়ি অর্জুনের সাথে বিনা পণে বিনা দাবী-দাওয়ায় মৌবনীর বিয়েটা দিয়ে দিলেন।মেয়ে সুখী হয়েছে।অর্জুন হীরের টুকরো ছেলে।এতেই তার শান্তি।
শান্তি বড়ই চঞ্চল।বেশীদিন অচলা থাকে না।ঐ যে কথায় আছে না’সুখ দুখ দুটি ভাই /সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি /দুখ যায় তার ঠাঁই।’একটানা সুখভোগ জীবনে অনীহা আনে।’ময়রার অরুচি জন্মে মিষ্টান্নে।’মৌবনীরও এত সুখ বুঝি সহ্য হল না।এর থেকে একটু অভাব একটু অপ্রাপ্তি হয়তো ভাল ছিল।বিয়ের বছর পাঁচেক পর থেকে মৌবনীর মনে হল এই জীবনে সে কেমন হাঁফিয়ে উঠেছে।সারাক্ষণ অর্জুনের ভালবাসার ঘেরাটোপে তার দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে।একঘেঁয়ে দাম্পত্য প্রেম আর মিলনের অভ্যাস জীবনকে কেমন নিস্তরঙ্গ করে তুলেছে।
কিসের এত ভালবাসা?কিসের এত যত্ন?কোথাও কোনো ফাঁক নেই-বকা নেই-শাসন নেই-জোর নেই-দাবী নেই!এত বিনয়-এত নমনীয়তা কিসের জন্য?অর্জুনের মধ্যে সেই পুরুষসিংহটাকে কোথাও যেন খুঁজে পায় না মৌবনী।এত সংযম,ভদ্রতা,নম্রতা কেমন অসহ্য হয়ে উঠতে থাকে।মাঝে-মাঝে নিজেকে কেমন পাগল-পাগল লাগে।এক-একদিন রাতে জোর করে অর্জুনের বাহুবন্ধন ছাড়িয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে মৌবনী।তাতেও অর্জুনের কোনো রাগ নেই বিরক্তি নেই-জোর করে মিলনে বাধ্য করার চেষ্টা নেই!এর থেকে একটু খারাপ তো হতে পারতো অর্জুন।মৌবনীর সাথে একটু প্রাণ খুলে ঝগড়া করত।রাগ করে কথা বন্ধ করত।তাহলে হয়তো জীবনে কিছুটা নতুনত্ব আসতো।তার সব কথাতেই এই হ্যাঁ মেলানোটা আর নেওয়া যাচ্ছে না।কোনো কিছুতেই যেন অর্জুনের আপত্তি নেই! দিন-দিন মৌবনীর সংসারের প্রতি-অর্জুনের প্রতি এই অনীহা বাড়তে থাকে।তার খেতে ভাল লাগে না-শুতে ভাল লাগে না।শপিং মলে কেনাকাটাও অসহ্য লাগে।কি আর চাই তার?জামাকাপড় রাখার জায়গা নেই- ব্যাগে কত টাকা আছে নিজেও জানেনা।আজকাল অর্জুনের সাথে ভাল করে কথাও বলে না মৌবনী।সারাক্ষণ ওর রূপ-গুণের প্রশংসা শুনতে-শুনতে ক্লান্ত সে।অর্জুন সবই বোঝে কিন্তু চুপ করে থাকে।মৌবনীর বয়স কম।তার চেয়ে অনেকটা ছোট।মা মরা মেয়ে।জগতকে কতটা দেখেছে ও।ওকে যে বড্ড ভালবাসে অর্জুন।কিছু বলতে পারেনা তাই।মৌবনীকে সময় দিতে হবে।আস্তে-আস্তে ও সব বুঝবে, কোনটা ভাল-কোনটা মন্দ।উচিত-অনুচিত।অর্জুনের দৃঢ় বিশ্বাস।
কিন্তু মৌবনীর যে স্বস্তি নেই।আচ্ছা মৌবনী কি পাগল হয়ে যাচ্ছে?একটা মেয়ে জীবনে যা চায় তাই-ই তো পেয়েছে সে।সুপুরুষ-সচ্চরিত্র স্বামী-অর্থ-বাড়ী-গাড়ী-অগাধ স্বাধীনতা-তবে?-তবে কেন এই অতৃপ্তির জ্বালা মৌবনীর?উফ্ আর ভাবতে পারে না-মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা-মুখটা কেমন বিস্বাদ-মৌবনী হয়তো পাগলই হয়ে যাবে এবার!আসলে মৌবনী কি চায়-কি ভালবাসে সেটা হয়তো সে নিজেও জানে না।সে না ভালবাসে বই পড়তে না ভালবাসে ভাল আলোচনা শুনতে।তাই অর্জুনের সেমিনার-আলোচনা সভা এসব অনুষ্ঠানে গেলেও তার ঘুম পায়।বেফাঁস কিছু কথা বলে বসে মানী-গুণী লোকের সামনে।তাই আজকাল এসব জায়গায় যেতেও চায় না মৌ।মৌবনীর মন ভাল রাখার চেষ্টায় অর্জুন কোনো ত্রুটি রাখে না।তবু এক হতাশা আর বিষাদ দিন-দিন ওকে গ্রাস করে।জীবন হয়ে ওঠে রঙহীন ফ্যাকাসে।
অর্জুন-মৌবনীর স্বপ্নের বাড়ী ‘অনুভব’।সেখানে দিনের ডিউটি করে দারোয়ান রামজীবন।তার ছোট ছোট দুটো মেয়ে,বৌ পিয়ারী আর তার মা থাকে অর্জুনদের বাড়ীর একতলায় সিঁড়ির পাশে একটা ছোট ঘরে।প্রায় দিন রাতেই রামজীবন মদ খেয়ে চূড়ান্ত মাতলামি করে।পিয়ারীর সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি-গালাগালি-মারধোর-কান্নাকাটি।কিন্তু আবার সকাল হতেই রামজীবন একেবারে অন্য মানুষ।কে বলবে আগের দিন রাতেই সে অমন আদিম হিংস্র হয়ে উঠেছিল।নিজের হাতে অতি যত্নে রামজীবনের জন্য তাওয়ায় গরম-গরম রুটি বানায় পিয়ারী।কড়ায় পাঁচমিশালী সব্জি ফুটতে থাকে।তারপর কাঁসিতে করে রুটি-তরকারি খায় রামজীবন।পিয়ারী পাশে বসে থাকে সতী সাবিত্রীর মত।পরম তৃপ্তিতে ঢেকুর তুলতে তুলতে হাত ধোয় রামজীবন।পিয়ারী হাত ধোবার জল ঢেলে দেয়।লোটায় করে খাবার ঠান্ডা পানি দেয়।পিয়ারীর আঁচলে মুখ মোছে রামজীবন।হাতে খৈনি ডলতে-ডলতে হাসি-তামাশায়,রঙ্গ-রসিকতায় মেতে ওঠে রামজীবন।পিয়ারী রামজীবনের গায়ে হাসিতে ঢলে পড়ে।যেন প্রেম সমুদ্র উথলে উঠেছে জীবন আঙিনায়।পরম যত্নে পিয়ারীর পিঠের কালশিটেতে মলম লাগিয়ে দেয় রামজীবন।পিয়ারী চরম সোহাগে চোখ বন্ধ করে বলে উহ্!কে বলবে গতকাল রাতেই
‘ম্যায় মর গ্যায়ী’
বলে পিয়ারী অমন বুকফাটা আর্তনাদ করছিল।আজকাল প্রায়দিন ওপরের বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পিয়ারী আর রামজীবনের দাম্পত্য লীলাখেলা দেখতে থাকে মৌবনী।
বেলা বাড়ার সাথে-সাথে দুটো কচি বাচ্ছাকে নাইয়ে-খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে শাশুমার পায়ে তেল মালিশ করে পিয়ারী।তারপর ওপরে মৌবনীর কাছে আসে পিয়ারী ,ফাইফরমাস খাটে।নিজের মনেই আধা বাংলা আধা হিন্দীতে কত কিছু বকবক করে পিয়ারী।
‘ভাবী পাঞ্চ বরষ বিত গ্যায়া।এবার তুমার লেড়কা হোবে।অর্জুন ভাইয়া কত খুশ হোবে তুম ভি।’
মৌবনী অবাক দৃষ্টিতে দেখে পিয়ারীকে।ভাবতে থাকে,জীবনে পিয়ারী তো কিচ্ছুই পায়নি।কষ্ট করে একটা ঘুপচি ঘরে স্বামী শাশুড়ীর সাথে থাকা,অতি সাধারণ খাওয়া-দাওয়া,উদয় অস্ত হাড়ভাঙা খাটুনি,স্বামীর অত্যাচার-এত সব কিছুর মাঝেও পিয়ারীর মুখে হাসিটি লেগে আছে।যেন কত তৃপ্তি আর সুখের স্বাদ পেয়েছে।আর মৌবনীর এত কিছু থেকেও হৃদয় শূন্যতায় ভরা-অতৃপ্তির বাষ্পে জীবন অতিষ্ট।
‘পিয়ারী তোকে রামজীবন এত মারে তাও তুই কিকরে ওকে ভালবাসিস?ওর জন্য খাবার বানাস?ঘরের এতো কাজ করিস!তোর ভাল লাগে ঐ মাতাল স্বামীর ঘর করতে?রাগ হয়না?’
পিয়ারী লম্বা জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বলে-
‘এমন কথা বলবি না ভাবী।মেরা পতি মেরা দে ব্ তা আছে।উকে তো পেয়ার করতেই লাগবে।পাপ লাগবে না হামাকে?হামাকে উ বহুত প্যায়ার করে রে।’
মৌবনী স্তম্ভিত হয়ে যায়।এই অশিক্ষিত গেয়ো মেয়েটা তাকে কি শোনালো আজ!
সারাদুপুর, সারাবিকেল পিয়ারীর কথাগুলোই ভাবতে থাকে মৌবনী।কত গভীর বিশ্বাস ওর !ওর স্বামী ওকে অনেক ভালবাসে।স্বামী যেমনই হোক তাকে ভালবাসতেই হবে।যে স্বামী এত অত্যাচার করে ,খাটায় দাসী বাঁদীর মত,তার প্রতি এত ভালবাসা?সেখানে অর্জুন তো তাকে রাজরাণী করে রেখেছে তার একটা ইশারাতে আকাশের চাঁদও নামিয়ে আনবে।আর সে কিনা এমন দেবতুল্য স্বামীর প্রতি বিরক্ত? তার ভালবাসাকে পায়ে ঠেলছে খেয়ালের বশে?এইসব ভাবনাতে তোলপাড় করতে থাকে মৌবনীর মাথাটা।
শান্তি আর সুখ পাব মনে করলেই পাওয়া যায় না।তাকে পেতে জানতে হয়।ধরে রাখতে হয় যত্ন করে।অন্যমনস্ক হয়ে কিসব ভাবতে -ভাবতে ছাদের সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায় মৌবনী।পিয়ারী-মালতী-রামজীবন অনেকটা পরে জানতে পারে।ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে মৌবনী প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে।ওরা সবাই মিলে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে আসে মৌকে।খাটে শুইয়ে দেয়।অর্জুন একটা কাজে গেছিল সেখান থেকে মাঝপথে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসে।মালতী পিয়ারী হাউমাউ করে কান্না জুড়েছে ভাবীর হুঁশ নেই।—
মৌবনীর অপারেশন হয়েছে পায়ে ।প্লেট বসেছে।মাথায় স্টিচ হয়েছে অনেকগুলো।খুব জোর এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে অর্জুনের মৌ।মৌবনীর জ্ঞান ফিরেছে।জ্ঞান আসতেই মৌবনী অস্ফুটে বলল-
”অর্জুন কোথায়?”
অর্জুন বলল-
”এই তো আমি।তোমার পাশেই আছি।”
অর্জুন মৌবনীর হাতটা শক্ত করে ধরেছে।মৌবনী কোনো কথা বলতে পারেনি।শুধু চোখ থেকে অনেক নোনতা ধারাস্রোত হাসপাতালের ধবধবে সাদা বালিশের ওপর পড়ে জলের দাগ এঁকে দিয়েছে।
।।সমাপ্ত।।