আমাদের বাড়ির সামনে পুকুর। পুকুরের পাড় ধরে কিছুটা গেলে, আম লিচুর বাগান। ও দিকটায় দত্তদের বাড়ি এবং আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে ছাড়াবাড়ি। পাশে খাল। – বড় বড় সব গাব গাছ। গাব গাছের পাতা লম্বা কালো রঙের – গাছের গুড়ির রঙও কালো। ডালপালার মধ্যে গভীর অন্ধকার।
ছেলেবেলায় রাতে কোন গাব গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। গা ভয়ে শিরশির করত। গায়ের বাড়ি যেমন হয়ে থাকে – ছাড় ছাড়া। বাড়িঘর কম। সবার বাড়িঘরের সঙ্গেই বাগান পুকুর বাগিচা থাকে। গায়ের অধিকাংশ মানুষ স্বচ্ছল। পুকুর বাগান নিয়ে এক একটা বাড়ি একা দাঁড়িয়ে থাকে। খেলার মাঠ থেকে ফিরে যে বার বাড়িতে দৌড়ে ঢুকে যেতাম। কারণ সন্ধ্যার পর অপদেবতারা এখানে সেখানে থাকবেই। রাত হলে তাদের খুব মজা।
আর যেমন সব এলাকরই একটা শ্মশান থাকে, আমাদের এলাকার শ্মশানও নদীর পাড়ে। ক্রোশখানেক দূরে ছাগল বামনি নদীর ধারে। খুবই নির্জন জায়গা। মাঠ পার হয়ে আলিপুরার বাজার পার হয়ে শ্মশান যেতে হয়। তবে সেটা শরতে, শীতে এবং গ্রীষ্মে। বর্ষাকাল এলে নদীর পাড় জলে ডুবে যায়। বর্ষায় কেউ মারা গেলে, যে যার পুকুরের পাড়ে অথবা বাগানে মৃতের দাহ করে। ফলে যা হয়, যে কোন বাগান কিংবা পুকুরের পাড় রাতে আমাদের ভীতির সঞ্চার করত। রাতের বেলা একা বের হতে সাহস পেতাম না।
অন্ধকার না থাকলে নির্জন বাগ বাগিচা না থাকলে ভূতেরা আস্তানা খুঁজে পায় না। দিনের বেলায় কেউ কখনও ভূত দেখেছে শুনিনি। ভূত দেখতে হলে রাতে দেখতে হয়। সাদা জ্যোৎস্নায়ও ভূত দেখা যায়। সাদা জ্যোৎস্নায় ভূতেরা আমাদের খেলার মাঠে ফুটবলও খেলে শুনেছি। এসব কথা অবশ্য বলা ছেলেবেলার সেই সব অলৌকিক দেব দেবী এবং ভূত প্রেতের বিশ্বাস কত গভীর ছিল তাই বোঝাতে। কলকাতায় ভৃত থাকে না। অনেক শহর থেকেই তারা আস্তানা গুটিয়ে পালিয়েছে। আমি এখন কলকাতার মানুষ বলে, প্রায় ভূতের উপদ্ৰবের কথা ভুলেই গেছি। তবে আমি যে ভূত দেখি না তা নয়। ঘোরে পড়ে দেখি। এটা একটা অসুখও হতে পারে।
সে যাই হোক সেদিন মঞ্জু আবার আমার জানালায় হাজির হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে গেল। সেই যে বললাম, গাব গাছের অন্ধকার, বড় ভয় লাগে রাতে —
মঞ্জু এসেই বলেছিল, কী ছেলেমানুষী করেছি তোকে নিয়ে। এখন ভাবলে নিজেরই হাসি। পায়। মঞ্জু আমার সমবয়সী। ওর বাবা কবিরাজ। ওদের একটা লাল রঙেব ঘোড়া ছিল। মঞ্জুর বাবা হেমন্তে, শীতে ঘোড়ায় চড়ে রুগীর বাড়ি যেতেন। ডাকসাইটে কবিরাজ। লাল ইটের দালান – সামনে সবুজ ঘাসের লন, পরে এক লপ্তে বিঘে দশেক জমি নিয়ে নানা বয়সের গাছগাছালি। কবিরাজীতে এ সব গাছ গাছড়া বড় দরকার। চন্দনগোটার গাছগুলি ছিল বড় লম্বা। আমি মঞ্জু দুপুরে পালিয়ে চন্দনগোটা সংগ্রহ করেছি কত। কমলা রঙের ঠিক যেন এক একটা ছোট বৃত্তাকার পলা। আংটির পাথরের মত। চন্দনগোটার বন পার হলেই গাব গাছের জঙ্গল।
নদীনালার দেশে গাব গাছের বড় দরকার। গাবের কস না খাওয়ালে বর্যায় নৌকো ভাসানো যায় না। কবিরাজী ওষুধে গাবের ডালপালা লাগে কিনা জানি না, তবু ঐসব গাছগুলি মঞ্জর বাবা অমর কবিরাজ বড় যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করতেন। তার নিচে লাল রঙের ঘোড়াটা যখন যেত তখন মঞ্জু আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম। মঞ্জু সব সময় কেন যে সাদা ফ্রক পরতে ভালবাসত জানি না। ওকে দেখলে আমি স্থির থাকতে পারতাম না ।
সেই মঞ্জর মা এক সকালে কেন যেন জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিল, এখনওতার কারণ আমরা জানি না। বর্ষাকাল বলে মঞ্জর মাকে দাহ করা হয়েছিল ছাড়াবাড়ির পাশে খালের ধারে। জমিজমা বাগ বাগিচা গাঁয়ে অমর কবিরাজেরই বেশি। মঞ্জুর দাদুও ছিলেন বড় কবিরাজ। ওদের বংশটাই কবিরাজের বংশ। সৌখিন মানুষ গাঁয়ে এমনিতেই কম দেখা যায়। মঞ্জুদের বাড়ি গেলে আমরা বুঝতে পারতাম সৌখিনতা কাকে বলে। সাদা টাইলসের মেঝে, বাতিদান,
মোমবাতি সেখানে জ্বালানো হত। রাতে কাচের জারে মোমবাতি জ্বালালে কেমন এক মায়াবী আলোর জগৎ তৈরী হয়। মঞ্জুদের বাড়ি না গেলে আমরা বুঝতেই পারতাম না, মানুষ এত সৌখিনতায় বড় হতে পারে। বসার ঘরটা ছিল হলঘরের মত। মঞ্জুর বাবা ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হাইস্কুলের সেক্রেটারী, লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা। এসব দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, এমন সুন্দর বাড়িতে কেউ কখনও আত্মহত্যা করতে পারে।
এখন বুঝি আত্মহত্যার পর মৃতের ময়না তদন্ত হয়। তখন এসব জানতাম না। সে সময় নিশ্চয় এমন সব আইনের কড়াকড়ি ছিল না। অথবা এও হতে পারে প্রভাবশালী মানুষের বউ আত্মহত্যা করলে ময়না তদন্তের রেয়াজ নেই। আত্মহত্যা না খুন এটা ঠিক হয়নি তখন। লাশ তোলার পর, গলায় কলসী বাঁধা দেখা গেছে, এই পর্যন্ত। গাঁয়ের সব মানুষজনকে দেখেছি মঞ্জুর বাবাকেই প্রবোধ দিতে। কেন মরল এটা বড় কথা নয়, মরে যে ঠিক করেনি, এত বড় একটা বংশের মুখে চুনকালি মাখিয়েছে, এমনই ছিল তাদের অভিযোগ।
যাই হোক, মঞ্জর মা কীরকম রূপবতী ছিল লিখে তার প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মঞ্জু খুবই ভেঙে পড়েছিল। মঞ্জুর জন্য আমার খুব কষ্ট হত। আমাদের পুকুর পার হয়ে আমবাগানের ভেতর দিয়ে গেলে মঞ্জুদের বাড়ি।
আমার বাবা কাকাদের সঙ্গে খুবই সুসম্পর্ক। আমার মা কাকীরা সারাদিন তাদের বাড়িতেই ছিলেন। দাহকার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ নড়েননি। মঞ্জুকে সামলাবার দায় ছিল আমার।
আর আশ্চর্য, মঞ্জর মায়ের আত্মহত্যার পরদিন ঘোড়াটাও জলে ডুবে মরে থাকল। ঘোড়াটার চারটে পা বেঁধে কারা ঘোড়াটাকে জলে ফেলে দিয়েছে। ঘোড়াটার খুব কাছের জন ছাড়া পায়ে দড়ি কেউ বাঁধতে পারে, আমার কেন কারোরই বিশ্বাস হয়নি। কাছের জন বলতে, ঘোড়াটার দেখভাল করে ইমতাজ আলি, ঘোড়াটায় চড়ে মঞ্জর বাবা। বর্ষাকালে অবশ্য ঘোড়াটা ছাড়াবাড়িতে ঘাস খেত। কারণ বর্ষাকালে ঘোড়ায় চড়ে কোথাও যাওয়া যায় না। সেসময় ঘোড়াটার আরও কাছে ছিল মঞ্জু নিজে। মঞ্জুর সে বড় অনুগত ছিল। মঞ্জু খুশি মত ঘোড়ার পিঠে আমাকে নিয়ে ছাড়াবাড়িতে নিৰ্জন দুপুরে ঘুরে বেড়াত। ওর বাবা তখন বাড়ি থাকত না। নৌকো করে মাস দু মাসের জন্য দূর দেশে চলে যেত রুগীপত্তর দেখতে। বছরকার ওষুধ সঙ্গে নিত। আবার পরের বর্ষায় দেখা হবে, বছরকার ওষুধপত্তর দিয়ে মঞ্জর বাবার ফিরতে মাস দুই লেগে যেত। নৌকোয় রান্না হত, মাঝিমাল্লার সঙ্গে রান্নারও লোক থাকত।
বর্ষার মাস দুই তিন বাবা না থাকায় মঞ্জুদের বাড়িতে কোনো কড়া নিয়মকানুন থাকত না। যখন তখন মঞ্জু আমাদের বাড়ি চলে আসত। রঙ্গল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বলত এই যাবি।
তখন সে আর আমি, আর লাল রঙের ঘোড়া। ছাড়াবাড়িটা বিশাল গাছপালা আর গভীর জঙ্গল, ঘাসের মাঠ। কুলের দিনে কুল, পেয়ারার সময় গাছে উঠে পেয়ারা পেড়ে দেওয়া, গোলাপজাম, যখনকার যা, সবই সংগ্রহ করতে হত আমাকে। গাছের নিচে মঞ্জু দাঁড়িয়ে থাকত। গাছের ডালে আমি। সুতরাং দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব জন্মাবার ই কথা। সুখে দুঃখে মঞ্জর আমি সঙ্গী। ওর মা মরে গেল, ঘোড়া টাও মরে গেল, এক সকালে শোনা গেল ইমতাজ আলিও নেই। সেও খালপাড়ে মরে পড়ে আছে। এক মাসের মধ্যে মঞ্জু দের বাড়িটা কেমন খালি হয়ে গেল। আমি ছাড়া মঞ্জুর তখন আর কোনো অবলম্বনই ছিল না। সে সারাটা দিন আমাদের বাড়িতে থাকত। কিছুতেই বাড়ি যেতে চাইত না। মঞ্জুকে কেউ নিতে এলে মা কাকিমারা বলত, থাক না। এখানে থাকলে মনটা ওর ভাল থাকে।
সে থাকত। আমরা একই ঘরে শুতাম। মঞ্জু শুতো ঠাকুমার সঙ্গে। ঠাকুমার এক পাশে মঞ্জু, এক পাশে আমি।
সেই মঞ্জু যে বড় হয়েও আমাকে ভুলতে পারেনি, এটা এখন টের পাই। মঞ্জ প্রায়ই জানালায় এসে দাঁড়ায়। বলে কিরে মনে আছে? কী মনে আছে।
রাতে তুই আমি দরজা খুলে বের হয়ে যেতাম। জ্যোৎস্না রাতে ছাড়াবাড়ির মাঠে শুনতে পেতাম ঘোড়ার খুড়ের শব্দ। এগুলো এক ধরণের রহস্যময়তা এই বয়সে তাই মনে হয়। অথবা ঘোরে পড়ে গেলে হয়। আমরা বোধহয় দুজনেই ঘোরে-পড়ে বের হয়ে যেতাম। দেখতাম, দূরে জ্যোস্নায় কে দাঁড়িয়ে আছে।
মঞ্জু বলত, আমার মা আমাকে দেখতে আসে। আমি কিছু দেখতে পেতাম না। তা জ্যোস্নায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকতেই পারে। মঞ্জু এমন সরলভাবে কথাটা বলত যে বিশ্বাস না করে পারতাম না। আমারও
কেন জানি মনে হত সত্যিই শাড়ি পরে কেউ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা এভাবে একেক রাতে একেক দৃশ্য দেখতে পেতাম। কখনও মঞ্জর মাকে, কখনও লাল রঙের ঘোড়াটাকে, কখনও ইমতাজ আলিকে, আবার কখনও তিন জনকেই একসঙ্গে। ইমতাজ আলি মঞ্জর মাকে নিয়ে ঘোড়াটায় চড়ে আমাদের চোখের সামনে দিয়েই অদৃশ্য হয়ে যেত।
এখন অবশ্য আমার বয়েস হয়েছে। দেশভাগের পর মঞ্জুকে আর দেখিওনি। তবু নাকি আমার কী হয় মাঝে মাঝে। একদিন তো আমার স্ত্রী কেঁদেই ফেলেছিল – তোমার কী হয়। কার সঙ্গে একা একা কথা বল।
কার সঙ্গে বলি কী করে। মঞ্জু আমার জানালায় সাদা জ্যোৎস্নায় এসে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যাবেই। স্ত্রীর এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। আমার নাকি এটা একটা রোগ। একা একা আমার নাকি কথা বলার অভ্যাস।
কার সঙ্গে বলি সে কিছুতেই জানতে পারেনি। আসলে নিভৃতে থাকলেই, মঞ্জু আর আমি সেই জ্যোস্নার মাঠে চলে যাই। যেখানে আমরা এক রূপকথার জগৎ রেখে চলে এসেছি। মঞ্জুর মা, লাল রঙের ঘোড়া, ইমতাজ আলি সেই রূপকথার মানুষ হয়ে গেছে। মঞ্জু মাঝে মাঝে বলে, আমরা কি ছেলেমানুষ ছিলাম, না।
এসব কারণে মঞ্জু কোথায় আছে জানার আমার কোন আগ্রহ জন্মাত না। একবার শুনেছিলাম, মঞ্জকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুক্তি যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনারা নাকি তাকে মেরে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। তবে মঞ্জু যেখানেই থাক, মাঝে মাঝে আমার জানালায় আসবেই।
কখনও কোন রাতে দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনতে পাই। আমি দরজা খুলে বাইরে চলে আসি। বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। ঘাসের ওপর সাদা জ্যোস্নার আমি দাঁড়িয়ে থাকি। মঞ্জু দাঁড়িয়ে থাকে। মঞ্জুর ঐ এক কথা – দেখতে পাচ্ছিস! আমার মা। আমাদের লাল রঙের ঘোড়া। ইমতাজ আলি ঘোড়াটার জন্য ঘাস কাটছে। ঘোর কেটে গেলে ফিরে আসি। স্ত্রী আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। সে জানে আমি ফিরবই। আসলে মানুষ রহস্যময় পৃথিবীতে সব সময় বেঁচে থাকতে চায়। আমিও তাই আছি। জানি না, এ সত্যি ঘোরে পড়ে দেখি, না তারা আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে দূরাতীত গ্রহ থেকে দেখা করার জন্য নেমে আসে। ঠিক বেঠিক বুঝি না।
(সমাপ্ত)