শান্ত সবুজ এক ছোট্ট গ্রাম। ফসল ভরা মাঠ, গোয়াল ভরা গরু আর উঠোন ভরা হাঁস-মুরগি নিয়ে সচ্ছল গ্রামের প্রতিটি ঘর। এ গ্রামেরই এক গৃহস্থের বাড়িতে একবার এক মুরগি তা দিয়ে ফোটালো অনেকগুলো ছানা। কিন্তু একি! মুরগিছানাদের সঙ্গে ডিম ফুটে বেরোনো ঐ কিম্ভূতকিমাকার ছানাটি কে? দেখতে হাঁসের মতো। কিন্তু কী কুশ্রী আর কদাকার! কী করে এলো এখানে? কেনই বা সে অন্যদের চেয়ে আলাদা?
গৃহস্থ বাড়ির এক চিলতে উঠোনে জীবন শুরু হলো তার। কেউ তাকে ভালবাসে না। সুযোগ পেলেই ছোট ছেলে-মেয়েরা খোঁচায়, মুরগিছানারা তাড়া করে, কাক ভয় দেখায়। খাবার তার আবর্জনা আর গৃহস্থের ফেলে দেয়া ঝুটাকাঁটা, তা-ও বাকিরা খেয়ে যাবার পর যা পাওয়া যায়। একমাত্র আপন তার মা-মা মুরগি। সব ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও এই মায়ের কাছেই খুঁজে পায় একটু আশ্রয়।
এভাবেই চলছিলো জীবন। আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে সে। মাঝে মাঝে সে অনুভব করতো জোরে দৌড়াতে গিয়ে সে যেন খানিকটা ভেসেও যেতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি সে।
একদিনের কথা। কোনো কারণে সব মুরগিছানারা মিলে তাড়া করলো তাকে। প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে এক হ্রদের ধারে গিয়ে থমকে গেল। এখন সে কী করবে? আর একটু এগুলেই যে হ্রদে পড়ে যাবে। কিন্তু সে তো কখনো পানিতে নামে নি। পেছানোরও কোনো উপায় নেই। এদিকে তার মা-মুরগিও পেছন পেছন ছুটে এসেছে।
হঠাৎ পানিতে চোখ গেল তার। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলো সে। এরপর দৃষ্টি গেল ঐ পাড়ের এক ঝাঁক হাঁসের দিকে। কী আশ্চর্য! হুবহু তার মতোই দেখতে। অবাক বিস্ময়ে সে একবার তাকাচ্ছে ঐ হাঁসদের দিকে, একবার তার মায়ের দিকে, আর একবার হ্রদের পানিতে তার প্রতিবিম্বের দিকে। সে তো তার মায়ের মতো নয়, নয় এতদিন যাদের সাথে কাটিয়েছে সেই মুরগিছানাদের মতো। বরং মেরুদেশ থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা ঐ পরিযায়ী পাখিদের একজন সে। শীতার্ত পরিবেশ থেকে বাঁচতে নাতিশীতোষ্ণমন্ডলে উড়ে আসা এক মা-পাখির ডিম থেকে ঘটনাচক্রে যার জন্ম হয়েছিলো ঐ গৃহস্থের বাড়িতে।
কী অবলীলায় হাঁসগুলো উড়ছে, পানিতে নামছে! সে-ও তো তা-ই পারে! বুঝলো সে-এই তাড়া খাওয়া, আবর্জনা খুঁটে খাওয়ার জীবন তার নয়, নীল আকাশের উঁচুতে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয়ার দৈহিক সামর্থ্য নিয়ে জন্মেছে সে।
প্রথমবারের মতো সে নিজেকে জানলো। বুঝলো, গৃহস্থের উঠোনের ক্ষুদ্র গন্ডি ছেড়ে তাকে উড়াল দিতে হবে অনন্ত আকাশে। দুফোঁটা চোখের জল ফেলে মা-মুরগিও তাকে বিদায় জানালো। কারণ ক্ষুদ্র মমতার বন্ধন দিয়ে সে তার ছানার সম্ভাবনাকে গন্ডিবদ্ধ করতে চায় নি। নভোনীলিমায় ডানা মেলে দিলো হাঁসছানা আত্মপরিচয় সৃষ্টির নতুন অভিযাত্রায়।