নীরবে

নীরবে

শিমুকে আর জ্বালাতন করা হবেনা। ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মেয়েটাকে অনেক জ্বালিয়েছি। অনেকদিন হয়ে গেল দেখতেও পারিনি মেয়েটাকে। ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত, যে আর কখনো বিরক্ত করবনা তাকে।

হাসপাতালের নার্সের কথা মনে পড়ছে খুব। শেষের দিনগুলো তার কাঁধে হাতের ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে হেটেছি। মেয়েটা আমাকে মনে মনে পছন্দ করত। আমি খুব করে বুঝতে পারতাম। আচ্ছা নার্স কখনো রোগীর প্রেমে পড়ে? আমি ওর দুর্বলতাকে পশ্রয় দেইনি। কারণ আমি তো শিমুকে ভালোবাসি। যদিও শিমু বিরক্ত মনে করে সবসময় এড়িয়ে যেত।
শিমুর ছোট ভাই সাথের ছেলেদের সাথে আমাকে দেখতে এল। তাকে শালা বলে কত ক্ষেপাইতাম। বলতাম ঐ নাঈম, আমাকে দুলা ভাই বলে ডাকবি। মুখ বাঁকিয়ে নাঈম বলত, “ঈশ, শখ কত?”

নাঈমকে কাছে ডাকলাম। বাধ্য ছেলের মত পাশে এসে বসল। তার চুলে বিলি কেটে দিয়ে জানতে চাইলাম, “শিমু কেমন আছে?”

নাঈম হেসে দিল। উঠতে উঠতে বলল, “সুস্থ হবার চিন্তা করেন। সবসময় মাথায় দুষ্টুমি ঘুরে বলেই এই অবস্থা আপনার।”

কিন্তু আমি তো জানি ভালোবাসার মানুষের খোঁজ নেয়া দুষ্টুমি না মনের টান।
হাসপাতাল ছেড়ে আসার সময় নার্সের করুণ চোখের চাহনী আমাকে আঘাত করে। কখনো মনে হয় অপরাধ করেছি। কখনো মনে হয়, না আমি কোনো অপরাধ করিনি।

নার্সের নাম ছিল সাদিয়া। হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটিকে সাদা কাপড়ে বেশ মানাত।
মা আমার বিছানার পাশে বসা থাকলে সাদিয়া জানতে চাইত, “আন্টি শ্রাবণ ঔষধ খেয়েছে? আজ কতভাগ সুস্থ হয়েছে?”

মেয়েটি দৈনিক আমাকে বলবে আমি কত পার্সেন্ট সুস্থ হয়েছি। প্রতি রাতে চার ঘন্টা ডিউটি থাকে সাদিয়ার এই কেবিনে। দিনের বেলাতে চার রাতে চার ঘন্টা। তিনজন নার্স পালাক্রমে থাকেন। একমাত্র সাদিয়া আমাদের সাথে একদম পরিবারের মত মিশে গেছে। দুদিন নিজে রান্না করে নিয়ে এসেছে আমার আর মায়ের জন্য। সাথের রোগীরা হিংসে করে বলত, যে সেবা পাচ্ছেন, সুস্থ না হয়ে যাবেন কোথায়?

রাতের শেষ চার ঘন্টা আমি জেগে থাকার চেষ্টা করতাম। সাদিয়া পুরো কেবিনে টহল দিয়ে এসে আমার কাছে এসে গল্প করত। তার গল্পে না বলা ভালোবাসা ছিল অনেক। আমাকে আকৃষ্ট করতে চাইলেও আমি এড়িয়ে যেতাম। আমি বুঝতাম সাদিয়া আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু তাকে এই বিষয়ে কোনো কিছু বলার সুযোগ দিতাম না। কারণ আমিতো শিমুকে ভালোবাসি।

শিমুকে কয়েকদিন বলেছিলাম, “আমার মোটরসাইকেলের পিছনে বসো, একটা চক্কর মেরে আসি।”
মুখ ঘুরিয়ে শিমু বলত, “আমার এত ল্যাংড়া হওয়ার ইচ্ছে নেই। আপনি একাই চক্কর দিয়ে আসেন।”
ল্যাংড়া হতে হবে কেন জানতে চাওয়ার জবাবে বলেছিল, “আপনি কেমন ড্রাইভার তা জানা আছে। মেয়ে মানুষ পিছনে থাকলে হুশ থাকবেনা। এক্সিডেন্ট করে বসে থাকবেন।”

সত্যি সত্যিই এক্সিডেন্ট করেছি তবে শিমু উঠেনি মোটরসাইকেলে। বিকেল বেলা চিপা গলি দিয়ে ঢুকার সময় দুই তিনটি হাঁস এসে পড়ল মোটরসাইকেলের সামনে। হঠাৎ তাল হারিয়ে মোড় কাটাতে গিয়ে প্রথমে দেয়ালে ধাক্কা তারপর মোটরসাইকেল কাত হয়ে আমার পায়ের উপর। তারপর আর কিছু মনে নেই। নরসিংদী সদর

হাসপাতালেরর ডাক্তার আমাকে ঢাকা নিয়ে যেতে বলল। এতদিন ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ছিলাম। পায়ের ভিতর রড ঢুকিয়ে হাড় জোড়া দিয়েছে। কেটে ফেলতে হয়নি সেটাই আমার পরম ভাগ্য।

হাসপাতালে সাদিয়া একদিন গল্প করতে করতে করতে জানতে চেয়েছিল, “বিয়ে করেননি বুঝলাম, কারো প্রেমেও পড়েননি?”

সেদিন আমি মুখ ফোটে শিমুর কথা বলতে পারিনি। কারণ শিমু তো আমাকে ভালোবাসেনা। আর এই না বলাটা ভুল ছিল। তাই হয়তো সাদিয়া মনে মনে চাইত। সাদিয়া সুন্দর অনেক। তার যেন অবশ্যই ভালো একটি বর হয়।

আমি কখনোই শান্ত ছেলে ছিলামনা। চঞ্চলতা না থাকলে নিজেকে মৃত মনে হয়। আজ নিজেকে তেমন মৃত মনে হচ্ছে। শিমু এবার ইন্টারে পড়ে। দেখতে তেমন আহামরি সুন্দর নয়। তবে জগতের সবার কাছে তার ভালোবাসার মানুষটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর। সে যদি চোখে কাজল না দিয়ে চোখের পাতায় দেয় তবুও মনে হয় সুন্দর লাগবে। মোটকথা গোটা মানুষটাই ভালোলাগার মানুষ, ভালোবাসার মানুষ। শিমুকে একদিন একটি চিঠি দিয়েছিলাম

শালাবাবুকে দিয়ে। শিমু চিঠি হাতে আমার সামনে এল। আমার সামনে চিঠিটি ছিঁড়ে কুটি কুটি করে হাতের তালুতে নিয়ে ফুঁ মেরে ফেলে দিল। যাবার সময় বলে গেল, “মোটর সাইকেল নিয়ে সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়ালেই বুঝি মানুষ আপনার জন্য দিওয়ানা হয়ে যাবে? আমি কোনোদিন আপনাকে ভালোবাসবনা।”

আমি কিঞ্চিৎ অপমানবোধ নিয়ে সেদিন বের হয়েই এক্সিডেন্ট। শিমুর সাথে আমার আর দেখা হয়নি।

জানালার শিক ধরে দাড়িয়ে আছি। নিজেকে জেলখানার কয়েদি মনে হচ্ছে। আমার স্বাভাবিক ভাবে হাটতে আরো মাস দুয়েক লাগবে। প্রতিদিন একটু একটু হেটে আবার বিশ্রাম নিতে হয়।

বাচ্চারা উঠোনে মারবেল খেলছে। আমাকে দেখলে তারা মারবেল খেলা তো দূরের কথা, দৌড়ের উপর থাকে ভয়ে। অথচ তারা নির্ভয়ে মারবেল খেলছে। তারাও জানে আমি এই পা নিয়ে ওদের দৌড়ে ধরতে পারবনা।

মাথায় ওড়না দিয়ে গুটি গুটি পায়ে শিমু আর লিজা আসছে আমাদের বাড়ি। আমি জানালা দিয়ে দেখে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নিশ্চয় আমাকে দেখতে এসেছে।

দরজা খোলা, হালকা চাপানো। লিজা বাইরে থেকে বলছে, “শ্রাবণ ভাই আছেন?”
আমি তাদের ভিতরে আসতে বললাম। লিজা বলল, “ভাই আপনাকে দেখতে এসেছি।”

শিমু অন্যদিকে তাকিয়ে আড়চোখে আমাকে দেখছে। আমি লিজাকে বললাম, “অসুস্থ মানুষ দেখতে আসলে খালি হাতে কেউ আসে?”

লিজা শিমুকে দেখিয়ে বলল, “এত বড় জলজ্যান্ত মানুষ হাতে করে নিয়ে আসার পরও বলছেন খালি হাতে এসেছি?”
আমি শিমুর দিকে তাকালাম। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। আড়চোখে তাকিয়ে আমার চোখে চোখ পড়তেই নামিয়ে নিচ্ছে। আমি লিজাকে বললাম, “আচ্ছা এনেছিস যেহেতু আমার জন্য রেখে যা।”

এবার শিমু আর চুপ থাকলনা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠ্যাং ভেঙ্গেও আপনার পাজিগিরী শেষ হয়নি? আর এই মোটর সাইকেল চালাবেন না। যদি বেশি কিছু হয়ে যেত?”

আমি লিজাকে বললাম, “দেখছিস লিজা আমার জন্য কত মায়া? মুখেই শুধু বলে আমাকে ভালোবাসতে পারবেনা। অথচ মনটাই আমার কাছে রেখে দিয়েছে।”

শিমু আরেকটু জোড়গলায় বলল, “আমার বয়েই গেছে আপনাকে ভালোবাসতে। এই লিজা চল, রোগী দেখা শেষ।”
লিজা বলল, “তুই না বললি শ্রাবণ ভাইকে কতদিন দেখিসনা, তোর নাকি মন খারাপ লাগছিল। তো এখন আসছিস, দেখে যা ভালো করে।”

শিমু অন্যদিকে ঘুরে দাড়িয়েছে লিজার কথা শুনে। ধরা পড়ে এদিকে আর তাকায়না। লিজা আবারো বলল, “আমি বাইরে যাই, কথা শেষ করে আয়।”

শিমু সাথে সাথে বলল, “না কথা শেষ। তুই তো বললিই উনাকে না দেখে আমার মন খারাপ লাগছিল। সব কথা কি ভেঙ্গে বলতে হয় নাকি? পাজিগিরী কমিয়ে করলেই হবে।”

লিজা আর শিমু ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি শিমুকে ডাকতে একটু থেকে পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, “এখন আর ডাকতে হবেনা। তাড়াতাড়ি সুস্থ হোন। আর যদি মোটরসাইকেল চালান, এবার আমাকে পিছনে উঠাবেন। এক্সিডেন্ট করলে যেন দুঁজনই করি।”

মুচকি হেসে চলে যাচ্ছে। এতদিন একদম বুঝতে পারিনি। মেয়েরা সহজে ভালোবাসার কথা স্বীকার করেনা। এখন স্বীকার করল, কত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। যাই হোক, ভালো তো বাসে। এবার তাড়াতাড়ি পা ভালো হলেই ছুটব ভালোবাসায়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত