বিনিতার একটা বদভ্যাস আছে।আবার কোন রোগও হতে পারে।এ ব্যাপারে তেমন খোঁজখবর করিনি তাই সঠিক কী সেটা এই মুহূর্তে আমার পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না।
যেহেতু অভ্যাসটি বিনিতার ভাল না। সেইজন্য সেটাকে বদ বলেই চিন্হিত করা হল।সেটি হল চিনতে না পারা।প্রত্যক্ষ দেখলে পারেন।কিন্তু ফটোতে পারেন না।
তার সেই অদ্ভূত স্বভাবের কথা ভেবেই আজকে এই গল্পটি লিখতে বসা।
বিনিতার পাশের বাড়িতেই থাকেন চন্দ্রানী।পাশাপাশা বাড়িতে রোজ তিনবেলা মুখ দেখাদেখি হয়।আসা,যাওয়া তো আছেই।আর সেটা দু,একমাস না, প্রায় বছর পনেরো ধরে।
চন্দ্রনীর বড় মেয়ে অরূপার খুব ইচ্ছে হল,এবারে মা,বাবার বিবাহবার্ষিকীটা জমিয়ে পালন করবে।পাড়া,প্রতিবেশি ছাড়াও সেই অনুষ্ঠানে কিছু নিকট আত্বীয়,স্বজন এবং বন্ধু, বান্ধবদের নেমন্ত্রণ করা হল।সেই অনুষ্ঠানে বিনিতাও যোগ দিলেন।তার আগে বিনিতার চেহারা সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা দেওয়া যাক।বর্তমানে উনার বয়স পঞ্চাশ বছর।উচ্চতায় খাটো।চোখে কোন সমস্যা নেই।তবু তিনি ছেলেদেরকে প্রতিবছর চোখে ঝাপসা দেখছি বলে,ডাক্তারের কাছে চেক করিয়ে আনেন।ডাক্তার বিভিন্নরকম পরীক্ষা করে প্রতিবারই ছেলেদেরকে বলেন,আপনার মায়ের চোখে কোনরকম সমস্যা নেই।ছানি,টানি কিচ্ছু পড়েনি।তবু তিনি একটা সামান্য পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করেন।সেটা সবসময় না।যখন সূচের ফাঁকে সুতো পরানোর প্রয়োজন পড়ে তখন আর লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ার সময়।না পরলেও হয়।পরলে একটু বড় দেখায়,এই যা।বরং কানের সমস্যাটা তার বড় রকম।একটা কানে একেবারে শুনতে পান না। অন্যকানে মেশিন নিয়ে শোনেন।অল্পখানি জোরে বললে তিনি সবকথাই শুনতে পান।
ফিরে আসি এবার চন্দ্রানীর কথায়।বেশ ঘটা করেই তাদের বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটা পালন করা হল।বিনিতার থেকে চন্দ্রানী বয়েসে বছর দুয়েক ছোটই হবেন।পাশাপাশি থাকতে,থাকতে তাদের মধ্যে সম্পর্কটা দিদি,বোনের মত হয়ে গেছে।তুই,টুই দিয়েই কথা বলেন।
চন্দ্রানীকে বেনারসি সাজে হয়তো ভালই মানিয়েছিল।বয়স হলেই যে সকলের রূপ,লাবন্য ঝরে পড়ে,তা কিন্তু নয়।তবে তা চন্দ্রানীর ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য, বলা মুশকিল।একটা সত্যি কথা যে,উনি হাসলে তার সামনে বলিউডের হট হিরোইনও ফিকে পড়ে যান।তার প্রধান কারণ হল,ঠোঁটের সাথে তার গালে ভাঁজ পড়ার একটা অদ্ভূত সামঞ্জস্য।ঠিক সেই মুহূর্তে পি.সি সরককারের অদ্ভূত যাদুর মত তার বয়স কিন্তু লহমায় বিশ বছর কমে যায়।
তাই দেখে অনেকের মনে হিংসাও হয়।বিনিতার মনে অবশ্য সেসকল কিছু হয় না।স্বভাবে তিনি বড় শান্ত।তবে এক নাগাড়ে কেউ তার সাথে জোরে কথা বললে খুব রেগে যান।মেশিনটা বন্ধ করে দিলেও কিছু কাজে আসে না।তিনি মানুষের চোখ,মুখ আর হাতের নড়াচড়া দেখেই বুঝে যান,কেউ তার সাথে জোরে কথা বলছে কিনা?
বলাটাই স্বাভাবিক।তিনি স্বভাবে শান্ত হলে কী হবে, সাথে আর একটিও গুণ আছে।সেটি হল তিনি বড়ই ভুলো।এই গুণটাকে ভাল না মন্দ বলা যায়।আমি সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।যদি বলেন কেন?তাহলে একটু খুলেই বলি।তাতে রচনার শব্দসংখ্যা একটু বাড়বে।আপনারা যারা পড়ছেন,তাদেরও একটু বেশি ধৈর্য রাখতে হবে।তবু না বললেই নয়।
সেবার বড় ছেলে উত্তরবঙ্গ থেকে ফেরার পথে এক পেটি লিচু আনল বাড়ির জন্য।বাড়িতে পড়তে না পড়তেই নাতি,নাতনিদের মধ্যে পড়ে গেল ধুম।এক ঘন্টার মধ্যেই আধ পেটি শেষ।বাড়ির সকলেই লিচু ভালবাসে।বিনিতাও কম যান না। ভাবলেন,এতো সব হাতে,হাতে আজকেই শেষ হয়ে যাবে।তাই বুদ্ধি করে কতকগুলো পলিথিলের প্যাকেটে বেঁধে তার আটপৌরে কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রেখে দিলেন।ব্যাস,তিনদিন সেই লিচুগুলো আর কিছুতেই খুঁজে পেলেন না। গালিগালাজ করলেন শেষে নাতিটাকে।সেই নিশ্চয়ই তার রাখা লিচুগুলো ফাঁক তালে সাবাড় করেছে।কোথায় যে রেখেছিলেন,কিছুতেই মনে করতে পারলেন না।
পাওয়া গেল তিনদিন পর।যখন কাপড়টা টেনে পরতে গেলেন।পচে জল।কাপড়ে তার দাগও লেগেছে।শেষে মনটাই গেল খারাপ হয়ে।নিজের ভুলো স্বভাবের কথা ভাবতে গিয়ে।
তার দুদিন পর বড় বউমার সাথে সকালবেলায় আচমকা ঝগড়ার মত হয়ে গেল।সংসারে আসা বড়র দশ বছর হয়ে গেছে।এখনো অব্দি জ্ঞান হল না যে,তিনি লক্ষ্মীবারে পাঁচালী পড়া শেষ করে অল্প সুজির সাথে দুটো নুন ছাড়া পরোঠা খান।তবু বড় বউমা মাঝে,মাঝে রোজের মত লুচি তরকারী নামিয়ে দেয়।সেদিন তাই আর মাথা ঠিক থাকল না। শেষে রণমূর্তী ধারণ করে বড় বউমার প্রতি সমণ জারি করে বসলেন,একদম তুমি আমায় খেতে দেবে না বলে দিলাম। আমার হাত,পা এখনো অচল হয়ে যায়নি।নিজেই করে খাব।সেদিন দুটো বেলা তাই করলেন।কাজের মাসিকে দিয়ে নিজের পদ রান্না করিয়ে আলাদা খেতে বসলেন।পরদিন সকালে নিজেই নিজের প্রতিজ্ঞা ভুলে সুরেলা কন্ঠে বলে উঠলেন,বলি ও বড়বউমা।আমাকে কী তোমার মনে থাকে না মা?কোন সকাল থেকে না খেয়ে বাগানে মালির সাথে ধারাপাত পড়ে যাচ্ছি।একটি বার তো খেতেও ডাকলে না!
…আমি আর কটা দিন মা?সময়ে ডেকে দুটো খেতেও কী দিতে পার না?স্বর্গে গিয়ে আর ডাকবোনি।
কথাটা শুনে তার বড় বউমাটির রাগের থেকে বেশি কান্না পেল।বিনিতা সেই দেখে বলে উঠলেন,আবার কান্নাকাটি করা কেন মা?
…ভুল হয়।এই আমাকেই দেখো না।এখনো পর্যন্ত কেমন সব ভুলে যায়।খারাপ লাগে।তবু আজ পর্যন্ত কাঁদিনি।যাও এবার যা আছে দুটো নামিয়ে দিয়ে যাও তো।সময়ে না খেলে পেটে ব্যামো ঢুকবে যে।
এই হল বিনিতার ভুলো স্বভাবের পরিচয় ।এর থেকে কী ধারণা করা যায় আপনারাই ঠিক করুন।
সেদিন চন্দ্রানী বাড়িতেই ছিলেন।রান্না ঘরে একটু কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।অরূপা মা,বাবার বিবাহবার্ষিকীর কয়েকটা স্টিল ফটো স্টুডিও থেকে ধুয়ে এনে এ্যালবামে সাঁজিয়ে রাখছিল।এমন সময় বিনিতা এলেন হাতের লাঠি ঠুকে।
—বলি এত যত্ন করে কাকে লুকিয়ে রাখছো গো রাণী?…কই দেখি আমাদের রাজাকে?
কথা শুনে অরুপার খুব হাসি পেল।এ্যালবামটা বিনিতার দিকে বাড়িয়ে বলে উঠল,নিজের চোখেই দেখুন।
বিনিতা ছবিগুলো বার কয়েক ঘুরিয়ে,ফিরিয়ে দেখে নিয়ে মুখে কয়েকটা কুতসিৎ রেখা টেনে বলে উঠলেন,এগুলো কে?একজনকেও তো চেনা যায় না।আর এখানে রাজাই বা কোথায়?সাজানো চেয়ারে একজন আমজাদ খানের মত পেটমোটা পুরুষ আর তার পাশে খেঁদির মত ঠোঁট টেনে বসে আছে আধপাগলী বুড়ি!..আবার মুখের ঢং কত!…বয়স ঢাকতে এখন মেয়েরা যে কত রঙ্গ করে..দেখলে আমার পিত্তিসুদ্ধ জ্বলে যায়।ধুর হ..যতসব বাজে ফটো।এ নাও তোমার এ্যলবাম।এখন বলো তোমার মা কোথায়?
কথাগুলো শুনে অরূপার মাথাটা সত্যিই জ্বলে উঠল।ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে তার এতদিনের ধারণাটাই পাল্টে গেল।তার মাকে বলেন কিনা খেঁদি?..বাবা আমজাদ খান?অপরের সুন্দরতাই এত জ্বলেন মহিলা?পরশ্রীকাতরা!
অরূপা ঝনঝনে গলায় বলে উঠল,মা বাড়িতে নেই।দশ দিন পর আসবে।
বিনিতা উল্টো পা ফেলে মেঝেয় দুবার লাঠিটা পর,পর ঠুকে বলে উঠলেন,চন্দা তাহলে নতুন করে হানিমুনে বেরিয়েছে?..বেশ,ভাল।আসুক ফিরে।তারপর দেখাচ্ছি মজা।
বিনিতা চলে যাওয়ার পরও অরূপার মনটা অনেকক্ষণ ভারী হয়ে থাকল।একটু পরে চন্দ্রানী এসে বললেন,আর বিনা কই?এসেছিল না?
অরূপা ঝাঁঝ মিশিয়ে বলে উঠল,তাড়িয়ে দিলাম।
—সেকি!তুমি কিছু বললে নাকি?
—না বলিনি।তবে এবার এলে বলব।
চন্দ্রানী মেয়ের মুখের দিকে ভাল করে চেয়ে বলে উঠলেন,কী হয়েছে বলো তো? বিনা কী কিছু খারাপ কথা বলল তোমায়?
অরূপা চোখ,মুখ লাল করে বলে উঠল,মহিলাটিকে এতদিন ভালই জানতাম।আজ তার আসল রূপ প্রত্যক্ষ করলাম।
তারপরই তার মায়ের কাছে এ্যলবামটা ধরে বলে উঠল,আচ্ছা মা তুমিই বলো তো?তোমাদের দুজনকে একসাথে কী সুন্দর লাগছে তাই না?
—হ্যাঁ.. লাগবেই তো।আমরা তো আর দেখতে খারাপ কোনকালে ছিলাম না।
—-আর উনি ফটো দেখে তোমাকে না চেনার ভান করে খেঁদি আর বাবাকে আমজাদ খান বলে মনের জ্বালা মিটিয়ে ফেললেন।এবার তুমিই বলো মা…এরপরেও কী উনাকে সম্মান দেওয়া যায়?
কথাটা শুনে চন্দ্রানী প্রথমে একচোট হেসে নিলেন।তারপর কোনরকমে নিজেকে একটু স্থির করে বলে উঠলেন,ও…এই কথা!
—তুমি হাসছো মা?
—তুমিও হাসবে খানিক বাদে।যাও এবার ওকে ডেকে আনো।তারপর দেখো।
—আমি!
—কেন?
—আমি তো বললাম তুমি দশদিন বাড়িতে থাকবে না।
—-আচ্ছা।তাহলে তুমি নিজের রুমে গিয়ে বসো।বাকিটা আমি ম্যানেজ করছি।
কিছুক্ষণ পরেই হাসতে,হাসতে দুই বান্ধবী মিলে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন।
বিনিতা বলে উঠলেন,তাই বল চন্দা!..দ্যাখ তো আমি কেমন অন্ধ!নিজের বান্ধবীর মুখটাও চিনতে পারলাম না?আমার এমন রূপসী বান্ধবীকে যদি খেঁদি আর তার এমন পেলবান বরটিকে যদি আমজাদ খান বলি..কোন মেয়ের রাগ হবে না বল?তাই আমার রাণী মুখ লটকে আমায় মিথ্যে কথা বলে তাড়িয়ে দিলে?ঠিক করেছে।একশোবার তাড়াবে।বলি…এসো..এসো রাণী।এখনো কি তোমার মান ভাঙেনি?
নিজের রুম থেকে এবার অরূপা পিটপিট চোখে বেরিয়ে এসে বলল,এই তো আমি এসে গেছি।
—যাও গিয়ে এ্যলবামটা আর একবারটি নিয়ে এসো তো।ভাল করে সকলকে দেখি।তা আমায় আগে বলবে তো।এটা তোমার মা,বাবার ফটো।আমি আবার ছবি চিনতে পারি না রাণী।
এ্যলবামটা আবার আনা হল।তিনজনই বসে পড়ল এক জায়গায়।বিনিতা মাঝে।তার হাতেই এ্যলবামটা।একটা করে ছবি উল্টাচ্ছেন।
হঠাৎ এক জায়গায় বলে উঠলেন,পাশে এই ছুড়িটা কেরে চন্দা?একে তো এই তল্লাটে আগে কখনো নজরে পড়েনি।আবার শাড়ি পরার ঢঙ কত?এত সুন্দর একটা অনুষ্ঠানে নিজের শাড়িটা যে একটু গুটিয়ে পরতে হয় সে
কান্ডজ্ঞানটিও ছুড়ির নেই।ঠিক এই রঙের একটা শাড়ি ছিল আমার।ভাগ্যিস লিচুর দাগ লেগে খারাপ হয়ে গেছিল।তাই ঝিকে দিয়ে বিদেয় করেছি।এটা কোন শাড়ির রঙ নাকি?
কথাগুলো শুনে অরূপার চোখ কপালে উঠে এল।ডানহাতের তালুতে নিজের কপাল ঠুকে বলে উঠল,ওগো মাসিমা।ওটা আপনি।
বিনিতা চোখের সামনে ফটোখানা ধরে বলে উঠলেন,সেকি!আমি?আমি আবার এমন মোটা কখন হলাম?কী যাতা বলছো রাণী?তবে শাড়িটা অবশ্য আমার মতই মনে হচ্ছে।আচ্ছা.. চন্দা তুই দেখে বল তো।এটা কী সত্যিই আমি?
চন্দ্রাবতী মুখ চেপে বলে উঠলেন,হ্যাঁ রে।
—-সেইজন্য খোকাদের বলি ভাল কোন চোখের ডাক্তার দেখা আমাকে।সব নামের ডাক্তার ।এক কথাই বলেন।আপনার চোখে কোন সমস্যা নেয়।তবে এটা কী শুনি?
বিনিতার কথা শুনে সকলেই একবার হেসে উঠল ঠিক কথাই।কিন্তু সেই হাসির ছায়ার নিচে একটা দুঃখ যে অল্প সময়ের মত বিনিতার চোখের কোনে চিকচিক করে উঠল।সেটা দেখে ফেলল অরূপা।তাই তার মনটা চিনচিন করে উঠল।
—–সমাপ্ত—–