-উফ স্যাম, ডোন্ট স্পয়েল দ্য মুড ইয়ার। সবসময় তোমার এই বিয়ে বিয়ে ভালো লাগে না আমার।
টিনার গলাটা এমনিতেই একটু শার্প। তার উপর এখন আবার কথাগুলো একটু জোরেই বলে ফেলেছে।
কাছের দুটো টেবিলের লোকজন দু একবার ঘুরে তাকিয়েই আবার নিজেদের খাবারে মনোনিবেশ করলেন।
স্যাম মানে সমীর আর টিনা দুজনে আজ এই পার্কস্ট্রীটের পাচতারা হোটেলে এসেছে নিজের সেকেন্ড লাভ এনিভারসারি সেলিব্রেট করতে।
খুব সুন্দর তিন থাকের একটা কেক ওয়েটাররা এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। সেটা কেটে দুজনে দুজনকে খাইয়ে দিয়ে দুজনে স্টার্টার আর ওয়াইন নিয়ে বসেছে।
সমীরের এসবে খুব একটা আসক্তি নেই কোনোকালেই। কিন্তু টিনা বলে, ওয়াইন ছাড়া সেলিব্রেশন আর বউ ছাড়া বিয়ে দুটো নাকি একই ব্যাপার।
টিনার গলা শুনে সমীর ওকে ইশারায় চুপ করতে বলল। তারপর আলতো করে ওর হাতে চাপ দিয়ে বলল,
– আমি তোমার কথা মত দুবছর সময় তো দিলাম টিনা। এটা কি যথেষ্ট নয় দুজন দুজনকে চেনার জন্য!!
– একচুয়ালি আয়াম নট দ্য ম্যারেজ মেটিরিয়াল টাইপ গার্ল স্যাম। এই তো বেশ আছি দুজনে লিভ টুগেদারে। দুজনের সব নিডই তো ফুলফিল হচ্ছে, আর কি চাই!!
– আমি সংসার চাই টিনা। যেখানে তুমি আমি ছাড়াও আমাদের পরিবার থাকবে, আমাদের বাচ্চা হবে। আর কতদিন বোহেমিয়ান জীবন কাটাব!!
– বিয়ে!!সংসার!!বাচ্চা!! হোয়াট রাবিশ স্যাম!! লিসেন, আমার না এসব বিয়ে ফিয়েতে বিশ্বাস নেই একদম। একটাই জীবন, এটাকে চুটিয়ে লুটে নিতে চাই।
আরো একবার শেষ চেস্টা করে সমীর বলল,
– মা কে সেই প্রথমদিনই তোমার কথা বলেছিলাম টিনা। ছবিও দেখিয়েছি। মা খুব তাড়া দিচ্ছে বিয়ের ব্যাপারে।
– তো মাম্মা’স বয়, একটি গুডি গুডি মেয়ে দেখে বিয়ের পিড়িতে বসে গেলেই পারো।
– টিনা আমি তোমায় ভালোবাসি, তোমায় বিয়ে করতে চাই।
– বাট আমি চাই না। স্যরি।
বিরক্ত টিনা চেয়ার টাকে পিছনে ঠেলে নিজের পার্স আর ফোন নিয়ে হতভম্ব সমীরকে পিছনে ফেলে বেরিয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এল সমীরের।
চারদিকে কিছু কৌতুহলী দৃষ্টিকে পিছনে ফেলে বেরিয়ে গেল সেও। টিনাকে এখন আর ফোন করে লাভ নেই। ও হয়ত কোন বন্ধুর কাছে চলে গেছে। তাই একাই সমীর ওদের টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটে ফিরে এল।
ফ্রিজ থেকে একগ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে সোফায় বসে সেই প্রথম দিনের কথা ভাবতে লাগল। টিনার সাথে আলাপ একটা অফিস পার্টিতে।
একই অফিসে কাজ করলেও দুজন দুজনের কাছে অচেনাই ছিল এতদিন; যেহেতু ডিপার্টমেন্ট আলাদা। সবাই পান করে উত্তাল হয়ে গেলেও সমীর আলাদাই ছিল সেদিন।
হরিনারায়ণপুরের জমিদার বাড়ির ছেলে সে। বনেদিয়ানার সাথে সাথে সংস্কৃতি বোধ তার প্রবল বরাবরই। তাই চারবছর বাড়ি থেকে দূরে কলকাতায় থেকেও সে যেন ঠিক এখানকার মত হতে পারেনি।
তাই তো প্রত্যেক সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ি গেলে বৌদিদের সাথে সাথে কাকিমা জ্যেঠিমা রাও ওর পিছনে লাগত। বলত,
– সমু আমাদের বিয়ের পরেও দেখব বৌকে রেখে মায়ের কাছে আসছে।
সেদিন টিনাও ড্রিঙ্ক করার মুডে ছিলনা। তাই দুজনে মিলে ভালোই সময় কাটিয়েছিল। এরপর আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।
সমীর জানতে পারে, অনেক ছোটবেলায় ওর মা বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়। ওর কাস্টডি পায় বাবা। এরপর থেকে মায়ের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না।
বাবাও ব্যবসার কাজে বাইরে থাকেন সবসময়। তাই অঢেল সাচ্ছন্দ্য পেয়েও ভালোবাসা কি জিনিস অজানা রয়ে গেছিল টিনার কাছে।
চাকরিটা টিনা নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যই করত।
একদিন অনেক রাতে বাইরে জোরে জোরে বেল বাজানোর শব্দে চমকে ঘুম থেকে উঠে পড়ে সমীর। দরজা খুলে দেখে বাইরে একটা ট্রলিব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে আছে টিনা।
ভিতরে এসে কাদতে কাদতে টিনা যা বলল, তার সারমর্ম হল, ওর বাবা আজ রাতে একটা প্রায় ওরই বয়সী মেয়েকে নিয়ে আসে। টিনা প্রতিবাদ করায় বলেন, তিনি সেই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন আর টিনার অসুবিধা থাকলে সে বেরিয়ে যেতে পারে।
সেই থেকে একসাথে থাকা শুরু। দুটো বেডরুম থাকায় টিনার ওখানে থাকতে কোন অসুবিধাই হয়নি। কথা ছিল, যতদিন না টিনা মনমত থাকার জায়গা পাচ্ছে, ততদিন ওখানেই থাকবে।
তখনো ওদের মধ্যে নিখাদ বন্ধুত্বটাই বজায় ছিল। সমীরের মা যদিও জানতেন, টিনার কথা।
চিরকালের অগোছালো সমীরের জীবনটা আস্তে আস্তে গুছিয়ে দিচ্ছিল টিনা। সকালে যেখানে তাড়াহুড়ো করে বেরতে গিয়ে খাবার টাইম পেত না, এখন সেই সমীরকেই টিনা ব্রেকফাস্ট করে দিত।
তারপর দুজনে একসাথে অফিসে বেরিয়ে যেত। রাতগুলো রোজের একঘেয়ে রুটি তরকার বদলে ঘরোয়া সুস্বাদু খাবার খেয়ে কাটতে লাগল।
নোংরা জামার স্তুপও নিয়মিত ইস্ত্রি হয়ে আলমারিতে স্থান পাচ্ছিল আর একটু একটু করে দুজনেই দুজনের মনের কাছে চলে এসেছিল।
বাড়িতে ততদিনে মা বৌদি জেনে গেছে টিনার সাথে সম্পর্কের কথা। ওরা তাই আর ছবিতে নয়, মানুষটাকে সামনা সামনি দেখতে চায়।
ওদের দুজনের গাটছড়া বেধে দিতে চায়।ততদিনে যদিও টিনা আর সমীর একটাই ঘরে নিজেদের সংসার শুরু করে দিয়েছে।
তবু তখনো সমীরের উইকেন্ডগুলো হরিনারায়ণপুরেই কাটত। টিনাকে অনেকবার নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ও রাজি হয়নি।
দুবছর ধরে একসাথে থেকে সমীরের অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। তাই এই চারদিন ধরে একা থাকতে গিয়ে, টেবিলে খাবার না দেখতে পেয়ে টিনার উপর রাগটা কমে আসছিল আস্তে আস্তে।
অফিসে তো একমাসের ছুটি আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিল টিনা।না ,টিনাকে ফোনেও পায়নি সমীর। তাই তো এই সাজানো টু বি এইচকে ওকে যেন গিলে খেতে আসছে। রাতে তাই মা কে ফোন করে শুধু বলল,
– তুমি একবার আমার কাছে আসবে মা!!
দুবছরে ছেলে কখনো নিজের কাছে ডাকেনি বলে চাপা অভিমান জমে ছিল সরমা দেবীর। তবু আজ ছেলের ওই গলা শুনে স্থির থাকতে পারেননি।
পরেরদিন সকালেই হাজির হয়ে যান ছেলের কাছে। সেদিন শনিবার, অফিস ছুটি।দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে সব বলল সমীর।
ছয়বছরে এই প্রথমবার ছুটিতে বাড়ি যায়নি ও। দেখতে দেখতে রবিবারও কেটে গেল কিন্তু টিনাকে ফোনে পেল না কিছুতেই।
সোমবার দিন মায়ের হাতের রান্না খেয়েই অফিস গেল।কিন্তু ফিরে বাইরের ঘরে টিনাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল।
মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে গল্প করছে টিনা আর মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে!! এও সম্ভব!! নাকি স্বপ্ন দেখছে সমীর!!
স্বপ্ন যে নয় বুঝতে পারল সমীর, যখন মা বলল,
– পাগলীটাকে আনতে পেরেছি শেষ পর্যন্ত।
যদিও খাওয়ার টেবিলে দুজনে একটাও কথা বলেনি।টিনা নিজের ঘরে শুতে চলে গেলে সমীর মাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে।
– ওকে কি করে আনলে তুমি!!
– তোর ফোন থেকে ওর নম্বর নিয়ে আমার ফোন থেকে ফোন করে। সহজ ব্যাপার। এক ডাকেতেই চলে এল মেয়ে।
– কি কি বলল তোমায়!!
– সেসব পরে বলব। আগে তুই বল, ও যে বারবার বিয়ের জন্য না করত, তার আসল কারণটা কি সত্যিই তুই বুঝতে পারিসনি??
সমীর বুঝতে পারল না, বিয়ে না করার জন্য ঠিক কটা কারণ লাগে!! তবু মাথা নেড়ে না বলাতে মা বলল,
– ছোটবেলায় যার মা বাবার বিয়ে ভেঙে যায়, মা বা বাবা কেউ ঘুরেও তাকায় না, তার মানসিক অবস্থাটা ভেবে দেখেছিস কখনো?? ও তো বিয়ের কথা, সংসার বাচ্চা এসব শুনে ভয় পাবেই সমু। তোর আরো ধৈর্য নিয়ে বোঝানো উচিত ছিল।
চুপ করে থাকে সমীর। সত্যিই তো এইদিকটা তো কখনো ভেবেই দেখেনি ও। তারপর মা কে জিজ্ঞেস করল,
– তা মহারাণীর বক্তব্য কি এখন??
– কি আবার হবে?? যত তাড়াতাড়ি হয়, বিয়ে করে আমার কাছে থাকবে।
মায়ের কথা শুনে খুশিতে পাগল হয়ে গেল সমীর। মা কে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে খেয়ালই করেনি, কখন টিনা এসে দরজায় দাড়িয়েছে!!
– সব আদর নিজের ছেলেকেই করবে মা!!
টিনার গলা শুনে ওকেও নিজের বুকে টেনে নেন সরমাদেবী। এতদিনে ওনার মেয়ে না থাকার অভাব মিটল।
(সমাপ্ত)