খুনে বউ-এর ঘাট

খুনে বউ-এর ঘাট

নাটা গোপাল ডিমের ব্যবসা করত । পোলট্রি তার ছিল না, তবু সে ডিমের ব্যবসা করত । এ অঞ্চলে মানুষের করার কাজ তখন কম। চাষের জমি বিস্তর অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে । জল সেচের সেরকম সুবিধা ছিল না । নাটা গোপাল লোকের পোলট্রি থেকে মাল নিয়ে যেত শহরে । ছোটবেলা থেকে এলাকার লোকে নাটা গোপালকে দেখে হাসত- বয়েস বাড়লেও তার বাড় বৃদ্ধি হয় নি । একে সে ছিল মাঝারি আকারের লোকেদেরও বগলের তলায়, উপরন্তু হাত দুটি লম্বায় খুবই খাট । তবে তাকে খারাপ ছেলে বলা যেত না । পাড়া পড়শীরা বিপদে আপদে ডাক দিলে গোপালকে পাওয়া যেত। পরণে থাকত একটি চেক লুঙ্গী, তার ওপর সাদা শার্ট । মাথার চুল প্রচুর তেল দিয়ে পেতে বসান, মাঝখানে সিঁথি করে আঁচড়ান । দেখতে নাটা ভাল ছিল না– মাজা গায়ের রং, উঁচু গালের হাড় । এ ঘটনা অনেক দিন আগেকার – তখন মোবাইল ছিল না, ঘড়ি ছাড়া কাজের মানুষের চলত না। নাটার বাঁ হাতে থাকত একটা সস্তা হাতঘড়ি। ব্যবসার কাজে সময় দেখাটা তার কাছে ছিল অত্যন্ত দরকারী ।

গ্রামের পাশ দিয়ে একটি নদী বয়ে যেত, নদীর বহু আগে থেকে বিস্তীর্ণ চড়া ধুধু করত । ধারে ধারে যে গাছ-গাছালির ভীড় থেকে থাকে তাও এখানে নদীর থেকে বেশ দূরে নিরাপদে একটা পাঁচিল তৈরি করে অবজ্ঞার চোখে শীর্ণ নদীটাকে দেখত। সেই নিঃসঙ্গ নদীর ধারে প্রতিবন্ধী এই ছেলেটি এক সঙ্গতিহীন কুঁড়ে বেঁধে নিয়েছিল। এমন মানুষ প্রতিবেশীর করুণার পাত্র হয় । গ্রামাঞ্চলে মানুষে মানুষে সম্পর্ক জোরালো, তাই মাঝে মধ্যে কেউ কেউ নাটার খোঁজ খবর নিত, খেয়াল রাখত নাটার কারবার কেমন চলছে- বেশ কিছুদিন না দেখতে পেলে আক্ষেপের সুরে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত – ‘আমাদের নাটু-কে দেখছি না কয় দিন, কেউ কিছু জান নাকি হে ?’

এই গ্রামেরই অন্য একটি প্রান্তে তখন আরেকটা ঘটনা ঘটছিল । বাষট্টি দিন সদর হাসপাতালে ভর্তি থেকে লক্ষণ ঘোষ মরছিল উদরী রোগে । লক্ষণের জমিজমা, জমান টাকা, এমনকি দুটো গাইগরু অবধি দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে যাবার পরেও যখন ডাক্তার জবাব দিল তখন বাধ্য হয়ে সনকা কাকার আশ্রয়ে ফিরে এল । সনকাকে দেখতে ভাল ছিল । উজ্জ্বল গায়ের রং, সুশ্রী মুখের গঠন, দেহে ছিল যৌবনের প্রাচুর্য । তার বিয়ের বয়েস হয়েছে, কিন্তু মা মরেছে ছোটবেলায়, বাবার সাধ্য ছিল না । লক্ষণ মরে যাবার আগে ভাইকে ডেকে একবার বলার চেষ্টা করেছিল, যাহোক করে তার এই একমাত্র মেয়েটার একটা বিয়ের বন্দোবস্ত করে দিতে– মরছে এমন লোককে না বলাটা বড় পাপীর কাজ, তাই লক্ষণের ভাই রাজী হয়ে দাদাকে শান্তিতে মরার সুযোগ করে দিয়েছিল যদিও সেসব ছিল কথার কথা । এই নতুন উল্কাটি কাকীমার সংসারে কোন রাস্তা খুঁজে না পেয়ে বারবার ধাক্কা খেতে শুরু করল । ছোটবেলা থেকে কিছুটা হলেও আদরের মুখ সনকা দেখেছিল, তাই এখন ভীষণ অনাদরে মাঝেমাঝেই তার খাওয়া বন্ধ হত, চাপা কান্নার স্রোত চোখ ভেজাত, আবার কখনও কখনও সেই নদী তার স্বপ্নে উচ্ছল হয়ে উঠে তাকে অতলে হাতছানি দিত । যে নদীর পাড়ে কখনও সনকাকে দেখা যেত না, সেখানে প্রায়ই সে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল, বালিতে পা ছড়িয়ে বসে জুলফির চুল চাঁপার কলির মত আঙ্গুলে পাকিয়ে নিচু গলায় বাতাসের সাথে কিসব বলতে লাগল যা নদী ছাড়া আর কেউ জানতো না। এভাবে নিঃসঙ্গ নদীর সঙ্গীর সংখ্যা এক থেকে বেড়ে হল দুই ।

এরকম করে আষাঢ় মাস এল, মেঠো পথের জল নদীতে নামল – নদী একটু একটু করে ভরে উঠল, কিন্তু তখনও বুক সমান জল । আকাশের কাল মেঘের ছায়া জলকে প্রবঞ্চক পোষাক পরিয়ে গভীর করে দেখায়–সনকা বারকতক সাহস করে ডুব দিলেও অতল তো দূরের কথা কিছুটা বালি খামচা খামচি করে ফের ঘাটে এসে ভিড়ল। এ যাত্রা চারপাশে কেউ ছিল না বলে আত্মহত্যার এমন মহড়া পাঁচকান হল না । কিন্তু একজন তা দেখতে পেল । নদীর ধারে ফাঁকা জায়গার অভাব ছিল না– নাটা গোপাল মানুষদের গোত্রে পড়ত না, তার মধ্যে যে চোখ বা কান থাকতে পারে সেটা সনকা মনে রাখে নি, না হলে নাটার বাড়ীর কাছে এই নাটক সে কখনই করত না । নাটা কিন্তু সহজ ভাবেই তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল । সনকা সুন্দরী, তাকে নাটা চেনে না এমন নয় – লক্ষণ ঘোষ একসময়ে সমাজে ফেলনা ছিল না, নাটা গোপাল তাকে মান্য করত । সে সনকাকে সমীহ করার সুযোগও কোন দিন পায় নি, আজ দৈবাৎ নাগাল না পাওয়া চাঁদ জাতীয় কিছু মাটিতে খসে পড়ছে দেখে হতভম্ব হয়ে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে বসল গোপাল । সনকা মেয়ে, দারিদ্র তাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে – পুরুষের লোভ লালসা সে ভালোই বোঝে । নাটা গোপালের তাকানোয় সে ভাব ছিল না । কিছুক্ষণ আগেই জলে ডোবার কষ্টকর অভিজ্ঞতা তার বাঁচবার ইচ্ছে উসকে দিয়ে গেছে- নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই, এই গল্প গ্রামের সবাই জানে । গোপালের দিকে তাকিয়ে সনকার দীঘল নয়নে শুধু শ্রাবণ ঘনিয়ে এল, অজস্র তীরের মতো বৃষ্টির ধারা সনকা আর গোপালকে জগৎ থেকে কিছুক্ষণের জন্য আলাদা করে রাখল ।

সনকার কাকা লোক সুবিধার ছিল না । কাকী ছিল আরও সরেস । ভাশুরঝির জন্য পাত্র ঠিক না করে জোগাড় করল খদ্দের । গোপাল খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারল, পাহাড়ী কোন জায়গায় বিয়ের ঠিক হয়েছে সনকার । পাত্রের অবস্থা ভালো । কিন্তু গোপালের এসব বিশ্বাস হল না । একদিন সনকা নদীর ধারে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল । গোপালের বিশ্বাস দৃঢ় হল- এই কাকাটা বোধ হয় সনকাকে চালান করে দিতে চাইছে । এমন পরিস্থিতিতে সনকাকে নিয়ে পালানো ছাড়া গোপালের উপায় থাকে না কিন্তু পালাব বললেই পালানো যায় না – পৃথিবী এতটা সহজ নয়, নাটা গোপালের কথায় পৃথিবী কি আর চলে! অগত্যা দিন যেতে লাগল । ভরা শ্রাবণে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে বুঝি রক্ষা নেই, এর মাঝেই সনকার সাজানো বিয়ের দিন চলে এলো । একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই গোপাল খবর পেল শহরে বরযাত্রী এসে গেছে । রাতে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে – গ্রামে সবাই কে নেমতন্ন করাটা রেওয়াজ । গোপালের ও নেমতন্ন আছে । কিন্তু সন্ধ্যার পর সনকাকে নদীর ধারে আসতে দেখে গোপাল চমকে উঠল । আহত বাঘিনীর মতো গর্জাচ্ছিল সনকা- ভরা নদীর যৌবনে সেকি আক্রোশ । জলের শব্দ, ঝড়ের শব্দ, বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে গর্জন করছিল সনকা । গোপাল ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল । বিয়ের কাপড়ের ভেতরে চোরা গুপ্তি দেখে গোপালের মাথা ঘুরে গেল । নিজের শারীরিক বন্ধন, অসহায় গোপালকে এবারেও ভয় দেখাল শুধু । ওদের পালান আর হল না- নিঃসঙ্গ নদীটি প্রবল ঝঞ্জায় একাকী বয়ে গেল তার প্রেম আর যৌবনের পসরা নিয়ে।

এরপরের ঘটনা খুব মর্মান্তিক। সনকা সেদিন বাসর ঘরেই খুন করে বসে তার স্বামীকে । দাগী আসামী ছিল সে । বহুবার আগে বিয়েও করেছিল সেটাও কোর্টে প্রমাণ হয়। নাটা গোপাল সাক্ষী দিয়েছিল । বিচারে ছমাসের জেল হয়ে ছিল সনকার । গোপাল যথাসাধ্য দিয়ে সনকার পক্ষে উকিল দিয়েছিল । ছেড়ে যায় নি কখনই ।

তবে সেবারের বৃষ্টিতে গোপালের খুব সুবিধে হয়েছিল । মরা নদীটা আবার ফেঁপে উঠতে থাকে। নদী আর নিঃসঙ্গ নয়- এখন গোপাল ঘাট দিয়েছে। পারাপারের চারটে ডিঙ্গি সারাদিন চলে । কথায় কথায় ঘাটটির নাম হয়ে যায় খুনে বউ-এর ঘাট । ওদের একটা সুস্হ স্বাভাবিক ছেলে আছে, তার নাম লালন । সেই-ই এখন ঘাট দেখাশুনো করে । আমি অবশ্য বেশ কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম, সেই দুহাজার পনেরোয় ।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত