”মুনাই স্কুলে গিয়ে সোনা মেয়ে হয়ে থাকবে।একদম গেটের বাইরে বেরোবে না।কারো থেকে কিছু খাবে না।কেউ যদি লজেন্স, ক্যাডবেরীও দেয় তার কাছেও যাবে না।”
আরও অনেক সাবধান বাণী বলতে-বলতে আদরের মুনাইকে অনেক চুমুতে ভরিয়ে দেয় সুচরিতা।সুচরিতা আর নালকের একমাত্র মেয়ে নদী।আজ ও প্রথম বড় স্কুলে যাবে।ক্লাস ওয়ান।সুচরিতারও মেয়ের সাথে যাবার খুব ইচ্ছে ছিল।কিন্তু নানারকম টেনশান করে সকাল থেকে ওর মাথাটা খুব ঘুরছে।তাই নালকের সাথে নদী ট্যাক্সি করে চলে গেল।
সুচরিতা আদর করে নদীকে মুনাই বলে ডাকে।এই মুনাইকে নিয়ে সুচরিতার উদ্ভট সব দুশ্চিন্তার শেষ নেই।সুচরিতার মা মণিদীপা বলে-
”আমরা ছোটবেলায় এতজন ভাইবোন বড় হয়েছি মানুষ হয়েছি।আমাদের মা কখনও এরকম করেনি।তোরা আজকালকার মায়েরা নানারকম বলে-বলে বাচ্ছা-কাচ্ছাকে ভীতু তৈরী করে দিস।”
সুচরিতা কিছু বলে না।কিন্তু তার চিন্তা থেমেও থাকে না।মেয়ে খেল কিনা,জল খেল কিনা,পড়ে গেল কিনা,কেউ ভয় দেখিয়ে মেয়েকে কোথাও নিয়ে গেল কিনা এইসব নিত্যনতুন ভাবনারা তার স্বপ্নের আর বাস্তবের উপজীব্য বিষয় ।
মুনাই মানে নদী মায়ের অন্ধ ভক্ত।কেউ কোনোকিছু দিতে চাইলে,কেউ আদর করে কাছে ডাকলে ও যেতে চায় না মোটে।তবে লজেন্সওয়ালা দেখে তার যে কি ভয় কে জানে।ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।এখন নদী অনেকটা বড় হয়ে গেছে।এখন ওর ক্লাস ফোর।মাঝে-মাঝেই হঠাৎ করে নদীর সেই ছোটবেলাকার কথা, স্কুল যাওয়ার কথা, রোজির কথা মনে পড়ে।মন খারাপ হয়। লজেন্সওয়ালাকে দেখে ভয় তার এখনও যায়নি।
রাতে প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখে নদী।এক কাঁধে লম্বা ঝোলামত একটা ব্যাগ,হাতে রঙবেরঙের লজেন্সের শিশি,সাদা শার্ট,ঢোলা সাদা প্যান্টে ইন করে গোঁজা একটা লজেন্সওয়ালার স্বপ্ন।প্রথম-প্রথম মুখটা দেখতে পেত না।কিন্তু এখন মুখটা স্পষ্ট দেখতে পায়।চোখে এক হৃদয়ভেদী দৃষ্টি।একমাথা খোঁচা-খোঁচা সাদা চুল।নদীর কানের কাছে এসে বলে-
”দিদিমণি ও দিদিমণি লজেন্স নেবে দুটো।খাওনা।তোমাকে পয়সা দিতে হবে না।”
কিন্তু নদী কিছুতেই লজেন্স নেবে না।স্বপ্নের ভেতরেই লজেন্সওয়ালাকে দেখে বিড়্ বিড়্ করে কি সব বলে সে, কাঁদে।সুচরিতা ধড়ফড় করে ওঠে-
”বাবু কি হয়েছে?স্বপ্ন দেখেছো? সোনা জল খাবে?”
বলে তাকে উঠিয়ে দেয়।জল খাওয়াও আবার ঘুম পাড়ায় কোলের কাছে নিয়ে।এই লজেন্সওয়ালার চেহারাটা নদীর মনে এমনভাবে আঁকা হয়ে গেছে যে একবার দেখলেই চিনতে পেরে যাবে।তার মুখে কেমন একটা মিটি-মিটি হাসি।ওকে স্বপ্নে দেখলেই নদীর গায়ের ভেতরটা কেমন শির্ শির্ করে।মনে হয় ঐ লজেন্সওয়ালা তাকে কোথাও একটা ধরে নিয়ে যাবে।তার মায়ের থেকে অনেক দূরে।যেখান থেকে তার মায়ের কাছে আর ফিরে আসতে পারবে না নদী।আজ চার বছর হয়ে গেল। নদীর মন থেকে তবু এই আতঙ্ক গেল না।
সত্যি কত লজেন্সওয়ালাই তো রাস্তায়-ঘাটে,বাসে-ট্রামে ঘুরে বেড়ায়।কিন্তু স্বপ্নের ঐ লোকটার মত কাউকে আর দেখতে পায় না তো সেই সেদিনের পর থেকে- তাই ঐ কচি মনে বসে যাওয়া আশঙ্কাটা মাঝে-মাঝেই ওকে কুরে-কুরে খায়।বন্ধুরা এই নিয়ে কত হাসাহাসি করে।তাতে কি?ভয় তো ভয়ই।
সুচরিতা নদীকে কতবার কতভাবে জিজ্ঞেস করেছে-
”মুনাই কোনো লজেন্সওয়ালা তোমায় কি কিছু বলেছে?তোমায় ভয় দেখিয়েছে?তুমি কেন এত ভয় পাও সোনা লজেন্সওয়ালাকে দেখে?”
কিন্তু নদী কোনো উত্তর দেয়না ফ্যাল ফ্যাল করে মায়ের মুখের দিকে তাকায়।এর মধ্যে একদিন ওদের ক্লাসে গুড টাচ আর ব্যাড টাচ নিয়ে প্রিয়া আন্টি ওদের অনেক কিছু বোঝালো, আর বলল – শোনো বাচ্ছারা, মা হল আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু।মায়ের কাছে কোনো কথা লুকোতে নেই। প্রিয়া আন্টি নদীর সবচেয়ে ফেবারিট আন্টি।প্রিয়া আন্টি কোনো কাজ বললে সে কাজ নদী করবেই।তাই সেদিন নদী স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে মায়ের কাছে হঠাৎ বলল-
”রোজির খুব কষ্ট হয়েছে মাম্মা। রোজি কাঁদছিল।লজেন্সকাকুটা খুব দুষ্টু।”
সুচরিতার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল।কি বলছে মুনাই এইসব?রোজি তো মুনাইয়ের সেই ছোট্টবেলার বন্ধু।কি হয়েছে রোজির?কিন্তু না মুনাই আর কিছুই বলে না।সেদিনকার মত চুপ করে যায়।রাতে মুনাইয়ের ধূম জ্বর।কদিন ধরে জ্বর ছাড়ে না।ডাক্তার ওষুধ।দশদিন বাদে জ্বর কমল তো পেটে ব্যথা।পেটে ব্যথা কিছুতেই কমে না।নদী কিছু খায় না,স্কুল যেতে চায় না একদম।সুচরিতা আর নালক পড়ল মহা দুশ্চিন্তায়।
ডাক্তার অনেক পরীক্ষা করে বলল নদীর একটা মেন্টাল ডিপ্রেশন হয়েছে।কি কারণে এমন হয়েছে সেটা জানা না গেলে এই শরীর খারাপ আর মন খারাপ ঠিক হবে না।সুচরিতার কলেজের বান্ধবী মধুমিতা রায় একজন বড় সাইকোলজিস্ট।তার কাছে নালক আর সুচরিতা নদীকে নিয়ে গেল।কাউন্সেলিং এর এক বিরাট পর্বের পর নদী যা বলল তা এইরকম-
”রোজি আমার ছোট্টবেলার প্রিয় বন্ধু।টিফিনের সময় আমরা একসাথে টিফিন খাই খেলা করি।প্রতিদিনই কিছুক্ষণ খেলা করার পর রোজিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।কে একটা লজেন্সকাকু রোজ টিফিনের সময় ওকে এত্ত এত্ত লজেন্স দেয়।আয়া-মাসীর সাথে গেটের কাছে গিয়ে রোজি লজেন্স নেয়।তারপর টিফিন শেষ হয়ে যায়।টিফিনের পরের ক্লাসগুলো রোজি কেমন ঝিমিয়ে থাকে।পড়া বলে না,ড্রইং করে না।আন্টিরা ওকে বকে।একদিন আমি,রোদ্দুর আর বর্ষা মিলে রোজির পিছন-পিছন লজেন্সকাকুটাকে দেখতে গেলাম।এ কেমন লজেন্সকাকু যে খালি রোজিকেই লজেন্স দেয়।সেইদিনই ঐ ঢোলা জামা-প্যান্ট পরা লোকটাকে একঝলক দেখলাম আমরা।আয়ামাসী এদিক-ওদিক তাকিয়ে লজেন্সকাকুটাকে স্কুলের ভেতর ঢুকিয়ে নিল।কেউ দেখলে তো পানিশমেন্ট হবে।লজেন্সকাকু রোজিকে নিয়ে বিরাট প্লে গ্রাউন্ডটার পিছনের প্যাসেজটাতে চলে গেল।আমরাও পিছন পিছন গেলাম চুপি-চুপি।রোজি খুব কাঁদছিল বলছিল আমি যাব না।আমাকে ছেড়ে দাও।আমি লজেন্স খাব না।কিন্তু লজেন্সকাকুটা রোজির মুখে জোর করে লজেন্স ভরে দিচ্ছিল।রোজি খেয়ে নিচ্ছিল ভয়ে-ভয়ে।কিছুক্ষণ বাদে ও ঝিমিয়ে পড়ল।তখন ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডা।দুষ্টু লোকটা রোজির সোয়েটার,টুপি,মোজা,জামা সব খুলে দিল।রোজি শীতে কাঁপছিল।মাঝে-মাঝে জল- জল বলছিল।দুষ্টু লোকটা রোজিকে নিয়ে কি করছিল বুঝতে পারিনি।আয়া মাসী খালি এদিক ওদিক দেখছিল আর বলছিল তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি বেল বেজে যাবে।আমরা দেওয়ালের আড়ালে ছিলাম কেউ আমাদের দেখতে পায়নি।তারপর রোজি অনেকদিন স্কুলে আসেনি।এরপর রোজি এই স্কুল ছেড়ে দেয়।আয়ামাসীকে পুলিশকাকু ধরে নিয়ে যায়।রোদ্দুর আর বর্ষাকে পুলিশকাকু কত কি জিজ্ঞেস করে।আমাকেও করেছিল কিন্তু আমি কিছু বলিনি।আন্টিরা বাইরে কাউকে কাউকে কিছু বলতে বারণ করল।ঐ দুষ্টু লজেন্সকাকুর জন্য আমার বেস্ট ফ্রেন্ডটা হারিয়ে গেল।”
বলে নদী প্রচন্ড কাঁদতে লাগল।মধুমিতা রায় সব শুনে বলল মলেস্ট করার দৃশ্য শিশুমনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।স্পষ্ট করে ও ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি তাই বোঝাতেও পারছে না।কিন্তু ঐ একই দৃশ্য বার-বার ওর চোখের সামনে, স্বপ্নে,ঘুরে ফিরে আসছে।তার থেকেই সমস্যা। নানাভাবে শরীর অসুস্থ হচ্ছে।তাই লজেন্সওয়ালা দেখে এত ভয় ওর।জোর করে ওর এই ভয় যাবে না।ওকে নানারকম ক্রিয়েটিভিটির ভেতর রাখতে হবে।যাতে ওর মনটা সবসময় আনন্দে থাকে।আর কোনোভাবেই যাতে ও ভয় না পায়,সেদিকেও নজর দিতে হবে।কেননা এই ভীতি নদীর ভবিষ্যত জীবনে বড় রকম প্রভাব ফেলতে পারে।
এরপর আস্তে-আস্তে অনেকগুলো বছর কেটে যায়।নদী এখন ক্লাস টেনে পড়ে।টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে।সুচরিতা মেয়েকে খুব চোখে-চোখে রাখে।রোজির ঘটনা ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।সব মায়েদেরই এর থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।দিনকাল খুব খারাপ।যা চলছে চারিদিকে!তবে লজেন্সওয়ালার স্বপ্ন নদী এখনও দেখে।রোজির কথা আর বলে না নদী।আগে রোজির জন্য কাঁদতো।মন খারাপ করে বসে থাকত।রোজির দেওয়া পুরোনো গিফ্ট, কার্ড,খেলনা সব এখনও ওর কাছে যত্ন করে রাখা।কিন্তু ওর সাথে আর যোগাযোগ নেই।
সেদিন ছিল একটা বৃষ্টিমুখর দিন।স্কুলে আর ক্লাস নেই এখন।দুদিন বাদ মাধ্যমিক।গ্রুপ স্টাডির নাম করে গুটিকয়েক বন্ধু মিলে রঞ্জনার বাড়ী বসে জমিয়ে আড্ডা চলছে।প্রায় সন্ধ্যে হব হব।সব বন্ধুরা মিলে এইবার বাড়ী ফিরতেই হবে।ভিজলেও কিছু করার নেই।মায়েরা চিন্তা করছে।রঞ্জনার বাড়ীর গেট দিয়ে বেরিয়ে ছাতা মাথায় বৃষ্টির ছাঁটে ভিজতে-ভিজতে বড় রাস্তায় এসে সবাই দেখল বিরাট একটা জটলা।কে একটা ফেরিওয়ালাকে নাকি বাসে ধাক্কা মেরেছে।
বন্ধুরা সবাই ভিড় ঠেলে দেখতে গেল।নদীর যাবার ইচ্ছে ছিল না।ওর এইসব ভাল লাগে না।কিন্তু সকলে গেল যখন চোখ তো পড়েই যায়।রাস্তায় পড়ে থাকা ফেরিওয়ালাটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল নদী।সাদা ঢোলা প্যান্ট,সাদা শার্ট,খোঁচা-খোঁচা সাদা চুল,চোখ দুটো খোলা, সেই অদ্ভূত হৃদয় কাঁপানো দৃষ্টি-হুবহু।হাত থেকে ছিটকে পড়েছে লজেন্সের শিশি,পাশে পড়ে ঝোলা ব্যাগটা। রঙীন লজেন্সগুলো রক্তে ভিজে গেছে।চারিদিকে চাপ-চাপ রক্ত!বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল নদীর।ঠিক দেখছে তো ?এইটাই কি স্বপ্ন নাকি এইটাই সত্যি?এমনও হয় নাকি?কে জানে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে।এই তো সেই লজেন্সওয়ালা!যে তার প্রিয় প্রাণের বন্ধুটাকে কোথায় হারিয়ে দিয়েছে।তারপর থেকে রোজ নদী ভগবানকে বলেছে,যে এমন খারাপ লোক সে যেন শাস্তি পায়।ভগবান ওর কথা শুনেছে।একটা চাপা আনন্দে ভরে যায় ওর মন- প্রাণ।স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে।কারো মৃত্যু এত আনন্দ দেয় জানা ছিল তো না নদীর-
এই দিনের পর থেকে নদী আর কোনোদিন লজেন্সওয়ালার স্বপ্ন দেখেনি-।