ভুমিকা – আজ বলব হিমালয়ের কোলে লেপচা জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত এক গল্প। এই গল্পটি নেপাল ,সিকিম আর ভুটানে বেশ জনপ্রিয় লোককথা । অঞ্চল ভেদে একটু তারতম্য লক্ষ্য করা যায় । আমি এই গল্প শুনি আমার এক বন্ধু করন শাক্য এর কাছে । নেপালের নেওয়ার জনগোষ্ঠীর সদস্য সফটওয়্যার প্রকৌশলী এই বন্ধুটি অনেক গল্পের আধার । এই গল্প বসন্তের গল্প ,এই গল্প ভালবাসার গল্প ,এই গল্প ব্যার্থ প্রেমের কষ্ট কাব্য ……
উতিশ/উত্তিশ কুমার আর গুরাস কন্যার প্রেম গাঁথা (নেপালি বন্ধুর কাছে শোনা )
সে অনেক অনেক কাল আগের কথা , তখন গাছেদের মাঝে বিয়ের প্রচলন ছিল । হিমালয়ের উঁচুতে বসবাসরত এক লালি গুরাস ( লাল রডোডেনড্রন ) কন্যা মধ্য শীতে বেড়ে উঠল ,এক্কেবারে বিয়ের যুগ্যি কন্যা হিসাবে । মনে তার রঙ লেগেছে ।ঘরে তার একদম মন টেকে না । একবার সে এই হাড় কাঁপানো শীতে বেড়িয়ে পড়ল পাড়া বেড়াতে । এখানে সেখানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সে এসে পড়ল এক উতিশ গাছের কাছে । পাহাড়ের মাথায় দাঁড়ানো উতিশ /উত্তিশ কুমারকে ( হিমালয়ান আল্ডার ) দেখে প্রথম নজরেই তার প্রেমে পড়ে গেল গুরাস কন্যা । কাউকে কিছু না বলে চুপিসারে সে চলে এল সেখান থেকে ।
লালি গুরাস
লালি গুরাস
কিন্তু দিন দিন তার নাকাল অবস্থা প্রেমে পরে । ভালবাসা কেমন করে আসে তা কি কেউ বলতে পারে? কথায় বলে প্রেমে পড়লে আর পারদ খেলে তা লুকানো যায় না । তার মনের উথাল পাথাল অবস্থা দেখে পাড়া পড়শিরা সব হেসেই খুন । সবাই কানাকানি শুরু করল ,হায়রে এই মেয়ে যে প্রেমে পাগল হয়ে গেছে !! সারাদিন গুরাস কন্যা শুধু উতিশ/উত্তিশ কুমারের চিন্তায় বিভোর থাকে ।
তার এই অবস্থা দেখে একদিন এক বুড়ো পিপল গাছ (অশ্বত্থ / অশথ) তাকে পরামর্শ দিল , শোন লালি গুরাস এভাবে একা একা মনে মনে ভালবেসে কি লাভ? তুমি বরং তোমার মনের কথা মনের সখাকে জানাও ।
বুড়ো পিপল
বুড়ো পিপল
কথাটা লালি গুরাসের খুব মনে ধরল । একদিন সে দুরু দুরু বুকে এসে দাঁড়াল উতিশ/উত্তিশ কুমারের সামনে । তারপর সব লাজ লজ্জা ভেঙ্গে তাকে জানাল মনের কথা। লালি গুরাস সরাসরি উতিশ/উত্তিশ কুমারকে বিয়ের প্রস্তাব দিল ।
উতিশ/উত্তিশ কুমার এক পলক গুরাস কন্যাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিল । তারপর অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে অহংকারের সাথে বলল,নিজেকে দেখেছ কখনও ? ওই কুজ ওয়ালা কোঁচকানো শরীর নিয়ে বিয়ে করতে চাও আমার মত সুদর্শন কে ?
উতিশ কুমার
উতিশ কুমার
কথাগুলো তীরের ফলার মত বিঁধল গুরাস কন্যার বুকে । তারপরও সে মিনতি জানাল ,দয়া করে একবার আমার কথা ভাব কুমার । আমি যে তোমার প্রেমে পাগল হয়ে গেছি। অবজ্ঞা ভরে উতিশ /উত্তিশ কুমার উত্তর দিল , তা যা বলেছ কিন্তু আমি তো আর পাগল হইনি ।
হতাশ প্রেমিকা প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেল । তার বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘ শ্বাস । দুঃখী মনে সে শূন্য হৃদয়ে পথ চলতে লাগল । পথ চলতে চলতে সে মনে মনে ভাবল আজ বুঝলাম দুঃখ কাকে বলে । কে জানে এই বিশাল পৃথিবীতে আরও কত দুঃখী আছে । কথাটি ভাবতেই পৃথিবীর সব কিছুর উপর তার এক অদ্ভুত মায়া জন্মাল । সে মনে মনে ঠিক করল এখন থেকে তার একমাত্র কাজ হবে অন্যকে সুখী রাখা ।
কুঞ্জে ফিরেই সে কাজ শুরু করে দিল । তার এই পরিবর্তনে সবাই খুশি । কেউ আর তার প্রেমের কথা তোলে না । কাঠবেড়ালি তার পাতায় চুমু খায় , পাখিরা তার ডালে ডালে বসে গান শোনায় । ভালবেসে সবাই তার নাম দিল মিষ্টি কুমারী ।
তারপর ধীরে ধীরে গলতে শুরু করল বরফ । হিমালয়ে শীত শেষে হল বসন্তের আগমন । আর গুরাস কুঞ্জের সব বাসিন্দারাও সেজে উঠল আর সেই সাথে সাজিয়ে তুলল লালি গুরাসকেও ।
হাওয়া এসে ঝেড়ে দিল তার পাতার ধূলা আর মেঘেরা শিশির পাঠাল পাতাগুলো চকচকে করে তুলতে । সবার ভালবাসায় লালি গুরাসের শরীরে ধরল কুঁড়ি এরপর ফুল ।ওইদিকে উত্তিশ/উতিশ কুমারে সৌন্দর্য যেন সময়ের সাথে সাথে বেড়ে চলল । কিন্তু আজ সে খুঁজে পেল না মনের মত কাউকে । হঠাৎ একদিন এক ছোট্ট পাখি তার কাছে ধরল মিষ্টি সুরে গান । মুগ্ধ উত্তিশ/উতিশ কুমার শুধায় পাখিরে ,তুমি কোথা শিখলে এমন মধুর গান । পাখি বলে ওমা তুমি জান না আমি তো মিষ্টি কুমারীর কাছ থেকে শিখেছি ।
উত্তিশ/উতিশ কুমার ভাবল একবার ঘুরে আসবে সে মিষ্টি কুমারীর কুঞ্জ থেকে । তারপর একদিন বিকেলে সে চলল পাহাড়ের উঁচুতে মিষ্টি কুমারীর কুঞ্জে। চলতে চলতে সে এসে পৌঁছাল এক্কেবারে লালি গুরাসের সামনে । লালি গুরাসের মোহনীয় রূপ দেখে কুমারের মন পাগল পাড়া । তখন এক দুষ্ট প্রজাপতি কুমারের কানে কানে বলল চিনতে পার কি উত্তিশ/উতিশ কুমার এই সেই কুজ ওয়ালা কোঁচকানো শরীর এর লালি গুরাস । এই কথা শুনে লজ্জায় কুমার মুখ নিচু করে বার বার ক্ষমা চাইল আর অনুরোধ করল তাকে বিয়ে করার ।
কিন্তু আত্মসম্মানী লালি গুরাস তাতে রাজী হল না । সে খুব মিষ্টি করে কুমারকে বলল , তা আর হয় না । তার কথা শুনে উতিশ/উত্তিশ কুমার খুব হতাশ হল । অহংকারে সে যে ভুল করেছিল তা বুঝতে পারল । হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের ঢালে এসে হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল উত্তিশ/উতিশ কুমার ।
সেই থেকে পাহাড়ের অনেক উঁচুতে জন্মায় গুরাস আর ঢালে জন্মায় উত্তিশ/উতিশ গাছ ।যাতে তাকে কখনও লালি গুরাসের মুখোমুখি হতে না হয় ।পাহাড়ের মানুষ কোনদিনও ভুলবে না এই প্রেম গাঁথা । আজও যখন পাহাড়ে ধ্বস নামে তখন ঢালে জন্মানো কিছু তরুন উত্তিশ/উতিশ গাছ প্রাণ হারায় ।