গিরিখাতের অতলে

গিরিখাতের অতলে

বিরাট বড় বাড়ীটা।বাগান,ছাদ,লম্বা টানা সাদা-কালো মার্বেলের বারান্দা।বারান্দার দুপাশে দুটো বিশাল আয়না।আয়নার দুপাশে ফুলদানি।বাড়ীতে ঢোকার বড় লাল লোহার গেট।গেট দিয়ে ঢুকেই ফোয়ারা,বেশ কয়েকটা শ্বেতপাথরের নগ্নিকার মূর্তি।সবুজ ঘাস মাড়িয়ে কিছুটা গেলেই বাড়ীতে ঢোকার দুনম্বর দরজা দিয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়িটা দেখা যায়।একপাশে চওড়া গ্যারেজে চার পাঁচটা হাল ফ্যাশানের গাড়ী।এত বৈভবের ভেতর কেবল একলা সাদা-কালো লম্বা বারান্দার একাকীত্ব যেন প্রতিফলিত হয় দুদিকের দেওয়ালে টাঙ্গানো আয়নায়।ফোয়ারার জলগুলো কান্নার মত উপচে পড়ে বাঁধানো বেদীটার চারদিকে।আকাশের চাঁদ নীরবে চেয়ে দেখে সব।তারাদের মত নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়া জল চিক চিক করে।সায়নীর একাকীত্ব আর কান্নার সাথে এরা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

মিত্র বাড়ীর একমাত্র ছেলে সৌরভ মিত্র।তারই অনুপযুক্ত বৌ সায়নী।উপযুক্ত হয়ে ওঠার পরীক্ষায় সে আগাগোড়া ফেল।সৌরভের দিদি স্বাগতা বড়।তার বিয়ে হয়ে গেছে বহুবছর আগে।সে থাকে আমেরিকায়।ওর স্বামী স্বর্ণাভ বোস সেখানকার বাসিন্দা।সৌরভের বাবা মা অন্য আর একটা বাড়ীতে থাকেন।এদের অনেক বাড়ী।বৌ কে ছেলের সাথে আলাদা ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী এনারা।তবে মাঝে-মাঝে মা-বাবা এসে ছেলের কাছে থাকেন দুজনে।আবার মাঝে-মাঝে চলে যান মেয়ে স্বাগতার কাছে কয়েকমাসের জন্য।মেয়ে-জামাই খুবই ব্যস্ত, তবু মা-বাবা এলে সব কিছু আগলাবার একটু সুবিধে হয়।আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় একেবারে সুখী পরিবার।কিন্তু সুখ পাখীকে ধরা যায়না।সে বড় চঞ্চল।কোথায় যে উড়ে যায় কে জানে!শুধু নীল আকাশে উড়তে থাকা সুখ পাখীটার দিকে তাকিয়ে থাকতে- থাকতে চোখ জ্বালা করে সায়নীর।

সৌরভ মিত্র বড় ফিল্ম ডিরেক্টর।তাই পরিবারের জন্য সময়ের তার বড় অভাব।অবশ্য নিজের যখন ইচ্ছে হয় তখন ঠিক সময় বার করতে পারে সৌরভ।ক্লাব, পার্টি, বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে আড্ডা,নতুন নায়িকাদের সাথে লং ড্রাইভ,আউটিং,প্রায়শই শুটিং এর জন্য কদিনের জন্য বাইরে চলে যাওয়া।এইসবেরই অফুরন্ত সময় তার হাতে।সময় নেই শুধু সায়নীর বেলা।তবে সায়নী আদর আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখে না শ্বশুর শাশুড়ীর।সৌরভের মতে অবশ্য সায়নী একটা বোগাস, কোনো কাজই ঠিকমত পারেনা। না সংসারের কাজ না বাইরের কাজ।ওর অবস্থা নাকি না ঘরকা না ঘাটকা। গান জানলেও সৌরভের মনের মত গান কোনোদিনই গাইতে পারেনি সায়নী।যেমন হোটেল- বারের গায়িকারা গায়।লাস্যময়ী, উচ্ছ্বল যৌবনা, স্বল্প বাস পরিহিতা ঐ সব মেয়েদের দেখেই একমাত্র উত্তেজনা জাগে সৌরভের।তাই তার কাছে –

”এই মালটা’নেহাৎ ম্যাদামার্কা।আমার বাপ শালা জীবনটাই বরবাদ করে দিল।এই বোঝাটাকে ঘাড়ে চাপিয়ে।”

এইকথাগুলো প্রতিদিনের খুব স্বাভাবিক কনভারসেশান সৌরভ আর সায়নীর।ছোট থেকেই মা-বাপ হারা সায়নী।মামার সংসারে মানুষ হলেও মামা- মামী তাকে মেয়ের চেয়ে অধিক ভালবাসায় মানুষ করেছিলেন।হয়তো তাদের অর্থ কম ছিল, কিন্তু ভালবাসা কম ছিল না।লেখাপড়াও কম শেখেনি সায়নী।সায়নী গ্র্যাজুয়েট।তবে তার নিরীহ স্বভাবের জন্য কোথাও চাকরি করতে দেননি ওর মামা।বরাবর বলেছেন-

”তুই চাকরির জায়গায় মানাতে পারবি না মা।কোথায় কি বিপদে পড়বি!”

এখন সায়নী ভাবে বিয়ে করে যা বিপদে পড়েছে তার থেকে চাকরির বিপদ অনেক ভাল ছিল।সায়নীর কোনো কিছুর অভাব নেই।না খাওয়া পরা, না টাকা পয়সা।অভাব শুধু স্বামীর ভালবাসা আর একটা সন্তানের।একটা বাচ্ছা থাকলেও তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায়।ভগবান সে সুখটাও তাকে দিলেন না। অথচ সায়নী সুন্দরী, শিক্ষিতা গৃহকর্মনিপুণা,গান জানে।সর্বোপরি বিনয়ী আর অসীম সহ্য ক্ষমতার অধিকারিনী।একটা আইডিয়াল বৌ হতে গেলে যা যা গুণ থাকা দরকার সবই তো তার আছে।তবু সৌরভের থেকে গুরুত্ব আর ভালবাসা পেলোনা সে।কেন সৌরভ সায়নীর থেকে মুখ ফেরাল?এই প্রশ্নটা উঠতেই পারে।এর কোনো উত্তর নেই।এইটাই সৌরভের পুরুষোচিত স্বভাব।সায়নীর এই ভালোমানুষী ইমেজটাই নাকি সৌরভের অসহ্য লাগে।তার আটপৌরে সাজ-গোজ, অতি বিনয়, আদর্শ বৌ হওয়ার লাগাতার প্রচেষ্টা, সব কিছুই অসহ্য সৌরভের কাছে।

”একই মাল নিয়ে বেশীদিন আদিখ্যেতা চলে না মাইরি।ঘরের মাল নিয়ে মা-বাবা থাকুক আমার একটু চিকনী-চামেলী না হলে জমে না গুরু।”

বন্ধু -বান্ধবের কাছে এইরকম কথা বলে থাকে সৌরভ মিত্র।প্রথম-প্রথম সায়নী ভাবত একজন শিক্ষিত মানুষের মুখে এইরকম ভাষা হয়?তারপর বুঝেছে সবই হয়।এখন সবই গা সওয়া হয়ে গেছে ওর।সুন্দরী মেয়েরা কেউ বাদ যায় না সৌরভ মিত্রের নজর থেকে।প্রথম-প্রথম অনেক কান্নাকাটি মান অভিমান করেছে সায়নী।কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।মেয়েরা তো ফার্নিচারের মত।পুরোনো হলেই বদলে ফেলতে হয়।বদলে ফেলা না গেলেও জঞ্জালের মত ফেলে রাখলেও চলে।

ইদানীং চান্দ্রেয়ী সেন বলে একটি মেয়ের সাথে সৌরভের সম্পর্ক নিয়ে খুব কানাঘুষো চলছে।সায়নী এইসব খবরে খুব রিঅ্যাক্ট করে তাই এ বাড়ীতে খবরের কাগজ আসা বন্ধ।টিভি চালানোও বারণ সায়নীর।কিন্তু খবর কি আর চাপা থাকে?বিশেষত এইসব খবর।এই খবর গুলো হাওয়ায় ওড়ে।আজকাল সারাদিন সায়নীর কি রকম পাগল পাগল লাগে।মনে-মনে ও ভাবতে থাকে-

”আচ্ছা আমাকে সৌরভ বিয়ে করল কেন?মামাকে তো বলতেই পারতো আমাকে সৌরভের পছন্দ নয়!এইটাই কিছুতে ভেবে পাইনা আমি!মামা-মামী কেমন আমাকে ফেলে উড়ো পাখীর মত কোথায় হারিয়ে গেল।আমাকে একলা ফেলে কোথায় গেলে গো তোমরা?”

চোখের জল উপচে পড়ে সায়নীর।কোথাও একটা যাওয়ার জায়গা থাকলে ঠিক পালিয়ে যেত সায়নী এই বন্দী জীবন ছেড়ে।আজকাল লোকজন এটাও বলাবলি শুরু করেছে চান্দ্রেয়ী ম্যাডাম ছাড়া সৌরভ স্যার কোথাও যায় না।কোন সিনেমায় কাকে নেওয়া হবে,কত টাকার বাজেট আরও যাবতীয় সিদ্ধান্ত চান্দ্রেয়ী ম্যাডামই ঠিক করে।চান্দ্রেয়ীর জন্য একটা আলাদা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে সৌরভ মিত্র।কোনো প্রিমিয়ারে বা কোনো পার্টিতেই সৌরভের বৌ সায়নীকে দেখা যায় না একেবারে।কাগজ সিনেমার পত্রিকা সর্বত্র চান্দ্রেয়ী আর সৌরভের ছবিতে- ছবিতে ছয়লাপ।

এর কিছুদিন পর দক্ষিণ ভারতে একটা নতুন ছবির শুটিং করতে গিয়ে চান্দ্রেয়ী নিখোঁজ হল।জনপ্রিয় নায়িকা চান্দ্রেয়ী সেন নিখোঁজ।হৈ হৈ পড়ে গেল চারিদিকে।লোকে বলাবলি করতে লাগল চান্দ্রেয়ী নাকি সৌরভকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল।কিন্তু সৌরভ রাজী হয়নি।এই নিয়ে মনোমালিন্য চলছিল।আবার একথাও শোনা গেল অন্তঃসত্তা চান্দ্রেয়ীকে পাহাড়ের গভীর খাদে ঠেলে ফেলে দিয়েছে সৌরভ।বেশ কিছুদিন এই খবরটা নিয়ে কাটাছেঁড়া হল। তারপর যেমন হয়ে থাকে, তেমন এই কেসটাও ধামাচাপা পড়ে গেল।কাগজে খবর বেরোলো চান্দ্রেয়ী সেন মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে খোঁজ চলছে।

এরপর বছর দুয়েক কেটে গেছে।চান্দ্রেয়ীর ঘটনাটার পর সৌরভ মিত্রের বাজার একটু মন্দা চলছে।সময়টা খুব খারাপ।সৌরভকে নিয়ে নানা গসিপ।লোকের মুখে হাতচাপা দিতে সায়নীকে নিয়ে কদিনের জন্য দক্ষিণ ভারত গেল সৌরভ।ওখানে দক্ষিণ ভারতীয় একজন প্রোডিউসারের সাথে কথাবার্তা হবে।সেরকমই কথা আছে।ইদানীং সায়নী মানসিক অবসাদে ভুগছে।মেন্টাল রিলিফের জন্য কিছু ওষুধ খেতে হচ্ছে।কাউন্সেলিং চলছে।এতেও যদি ইমপ্রুফ না হয় তবে হয়তো শক দিতে হবে।এছাড়াও ঘুমের ওষুধও খাচ্ছে বেশ কিছু।এত কিছুর পরও নিত্য নতুন মেয়েদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলাটা বন্ধ হলনা সৌরভের।

এক একদিন রাতে ঘুমের ঘোরে-

”চান্দ্রেয়ী ছেড়ে দাও আমাকে আমি কিছু করিনি।”

বলে চিৎকার করে ওঠে সৌরভ।সায়নী জাগিয়ে দেয়।ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়।ছেঁড়া ঘুম আর জোড়া লাগে না।

”আহ্!ছাড়ো!”

বলে বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শোয় সৌরভ।একাকী বিষণ্ণ রাতে সায়নীর বালিশ ভিজে যায় অবসাদের কান্নায়।

কোদাইক্যানেলের খাড়াই রাস্তা দিয়ে ঘুরে-ঘুরে গাড়ীটা উঠছে।বেরোতে একটু দেরী হয়ে গেছে।পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি।ঝুপ্- ঝুপ্ করে ঠান্ডা নামছে।সরু সরু পাতার পাহাড়ী গাছগুলো আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে মেঘলা কুয়াশায়।জল ফুরিয়েছে।পাহাড়ের পাশে একটাই গুমটি মত দোকান পাওয়া গেল।সৌরভ গাড়ী থেকে নামল জলের বোতল কিনতে। কিন্তু দোকানী বলল সেখানে জলের বোতল শেষ হয়ে গেছে।এখন বাড়ী থেকে গিয়ে জল ভরে এনে দিতে সময় লাগবে একটু।ড্রাইভার সঙ্গে গেলে জল পাঠিয়ে দেবে।এখন দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।অন্ধকার হয়ে গেছে। ড্রাইভার বলল-

”পানি লে লিজিয়ে সাব।আভি থোরা দের লাগেগা।”

অগত্যা অপেক্ষা করতে লাগল সৌরভ।
পাহাড়ের একধার বরাবর গভীর খাদ নীচ পর্যন্ত চলে গেছে।হঠাৎ সৌরভের স্মৃতিপথে চলে এল চান্দ্রেয়ীর করুণ মুখটা।

”আমাকে বাঁচতে দাও সৌরভ।আমাকে মেরো না।আমার বাচ্ছাটা–আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে আর বিরক্ত করব না।খালি বাচ্ছার জন্য টাকাটা আমাকে দিও।বিয়েটা করলে আমি আলাদাই থাকব।তোমার পরিবারের ভেতর ঢুকব না।এই বাচ্ছাটা নষ্ট করতে পারব না আমি।সংসারটা চলে আমার রোজগারের ওপর।তুমি তো সবই জানো।সৌরভ তোমার জন্য আমি কি না করেছি!”

এই রাস্তা দিয়েই তো চান্দ্রেয়ীকে নিয়ে সেবার—।চান্দ্রেয়ীর চাপা কান্নার আওয়াজ এখনও ঘুমের ভেতর শুনতে পায় সে।বড্ড অবাধ্য আর অবুঝ ছিল চান্দ্রেয়ী।নেশার ঘোরে একটা ভুলের মাশুল দিতে ওকে বিয়ে করা তো সম্ভব ছিল না সৌরভের পক্ষে।আর বাচ্ছাটা রাখার রিস্ক কি করে নিত ও? সেই কারণেই কথাকাটাকাটি করতে করতে—ঠিক এইখানেই—উফ্!কিছুতেই ভুলতে পারে না সৌরভ।

অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।ড্রাইভার গেছে দোকানীর সাথে জল আনতে।নিস্তব্ধ অন্ধকার মনে হচ্ছে একটু-একটু করে গ্রাস করে নেবে সবকিছু।বিশাল পর্বতশ্রেণী যেন বুকের ওপর চেপে বসতে চাইছে সৌরভের।হঠাৎ গাড়ীর দিকে চোখ পড়তেই সৌরভ দেখল গাড়ীতে সায়নী নেই।

”কোথায় গেলে সায়নী!সায়নী!”

সৌরভ ডাকতে লাগল-

”না কোথাও তো নেই।এই অন্ধকারে পাহাড়ী রাস্তায় কোথায় গেল?ড্রাইভারটাও আসছে না।কোথায় যে গেল জল আনতে।বড় তেষ্টা পেয়েছে।গাড়ীতে একফোঁটা জল নেই।সায়নী কোথায় তুমি?”

”এই তো আমি দেখ এই দিকে!”

মুখ ঘুরিয়ে দেখল সৌরভ দূর থেকে একটা গাড়ী হেডলাইটের তীব্র আলোয় ঝলসে দিয়ে মিলিয়ে গেল পাহাড়ী বাঁকে।সেই আলোর ঝলকে দেখল গাছের সারির আড়াল থেকে সায়নী এগিয়ে আসছে ওরই দিকে।আলু থালু চুল,বিস্ফারিত চোখে প্রতিহিংসা ঝরে পড়ছে যেন।মনে হচ্ছে চোখ দুটো থেকে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে।

”ওকি! কে ও ?ওকি সায়নী নাকি চান্দ্রেয়ী?এইভাবে এগিয়ে আসছে কেন আমার দিকে?কি চায় ও?দম টা বন্ধ হয়ে আসছে কেন আমার?”

এক পা এক পা করে পেছোতে-পেছোতে সৌরভ চলে এসেছে গভীর খাদের ধারে।মনে হল কে যেন জোরে ধাক্কা দিয়ে সৌরভকে অতল খাদে ঠেলে ফেলে দিল।বিরাট পর্বতশ্রেণীর গায়ে কোন অশরীরী আত্মার অট্টহাসি তখন আছড়ে পড়ছে।সকালে পাহাড়ী লোকজন সায়নীকে অজ্ঞান অবস্থায় গাড়ীর সামনে থেকে উদ্ধার করল।সে সব কথা সায়নীর আর কিছু মনে নেই।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত