আমার নাম নিরুপমা। আমার একটা গল্প আছে। আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন আমার মা মারা যান। আমার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, অধ্যাপক।
বাবা আর বিয়ে করেননি। গত সতেরো বছর যাবত আমাকে আগলে রেখেছেন, কখনোই চোখের আড়াল হতে দেননি। আমার বয়স এখন তেইশ। এটা গল্পের ভূমিকা।
কয়েকদিন হলো বাবা বাঁদর টাইপের একটা ছেলে ধরে এনে বলল, নিরু ছেলেটা ভালো, মেধাবী। কয়েকদিন থাকবে আমাদের বাসায়। আমার দুটো বইয়ের প্রুফ দেখে দিবে সাথে ও নিজেও একটা আর্টিকেল লিখে দেখাবে আমাকে।
এইসব মেধাবীদের আমার সহ্য হয় না একেবারেই। তার কারণ আছে। আমি পড়াশোনায় খুব একটা ভালো না। স্কুলে পড়ার সময় একবার ইতিহাসের শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো,
-নিরুপমা বলো তো সম্রাট অশোক কে ছিলেন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, মুঘল সম্রাট।
পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়লো।
যাই হোক, সেই বাঁদর ছেলেটাকে নিয়ে পারছি না একদমই। যেদিন এলো,খুব শীত পড়েছে। আমাদের বাসায় এক্সট্রা কম্বল নেই। পুরনো একটা লেপ ছিলো। তাই দিয়ে এলাম গেস্টরুমে। ছেলেটা একটু পরে সেটা ফেরত নিয়ে এসে বললো,
-শুনুন?
-বলেন
-আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন গ্রামে থাকতাম। আমার মা আমাকে লেপ দিত শীতের সময়। সকালে মা এসে দেখতো আমি লেপের কাভারের ভেতর ঢুকে আছি। তারপর এক সকাল আমার মায়ের কাটতো যুদ্ধ করে, আমাকে লেপের কাভারের ভেতর থেকে বের করার যুদ্ধ।
-এই ইতিহাসের মানে?
-এটাই, যে লেপে আমার পোষায় না। আপনার কম্বলটা নিয়ে যাচ্ছি আমি। আপনি লেপের নিচে আরামে ঘুমান।
পুরনো লেপ, কি দুর্গন্ধ!
সেই রাতটা আমার কাটাতে হয়েছে লেপের নিচেই। ঘুম কি আর আসে? নির্ঘুম রাতটায় মনে মনে ছেলেটাকে যে কত বকলাম আমি, সে আমার খোদা ই ভালো জানেন।
পরদিন অনেক বেলা করে ছোকরাটার ঘুম ভাঙলো। আমি বেলকুনিতে বসে পেপার পড়ছিলাম। ছেলেটা এসে বলল,
-নিরু। গুড মর্নিং। ঘুম কেমন হলো?
-আপনার মাথা।
-একদম ফ্রেস। ঘুম ভালো হয়েছে আমার।
-কিছু দরকার আছে?
-হু। একটু কষ্ট করে পানি গরম করে দেন। আমি গোসল করব। এই শীতে ঠাণ্ডা জলে আমার পোষায় না।
-এহ! আসছে। উনাকে পানি গরম করে দিতে হবে!
-বেশ তো! না দিলেন। আমি আপনার এখানেই শাওয়ার নেই তাহলে। নিশ্চয় গরম জলের ব্যবস্থা আছে।
– না! না! না! দাঁড়ান করে দিচ্ছি গরম
আমি নিরুপমা, জীবনেও এত অসভ্য ছেলে দেখিনি।
গোসল সেরে এসে বলতেছে, নিরু আপনার লোশন- টোশন কিছু আছে?শীতের আদ্রতায় আমার ত্বক খসখসে হয়ে থাকে।
-অই! আপনি নিয়ে আসতে পারলেন না এগুলো?
-কোথাও যাওয়ার সময় আমার ব্যাগ বেশি ভারী হয়ে গেলে বহন করতে কষ্ট লাগে।
-আইছে! নবাব সিরাজউদ্দৌলা!
সেদিন কাজের মেয়েটা আসেনি। এমনিতেই মাথা গরম। বাবা বাইরে থেকে দুজনের নাশতা আনিয়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছেন। একটু পরে নবাব সাহেব এসে বলতেছেন,
-নিরু আমি বাইরের খাবার খেতে পারি না একদমই। আপনি দুটো পরোটা আর একটা ডিম ভেজে দেন তো।
-এহ! আইছে! শুনেন আমি নিজেই ভেজে খাই না কোনোদিন।
-তাতে কি? আমাকে দেন?
-কেন দিব?
-ভালোবাসলে দিতে হয়।
-কে কাকে ভালোবাসে! শুনেন, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। এইসব চলবে না এখানে!
-কে বয়ফ্রেন্ড? আপনার মারুফ ভাই? সেদিন আপনার জন্য বই নিয়ে এসেছিলো যে, সেই লোকটা?
-উফ! সে আমার কাজিন! বয়ফ্রেন্ড আবার ভাই হয় নাকি?
-কি জানি? আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল না তো কোনোকালেই। জানা নেই।
-তো?
-আমি আসলে এভাবে মিন করে বলিনি। ভাবলাম গেস্ট তো আমি আপনাদের। আর গেস্টদের তো সবাই ভালোবেসে। তাই আর কি!
এই ছেলে মেধাবী কিনা জানি না, তবে যে আস্ত একটা মিচকে শয়তান তাতে সন্দেহ নেই।
মাঝেমাঝে অতিরিক্তও করে ফেলে, তার দুটো উদাহরণ দেই। সেদিন ছাদে দাঁড়িয়েছিলাম। শেষ বিকেল।
ছোকরাটা কখন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে জানি না। হঠাৎ দেখেই চমকে উঠলাম, জিজ্ঞেস করলাম
-কি চাই?
ছেলেটা সিগারেট বের করতে করতে বলল,
-লাইটার হবে?
-অসভ্য!
সেদিন কাজের মেয়ে বিলকিসকে বকছিলাম। বাবা চায়ে চিনি খান না। ও ভুল করে আমার কাপেও চিনি দেয়নি ওইদিন। বিলকিছ বলল, খাড়ান আপা চিনি দিয়া আনতাছি আবার।
আমাদের কিচেনের পাশেই ডাইনিং। ছেলেটা ওখানেই খাবার গিলছিলো। বিলকিছকে ডেকে বলল, চা টা নিয়ে এসো তো। বিলকিছ চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো,
ছোকরা এক চুমুক খেয়ে বলল এটা নিরুকে দিয়ে আসো। মিষ্টি হয়ে গেছে।
আমি আর বিলকিছ দুজনেই ছানাবড়া চোখে ছোকরাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আশ্চর্য সাহস তো!
কিন্তু তবুও আমি কেন জানি কঠোর হতে পারতাম না ছেলেটার প্রতি। কেমন মায়াভরা চোখ, শরতের আকাশের মত নির্মল চাহনি, পাপ নেই। যখন মৃদুমন্দ বাতাসে ছেলেটার চুল উড়ত, মনে হতো আমিও যেন কাশফুলের মতো দুলছি!
কিন্তু তবুও আমি কঠোর হতে চাইতাম, কঠোর না হলেও কঠোর হওয়ার অভিনয় করতাম। তার কারণ আছে, আমার তিন বছরের সম্পর্ক জিসানের সাথে। ওকে কথা দেয়া হয়ে গেছে আমার।আর এই ছোকরা তো ক্ষণিকের অতিথি!
মাঝেমাঝেই উঁকি দিতাম ছেলেটার রুমে। দেখতাম কেমন উদাস চোখে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে! বড্ড মায়া হতো! না জানি কোন অজানা কষ্ট তাড়া করে বেড়ায়।
মাঝেমাঝে আবার বুদ হয়ে থাকতো বই নিয়ে, টেবিলে। এটা ওটা লিখতো। তখন অন্যদিকে আর মনোযোগ দেবার সময় নেই যেনো নবাবের।
মাঝেমাঝে মানুষের অবচেতন মনে কত কি ঘটে যায়, কত রকমের ভাবনা এসে যায়, তার জন্য কি তাকে দায়ী করা চলে?
সেদিনটাও ছিল আমার তেমনি। মিষ্টি কালারের শাড়ি পরেছিলাম, ঠোঁট গাঢ় লালে রাঙিয়েছিলাম। কপালে ছিল না টিপ, ভেবেছিলাম কাছে যাব আর নবাবজাদা বলবে, এসো নিরু! তোমার কপালে চুমু এঁকে দেই। কাছে গেলাম, তিনি বললেন নিরু কটনবার হবে? কানে চুলকাচ্ছে খুব।
মানুষ যখন নিজের কাছে নিজে অপমানিত হয় তখনই সবচেয়ে বেশি লাগে, আমারও লেগেছিল সেদিন খুব।
জিসানের সাথে আমার তিন বছরের সম্পর্ক, আমাদের সম্পর্কের দুই বছরের মাথায় জিসান অস্ট্রেলিয়ার ভিসা পায়। সম্পর্ক তো আছে এখনো আমাদের, কিন্ত আগের মতো আছে কি? ইদানীং জিসানের এত ব্যস্ততা! আর তাছাড়া এই বাঁদরটার জন্যেই আমার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, সব!
নাহ! আর সহ্য করব না। কিছুতেই প্রশ্রয় দিব না। আমি কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠলাম। তাছাড়া আমার কেন জানি মনে হয়েছিলো, এই ছেলে আমাকে অবজ্ঞা দেখিয়েছে, ভীষণ ভীষণ। এত সুন্দর করে সাজলাম, আর বলল না সুন্দর? এই সুন্দর না শোনার আক্ষেপ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো সেদিন, প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিলো।
রাগে ক্ষোভে ছাঁদে উঠে দেখি, ছেলেটা ছাদের ওপর ইটের টুকরো দিয়ে কি সব আঁকছে! রাগতস্বরে বললাম,
– ভদ্রলোকের বাসা! এসব চলবে না এখানে।
-ওহ! স্যরি।
ছেলেটা এমনভাবে স্যরি বলল, বুকে বিঁধলো আমার। কিন্তু আহত হয়ে আমি যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
-ভদ্রলোকের বাসায় কিভাবে থাকতে হয়? জানেন না?
ভদ্রতাজ্ঞান কিছু শেখায়নি বাবা মা?
– জি না।
– অসভ্য! ফাঁজিল! সব সময় ফাঁজলামো? কেমন বাবা মায়ের সন্তান আপনি?
-আমি জানি না।
-মানে?
-কিছু না।
কেমন সজল চোখে নিচে নেমে গেলো ছেলেটি, কিন্তু আমার মধ্যে ঝড় তুলে আমার সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলো। নিজেও ছাঁদের ওপর বসে বসে কাঁদলাম কিছুক্ষণ। কি করব? কি করা উচিত? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এতটা নির্দয়ভাবে না বললেও হতো।
ছাদে তেমনই বসে ছিলাম। কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে জানি না। উনি ব্যাগ গুছিয়ে এসে বলছেন, চলে যাচ্ছি।
আপনাকে সত্যিই দুঃখ দিতে চাইনি। আমি আসলেই জানি না আমার বাবা মা কে? কার সন্তান আমি?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, মুহুর্তেই। উনি আবার শুরু করলেন,
আমি পথশিশু ছিলাম। স্যার, মানে আপনার বাবা আমাকে একদিন রাস্তায় অকারণে মার খেতে দেখেছিলেন। উনার মনে হয়তো দয়া হয়েছিলো। উনি একটা চাইল্ড কেয়ারে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেন। স্যার নিজেই খরচ দিতেন। আমি বড় হওয়ার পর একটা সময় স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার আপনি কেন আমার খরচ বহন করতেন?
স্যার দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলেন! বলেননি কিছুই। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, স্যার স্ত্রী মানে আপনার মাকে হারিয়ে খুব নিঃসঙ্গতা অনুভব করতেন ভেতরে ভেতরে। আর এরকম মানুষের হৃদয়টা বড় হয়।
-তাহলে প্রথম দিন লেপের যে গল্প বলেছিলেন?
-মিথ্যে ছিল।
-কিন্তু কেন?
-যখন আমার খুব একা লাগে, তখন মিথ্যে বলে ফাজলামো করি, একটু বেশিই করি। বলতে পারেন নিজেকে আনন্দ দেয়ার জন্য। তাছাড়া আপনার সাথে যে ফাজলামো করেছি, তারও কোন অর্থ নেই। হয়তো অর্থ আছে তার। সংসারে কতকিছুর অর্থই তো আমাদের কাছে বোধগম্য নয়!
-কিন্তু বাবা আমাকে এসব লুকিয়েছে কেন?
-আমি জানি না।
পড়াশোনায় ভাল ছিলাম, একাডেমিক পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিতেই কানাডায় একটা ইউনিভার্সিটিতে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হলো। পরশু ফ্লাইট। চলে যাবো। স্যারকে জানিয়েছিলাম, উনি বললেন সারাজীবন একা একা থেকেছো, যাওয়ার আগে কয়েকটা দিন আমার এখানে থেকে যাও।
কিন্তু কি করব? কদিনেই অনেক বিরক্ত করা হয়ে গেলো আপনাকে। বাবা মা শেখাতে পারেনি তো কিছু। আমার সে সৌভাগ্য হয়নি। ক্ষমা করবেন!
-শুনুন?
-জি?
– এতদিন ধরে আছেন কিন্তু আপনার নামই জানা হয়নি এখনও।
-আমার নাম আমি নিজেই জানতাম না। স্যার আমাকে ডেকেছিলেন,অর্ণব। সার্টিফিকেটে এটাই আছে।
অর্ণব চলে গেলো, আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলাম। ইচ্ছে করছিলো সবকিছু ছেড়েছুড়ে ওর বুকে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু পারলাম কোথায়?
তারপর?
তিন বছর হলো জিসানের সংসার করছি। মাঝেমাঝেই জিসান আমাকে সমুদ্রের কাছে নিয়ে যায়। সমুদ্রের কাছে এলেই মনে পড়ে অর্ণবকে, মনে মনে বলি
অর্ণব মানেই তো সমুদ্র, বিশাল।
আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে সেই বিশালতায় এতটুকুন ঠাঁই দিও, প্রিয়তম!