ভূমিকা —
বাবার বদলির চাকরির সুবাদে বাবা আর মা ঘুরে বেরিয়েছে জেলা থেকে জেলায় কিন্তু আমার তখন তেমন ঘোরা হয়নি । পড়া লেখার ক্ষতি হবে এই আশংকায় রেখে গেছে নানু বাড়িতে। এছাড়া বাল্যকালে আমার পরম মিত্র ও আমাকে শান্ত শিষ্ট বলে কখনও প্রশংসা করেনি,ফলে আমার মায়ের পক্ষে আমাকে সামলানো কিছুটা কঠিন ছিল । ঢাকার বকশি বাজারে আমার নানুর বাড়ি । পুরানো আমলের বিশাল এল প্যাটার্নের বাড়িতে সারাটা দিন হেসে খেলে আনন্দেই কাটতো কিন্তু সন্ধ্যা হবার সাথে সাথেই মনটা হালকা হালকা খারাপ হওয়া শুরু করত। মাঝে মাঝে অনেক কান্না পেত । তখন আমার খালামনি নানুকে ইশারা করত এই বলে যে ফ্লাড ইজ কামিং ,আর নানু তখন কাছে ডেকে নিয়ে কতশত গল্পই না করত । গল্প শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই চলে যেতাম ঘুমের রাজ্যে ।
নানুর কাছে শোনা অনেক গল্পই আমার আজ মনে নেই ,এসব গল্পের অনেকগুলাই পরে আমি বিভিন্ন বইতে পড়েছি কিন্তু কিছু গল্প আমি কোথাও খুজে পাইনি ।হয়ত এই গল্প গুলো মুখে মুখেই প্রচলিত কিংবা অনেকেই জানে বা বইতে পড়েছে ।
পরবর্তীতে আমি আমার অনেক বিদেশি বন্ধুর কাছেও এমন কিছু গল্প মানে রূপকথা বা লোককথা শুনেছি যা মানুষের মুখে মুখেই প্রচার লাভ করেছে । তেমন কিছু গল্পই আজ আমি সবার সাথে শেয়ার করতে চাই যার অনেকটাই হয়ত অনেকে জানে , আবার কিছু অজানা ।
বেনে বউ এর কথা (নানুর কাছে শোনা )
সে অনেক কাল আগের কথা । এদেশের কোন এক গ্রামে বাস করত এক বেনে বা বণিক পরিবার । বাবা,মা আর ছেলে ও তার বউ নিয়ে ছোট্ট সংসার । বুড়ো বেনের মত তার ছেলেও ছিল অনেক ভাল বণিক । গ্রামের মাঝে বেশ ধনী ছিল তারা। সারা বছর বাবা আর ছেলে মিলে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াত ব্যাবসার কাজে ।বাড়িতে থাকত বুড়ি শাশুড়ি আর ছেলে বউ ।
বউটি ছিল দারুন রূপবতী আর গুণী মেয়ে । বাড়ির সব কাজ কর্ম সে একাই সামলাত । হলুদ পেষা , তরকারি কাটা্, ভাত রান্না সকল কাজ সে একাই করত ।বউটির শাশুড়ি কিন্তু অত্যাচারী ছিল না , সংসারেও ছিল না অভাব তারপরেও বেনে বউ এর মনে ছিল না কোন সুখ । প্রতিদিন সে এক আজব সমস্যার মুখমুখি হত । আগেই বলেছি বেনে পরিবারটি ছিল বেশ ধনী তাই সারা বছর তাদের বাড়িতে ছিল ইষ্টি কুটুমদের আনাগোনা ।
বলা নেই কওয়া নেই হঠাত মেহমান এসে হাজির । ফলে দেখা যেত নিজের পাতের ভাত কুটুমদের খাওয়াতে হচ্ছে । শাশুড়ি তো বুড়ি তাই বেনে বউকেই দিয়ে দিত হত মুখের গ্রাস। ফলে আধপেটা বা অভুক্ত অবস্থায় কাটত তার দিন । এভাবে দিনের পর দিন কাটতে লাগলো ।
এরপর সে একদিন তার শাশুড়ির কাছে বলল এই সমস্যার কথা । বউ এর কথা শুনে শাশুড়ি বলল ধুর বোকা এটা কোন সমস্যা হল? কাল থেকে তুমি ভাত একটু বেশি রাধবে । একথা শুনে বউটি ভীষণ খুশি হল ।
পরদিন সে খুব ভাল করে রাধল মাছের ঝোল , ভাবল আজ ভাত রেঁধেছি বেশি তাই পেট পুরে খাব। আরশিতে নিজেকে দেখে সে নিজেই অবাক হয়ে গেল ।মনে মনে ভাবল ঠিক মত না খাওয়ার জন্য সে কেমন লাবণ্য হীন হয়ে গেছে । বেনে বউ ঠিক করল আজ সে কাঁচা হলুদ মেখে ভাল করে পুকুরে গিয়ে গোসল করবে ,তারপর খেতে বসবে । রান্না বান্না শেষ করে যেই সে গোসলে যাবে অমনি এক দল কুটুম এসে হাজির।
ওমা একি!! সে দেখল আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি কুটুম / মেহমান এসেছে। সবাই যখন খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিদায় নিল সে হাঁড়িতে উকি দিয়ে দেখে মাত্র কয়েকদানা ভাত পড়ে আছে । তারমানে আজও তাকে অভুক্ত থাকতে হবে । বউটি মনের দুঃখে গাছ তলায় বসে অনেকক্ষণ কাঁদল । কুটুমের জ্বালা আর তার সহ্য হচ্ছিল না । এরপর সে করল কি পুকুরে গিয়ে পাড়ে বসে সারা গায়ে হলুদ মাখল আর তারপর কালি মাখা খালি ভাতের হাঁড়ি মাথায় ভেঙ্গে পুকুরে ঝাপ দিল । গাঁয়ের বউ ঝি রা হই হই করে ধরার আগেই সে তলিয়ে গেল।
কই যে তলিয়ে গেল তার আর হদিস পাওয়া গেল না ।তারপর ঘটল এক আজব ঘটনা সবাই দেখল পুকুরের মাঝ থেকে এক মিষ্টি সুন্দর পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে এসে গাছের ডালে বসল । পাখিটির সারা অঙ্গ হলুদ আর মাথাটা কাল । কারো আর বুঝতে বাকি রইল না এই সে বেনে বউ যে কিনা সারা গায়ে হলুদ মেখে মাথায় কালি মাখা খালি ভাতের হাঁড়ি ভেঙ্গে পুকুরে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে ।
আজও আমাদের দেশে দেখা যায় এই পাখি যার নাম বেনে বউ । যে বাড়িতে এই পাখি এসে বসে সেই বাড়িতে কুটুম আসা নিশ্চিত তাই অনেকে একে বলে কুটুম পাখি ,আবার গায়ের রঙ এর জন্য কেউ কেউ হলদে পাখি বলে ।
গাছের ডালে ডালে বসে সে এক সুরে বলে চলেছে ,”কুটুম আসুক কুটুম আসুক ”