মিথির সাথে আমার সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে দু-একবার যে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত আসেনি তা অস্বীকার করছি না। ‘অন্তরঙ্গ’ শব্দের একঘেয়ে ব্যবচ্ছেদ না করে ব্যাপারটা একটু খোলামেলা ভাবে বলা যাক।
একবার ক্লাসরুমে বিরতির সময় মিথি ওর হাতে রাখা কাগজটা সিলিন্ডারাকৃতিতে ভাঁজ করে মাইক্রোফোন বানিয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে এনাউন্স করেছিলো, “এটেনশন প্লিজ, আমি চশমু রূপক কে এখানে আসার অনুরোধ করছি।”
অমন আকস্মিক অনুরোধে আমি খানিকটা হতবিহ্বল হয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। মিথি কালক্ষেপণ না করে ওর হাতের মোড়ানো কাগজটা মুখের কাছে এনে থেমে থেমে হেসে বলেছিলো, “সাইলেন্স প্লিজ! এখন…এই ক্লাসরুমে…রূপক আমাকে কিস্ করবে, তোরা চোখ বন্ধ কর্!”
সর্বসম্মুখে ক্লাসরুমে সেদিনের দাবীকৃত চুমুর কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে তা ঘটেছিলো সেদিন সন্ধ্যায়, টিএসসিতে। চুমু পরবর্তী সময়ে মিথি আমাকে হাত ধরে টেনে আরো কিছুটা নির্জনে নিয়ে অভিযোগের চাপা স্বরে বলেছিলো, “তুই এমন ক্যান রে রূপক? আমি জাস্ট ফান করছিলাম! সবকিছু এত সিরিয়াসলি নিস্ ক্যান?….কি! ক্লাসের ব্যাপারটা নিয়ে এখনো পড়ে আছিস?”
আমার নিরুত্তর থাকাতে সে আমার দু’হাতের কনুইয়ের দিকটা ধরে ঝাঁকিয়ে বলেছিলো, “কি হলো, আড়ালেই তো দিলাম। এখনো মন খারাপ করে থাকবি? হাসবি না?”
পৃথিবীতে পুরুষ জাত আর যাই উপেক্ষা করার সক্ষমতা রাখুক না কেন কোনো মেয়ের কিঞ্চিত ঊর্ধ্বমুখী কাকুতিমাখা গোলাকার শ্বেত দৃষ্টি উপেক্ষার সাধ্য তাদের নেই বলে আমি সেদিন হেসেছিলাম। মিথির চোখ সান্ধ্য আঁধারেও শুভ্রতায় জ্বলজ্বল করছিলো। ওর হাত দুটো সরিয়ে সামনে এগুতে এগুতে বলেছিলাম, “এমন ফাজলামো আর করবি না। ক্লাসের সবাই কি ভেবেছে, বল্ তো!”
মিথি আমার বাম হাত জড়িয়ে হাসতে হাসতে গদগদ ভাব এনে বলেছিলো, “ওলে ওলে বাবুটা! চল্, কফি খাওয়াবি।”
এ মুহূর্তে মিথি পুরোনো কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছে না। তাই পাঁচ বছর আগের পুরোনো কথা তোলাতে মিথি জোড়ালো ভাবে আপত্তি করলো। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে এই রেস্টুরেন্টেই আমি ওর ঠোঁটে লেগে থাকা আইসক্রিম হাত দিয়ে মুছে দেয়ার মতো ভান করে উঠে ঠোঁট এগিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে লিপস্টিক নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো বলে আমাকে ওর গোলাপী ছোট্ট পার্সটা ইয়ো ইয়ো বলের মতো ছুঁড়ে মারতে মারতে বলেছিলো, “হারামি, কুত্তা, তোর স্বভাব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!”
আমি এই চুমুর দিনের অন্য একটা কথা মিথিকে কিছুক্ষণ আগেও বললাম। কিন্তু সে অস্বীকার করে বললো, “পুরোনো কথা বাদ দাও, আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তারপর, বলো, কেনো ডেকেছো?”
আমি ওয়েটারকে খুঁজছি। নীল শার্টের সাথে কালো টাই পরা ওয়েটাররা খানিক আগেই ঘুরঘুর করছিলো, এখন নেই। চেয়ার সরিয়ে উঠতে গিয়ে মিথিকে বললাম, “কফিই শুধু? সাথে আর কি দিতে বলবো?”
মিথি ওর চিরচেনা ভঙ্গিমায় সামনে গড়িয়ে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো, “দেখো রূপক, আমি খেতে আসিনি। তুমি তোমার জন্য অর্ডার করো। আচ্ছা, কফি বলো।”
আমি থেমে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হেসে বললাম, “এখনো কফির নেশা ছাড়তে পারোনি দেখছি!”
মিথি কিছু বললোনা। ঈষৎ দুঃখ-বিরক্তিযুক্ত প্রচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে রেস্টুরেন্টের ডানপাশের পেইন্টেড দেয়ালের লাল হলুদ আর বটল্ গ্রীন রঙের বিচ্ছুরিত ছটায় তৈরী নানান শিল্পকর্ম দেখার ভান করছে। আমি পেয়িং কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওয়েটারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এখান থেকে মিথিকে দেখছি। মেয়েটা আরো অনেক সুন্দর হয়েছে। আগের সেই লিকলিকে শরীরে এখন একটু ওজন বেড়েছে বলে মনে হলো। টানটান ত্বকের প্রস্ফুটিত এই সৌন্দর্য্য অবলোকন নিবৃত্তিতে সামান্য হতাশাবোধ হলো। হায়, এই মিথির সাথে ইউনিভার্সিটি জীবনের বেশীরভাগ সময় যুগল হিসেবে কেটেছিলো! এই মিথিকে একসময় আমি কতো কাছ থেকে চিনতাম!
এখন সে সব অতীত; বর্তমান এই যে, মিথি স্কলারশীপ নিয়ে নিউজিল্যাণ্ডের একটা নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে। এইতো পরশুদিন তিন মাসের ছুটিতে দেশে এসেছে। প্রচণ্ড রকমের আত্মপ্রত্যয়ী এ মেয়েটার এক মুহূর্তের দৃঢ় সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের এই ভিন্ন পথ চলা! অবশ্য ওর কোনো দোষ ছিলো না। বলতে গেলে সম্পূর্ণ দোষ আমারই ছিলো।
মিথি আমাকে দূর থেকে ইশারায় ডাকলো। আমি কাছে যেতে কিছুটা মোলায়েম কণ্ঠে বললো, “ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো। আচ্ছা, তোমরা বিয়ে করেছো কতোদিন হলো?”
আমি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম, “ইরা’র ফ্যামিলির সাথে তোমার কোনো যোগাযোগ হয় না?
মিথি সামান্য বিস্ময় প্রকাশ করার মতো কপালে ভাঁজ় এনে বললো, “তোমার কি মনে হয়? অত কিছুর পরেও আমি তোমার বা ইরার সাথে যোগাযোগ রাখবো?”
আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে গ্লাসে ভাঁজ করে সাজিয়ে রাখা এক টুকরো টিস্যু নিয়ে ঠোঁট মুছলাম। ঠিকই তো! এত কিছুর পর আমার বা ইরার ফ্যামিলির সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখা সমীচীন না। আর কথা হবেই বা কেনো? যে কারণে দুই বান্ধবীর দীর্ঘদিনের অটুট সম্পর্ক চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো তার সবটাই তো আমি জানি।
আসলে, পুরোনো কথার জের ধরে ওদের নিগূঢ় সম্পর্কের একটা উদাহরণ দিলে গেলে এমনটা দেয়া যায় যে, মিথি একটা জামা পরেছিলো যার গলা একটু বড় হওয়ায় কাঁধের দুদিক দিয়ে অন্তর্বাসের ফিতাটা দেখা যাচ্ছিলো। আমি সেটার রঙ দেখেই চিনতে পেরেছিলাম অন্তর্বাসটা মিথির না। তবে যতটা না বিস্মিত হয়েছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশী বিস্ময় প্রকাশ করে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কিরে? কারটা পরছিস? দেখিতো!”
মিথি লাফ দিয়ে পেছনের দিকে সরে গিয়ে বলেছিলো, “রূপক! তোর নজর এতো খারাপ কেন? চোখ ঠিক কর, শয়তান একটা!”
আমি সামান্য হেসে কৌতুহলবশতঃ আহ্লাদি অনুনয় স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বলনা, এটা কার?”
তৎক্ষণাৎ চোখ বড় বড় করে ধমকের স্বরে মিথি বলেছিলো, “তুই জেনে কি করবি?”
বস্তুত, ছাত্রজীবনের ছেলেমানুষি কিছু ভাবনায় আমাদের দুজনের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়েছিলো। ব্যাপারটা এমন যে, আমি যদি একটা শার্ট কিনি সেদিন মিথিকেও একটা টি-শার্ট বা কামিজ কিনতে হবে। মিথি যদি একটা জুতা কেনে সেদিন আমাকেও একটা জুতা কিনতে হবে। আমি যদি আমার অভ্যন্তরীণ যে কোনো পোষাক কিনি মিথিও তার জন্য যে কোনো ধরণের অন্তর্বাস কিনবে। তাই আমাদের দুজনের প্রতিটা কাপড়ই দুজনের খুব চেনা ছিলো। সত্যি অর্থে সেই অচেনা হালকা বাদামী রঙা টুকরো কাপড়ের জন্য মনের ভেতর সেদিন অন্যরকম একটা অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিলো। একটা টুকরো কাপড়, একজন স্ত্রীবাচক নামের অন্য মানুষের একটা ভিন্ন অস্তিত্ব আমার মিথির শরীরে লেপ্টে থাকা দেখে চিন্তা বিভাজিত হয়ে গিয়েছিলো। অদ্ভুত এক অনুভূতির দ্বন্দ্বে আটকে পড়ে আর জানতে চাওয়া হয় নি সে অন্তর্বাসটি কার ছিলো!
পৃথিবীতে ব্যক্তিবিশেষে কিছু কিছু অবান্তর অনুভূতির উদয় হয়, যেখানে সবাই নিজেদের ভালোত্বকে সর্বসম্মুখে প্রকাশ করে অথচ ভেতরে পোষা কালিমা কাউকে না দেখিয়ে ভালো সাজতে চায়। তাই, আমি আমার অমন উদ্ভট বিচ্যুত অনুভূতি শুরু থেকেই অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলাম।
আমার তখনকার চুপচাপ থাকা দেখে মিথি মৃদু হেসে বলেছিলো, “কাহিনী কি? কি ভাবছিস?…চল, চল, ইরা হলে একা বসে আছে। তুই কিন্তু ঠিক পাঁচটায় সোহরাওয়ার্দীর সামনে থাকবি।”
আমি রিক্সায় উঠে প্রশ্ন করলাম, “ইরা টা আবার কে?”
হুড তোলা রিক্সায় চুরি করে খাওয়া দ্বিতীয় চুমুটা দেবার আগে ইরা এর উত্তর দিলোনা। আমি একটু সরে বলেছিলাম, “লোকজন দেখবে তো! বড় হইছি না!”
এক ঝাড়া দিয়ে মিথি আমাকেও সরিয়ে বলেছিলো, “তুই ই তো রিলেশনের শুরুতে ছোঁকছোঁক করতি। এসব কে শিখাইছে? আমি? এখন ভদ্রতা দেখাস, ছোটলোক কোথাকার!”
ওর গালি আমাকে সেদিন একটুও বিচলিত করেনি। আসলে ‘ইরা’ নামটা মাথায় অনবরত ঘুরপাক খাওয়ায় চুমুতে আমার আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু, অদ্ভুত সেই অদৃশ্য নারীরূপী সত্ত্বা ‘ইরা’ নাম থেকে সৃষ্ট নতুনত্বের অনুভূতি কেনো আমার এই পুরুষোচিত নড়বড় চিত্তে বার বার দাগ কাটছিলো তার কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা আমার জানা ছিলো না। হয়ত পুরুষের এই ভালোলাগার স্খলিত পরিভ্রমণ চিরায়ত, হয়তো অজানা এক প্রিয়জনের প্রিয়জন হিসেবে সে ভালোলাগা অদেখা আবেশে সৃষ্ট। বিষয়টা সামাজিক সুশীলতার মানদন্ডে আমার চিন্তাগত লাম্পট্য প্রকাশ করলেও, আমি সেই অদেখা স্ত্রীলিঙ্গের মানুষের প্রতি অপেক্ষাকৃত প্রবল অনুভূতি অনুভব করতে বেশ সাচ্ছন্দবোধ করছিলাম। তাই চুমুতে আমার মন ছিলো না, আর সেটাই হয়ত স্বাভাবিক ছিলো।
আমি আবার প্রশ্ন করেছিলাম, “আচ্ছা, সরি, রাগ করিস না। ওই যে বললি, ইরা, এটা আবার কে?”
ভীষণ অভিমান নিয়ে গোমড়া মুখ নিয়ে মিথি বলেছিলো, “আমার স্কুল লাইফের বান্ধবী। কাল ঢাকায় এসেছে।”
আমি স্বাভাবিক কথোপকথনের সমাপ্তির সমর্থনে সায় দিয়ে বলেছিলাম, “ওহ।”
ওয়েটার এখনো আসছেনা। আমি যার জন্য মিথিকে ডেকেছি সে কথা এখন বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি। আমার চুপচাপ থাকা দেখে কি মনে করে যেনো মিথি জিজ্ঞেস করলো, “ইরা কি আমার কথা জিজ্ঞেস করে?”
আমি খানিকটা সময় নিয়ে অনিচ্ছাকৃত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, বলে। হয়ত তোমার কথা প্রায়ই বলে।”
আমার দীর্ঘশ্বাসটা ধরতে পেরে মিথি সামান্য সরু চোখে বললো, “এভাবে বললে যে?”
মিথির এই ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবরই চমৎকার লাগতো। কোনো মেয়ের মাঝে হিউম্যান মাইন্ড রিড করার এতটা ব্রিরিয়ান্সি আমি কখনো দেখিনি বলে মিথিকে একদিন ফুটপাতে বসে বলেছিলাম, “আচ্ছা মিথি, ধর, আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ের পর তো আমরা আরো খানিকটা কাছাকাছি আসবোই, তাই না?”
সামান্য গলা খুশখুশ করায় আমি একটু থামতে মিথি এখনকার মতো সরু চোখে তাকিয়ে বলেছিলো, “তো!”
আমি গলা খাঁকড়িয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলেছিলাম, “দাঁড়া, পুরোটা বলে নিই। আচ্ছা, ধর, বিয়ের পরদিনই কোনো একটা এক্সিডেন্টে আমার কোমর থেকে নিচের অংশ প্যারালাইজড হয়ে গেলো। ডাক্তার বলে দিলো, সারাজীবন আমাকে এভাবেই বাঁচতে হবে। তুই কতদিন বা মাস বা বছর এমন আমাকে সহ্য করতি?”
আমার বলা শেষ হয়েছে কিনা মিথি জিজ্ঞেস করলো। আমি মিটিমিটি হাসছিলাম। ওর হাতের ফোনটা ফুটপাতে রেখে সজোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে বলেছিলো, “আর একবার যদি এমন কথা বলছিস তো খুন করে ফেলবো।”
মিথির থাপ্পড়ে ওর প্রতি তীব্র ভালোবাসা জেগে উঠেছিলো। আমি বিস্ময় চোখে এক নিরেট প্রেমিকাকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকটা ভরে গিয়েছিলো। তবে সেই নান্দনিক অনুভূতিটা কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেকটাই ফিকে হয়ে গেলো। মিথির স্কুল জীবনের বান্ধবী ইরা হল থেকে বের হয়ে সেবারই প্রথম আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে হাসছিলো।
মানুষ হাসলে তাকে কতটুকু সুন্দর দেখায় সেটা হয়তো ইরা কে না দেখলে আমি কখনোই উপলব্ধি করতে পারতাম না। মায়াভরা চেহারার নিখুঁত ত্বকের ইরা সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, “আমি যদি ভুল না করি, তুমি রূপক, রাইট?”
আমার উপর জেঁকে বসা স্তব্ধতা আমাকে কিছু বলতে দিলো না। অস্বাভাবিকভাবে মনে হলো গতকাল যে অন্তর্বাস মিথি পরেছিলো সেটা তবে ইরার? অথচ আমার অন্য কিছুও মনে হতে পারতো। আমি খানিকটা ঘোরের মধ্যে হ্যাণ্ডশেকের মতো হাত এগিয়ে বলেছিলাম, “হাই, তুমি ইরা!”
ইরা আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও আমার ছেড়ে দিতে একদম ইচ্ছা হচ্ছিলোনা। মিথি আমার অস্বাভাবিকতা টের পেয়ে ইরার সামনেই ঠোঁট কাটা মেয়ের মতো বলে ফেলেছিলো, “প্রেম করবি ইরার সাথে?”
আমি ততক্ষণে হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম। স্বল্প লজ্জার অনুতাপে ও অলীক সম্ভাবনার খুশিতে এক ধরণের যুগ্ম অনুভূতি নিয়ে সাহস করে ইরার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, “দেখ তো মিথি, আমাদের কেমন মানাচ্ছে?”
মিথি কৌশলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিয়েছিলো। এক রিক্সায় তিনজন চড়ার সময় মিথি বলেছিলো, “একে রাসেলের সাথে সেট করে দিকে কেমন হবে রে? রাসেল তোর কাছের ফ্রেণ্ড, বলে দেখবি নাকি?”
আমি অবশ্য অন্য এক অনুতাপের ভাবনায় মগ্ন ছিলাম। তখন ইরা ভাবনার পাশাপাশি এও আমার মনে উঁকি দিয়েছিলো যে, কিসের অপূর্ণতা ছিলো আমার? মিথির সাথে সামান্য উষ্ণ সংস্পর্শের মনোদৈহিক সম্পর্কের পাশাপাশি দৃঢ় বোঝাপড়া ছিলো, ছিলো সুন্দর একটা যুগল ভবিষ্যতের হাতছানি। ফ্যামিলি ম্যাচিং ছিলো, ওর মায়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো, ছিলো একটা স্বাভাবিক পৃথিবী। তারপরেও মানুষ ভুল করে, সে ভুল করার প্রবণতায় ওর চোখে বিশালাকার সত্যও অনেক সময় এক ফোঁটা উদ্বায়ী শিশিরের মতো মনে হয়। এমন ভুল থেকেই কি আমি ইরার কথা ভাবছি?
শাহবাগের স্পীডব্রেকারে ঝাঁকুনিতে ভাবনায় ছেদ পড়লো। আমি চুপ করে ছিলাম দেখে মিথি বলেছিলো, “রাসেলকে একটা ফোন দে তো, কাঁটাবনে আসতে বল।”
আমি কেনো যেনো চাইনি ইরা অন্য কারো হোক। তাই মিথিকে মিথ্যে করে বলেছিলাম, “রাসেলের জ্বর। পরে অন্যসময় এ ব্যাপারে কথা বলা যাবে।”
খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দুটো কফি এনে টেবিলে রেখে ওয়েটার মিথির দিকে চেয়ে মৃদু হেসে স্মার্টলি বললো, “ম্যাম, এখানে চিনি আছে, অন্য কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন।”
কফি দুটোর উপর সুন্দর করে দুটা হার্ট আকৃতির ফেনিল শিল্পকর্ম দেখে আমার লজ্জা লাগলো। আমি মগের হাতলে হাত দিতে যাবো এমন সময় মিথি বললো, “আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে তোমার সমস্যা হচ্ছে? আমি লক্ষ্য করছি তুমি এভয়েড করে যাচ্ছো।”
আমি একটু নড়েচড়ে বসে বললাম, “দেখো মিথি, আমাদের সম্পর্ক যেহেতু শেষ হয়ে গেছে সেহেতু কিছু প্রাপ্তির আশায় তোমায় ডাকিনি। আচ্ছা তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?”
মিথি ওর মগটা একটু এগিয়ে নিতে নিতে থেমে গিয়ে বললো, “প্লিজ, পুরোনো কিছু মনে করে দিওনা। বেশ ভালো আছি এখন। বলতে পারো পুরোনো সবকিছুই ভুলে গেছি, তুমিই তো বাধ্য করেছো সবকিছু ভুলে যেতে। যাহোক, আমাকে যেতে হবে, বাসায় কিছু গেস্ট এসেছে। প্লিজ কন্টিনিউ টু দ্য পয়েন্ট।”
“ইরা’কে দেয়া কথা রাখতে তোমাকে এখানে ডেকেছি”
কফিতে চুমুক দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, “কি বলেছে ও? আর তোমাদের মাঝে আমাকে কি দরকার?”
আমি বললাম, “তোমার মনে আছে যেদিন আমাকে আর ইরাকে তুমি ভীষণ রকম অপমান করেছিলে, ভোরে হেঁটে যাওয়া কয়েকজন মানুষের সামনে আঙ্গুল নাচিয়ে ইরাকে অনেক দোষারোপ করেছিলে, অথচ আমি দোষ স্বীকার করে বারবার বলেছিলাম ইরা একদম নির্দোষ তুমি ওকে বাজে কিছু বোলোনা। মনে আছে?”
খুব বিরক্তি নিয়ে মিথি বললো, “তোমাকে বলেছি রূপক, পেছনের প্রসঙ্গে প্লিজ কিছু বলবা না। আমি সে সব শুনতে চাচ্ছিনা।”
আমার চোখের চশমাটা খুললাম। কফির ধোঁয়ায় চশমার গ্লাসটা সামান্য ঘোলাটে হয়ে গেছে। এটা মোছা দরকার। টেবিলে রাখা টিস্যু দিয়ে চশমা মুছতে মুছতে বললাম, “দেখো মিথি, অনেক স্বপ্ন নিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরী হয়। সে সম্পর্কে সব স্বপ্নই যে পূরণ হবে তেমন ভাবা ঠিক না। আমি ভুল করেছিলাম, এখন সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে চলছি, হয়তবা আরো করতে হবে। যাহোক, ইরার সাথে সম্ভবত তোমার একটা কমিটমেন্ট ছিলো। আমি সে ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”
মিথি চুপ করে আছে। অতীতের সব স্মৃতিগত চারণে মেয়েটা হয়তো ভাবছে ইরার সাথে ওর কি কি কমিটমেন্ট ছিলো!
আমারও মিথির সাথে কমিটমেন্ট ছিলো। বিষয়টা ইরা ভালোভাবে জানলেও আমার ভালোবাসার আংশিক দিক পরিবর্তনে সে মন্তব্যহীন ছিলো। সত্যটা বলতে গেলে বলতেই হয়, ইরার সাথে পরিচয়ের প্রথম দিবাগত রাতে আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। যেখানে অন্যসময় সন্ধ্যার পর থেকে ঘুমানো পর্যন্ত আমি নিজে থেকেই যতবার মিথিকে ফোন দিতাম সেখানে সে রাতে শুধুমাত্র একবারের ফর্মাল কল দিয়ে ‘খেয়েছো কিনা?’ জিজ্ঞেস করে আর তেমন কিছু বলিনি। সারা রাত এপাশ ওপাশ করে শুধু ইরার কথাই ভাবছিলাম।
পরদিন টিএসসিতেই রাস্তা পার হওয়ার সময় আমি এক হাতে মিথির আর অন্য হাতে ইরার হাত ধরে রেখেছিলাম। মিথির চেনা ছোঁয়া আর ইরার অচেনা স্পর্শের আবেশের অনুভূতিগত চিরায়ত পার্থক্যে আমার সম্পূর্ণ মনযোগ ছিলো ইরার দিকে। আমি বুঝতে পারছিলাম বিষয়টা জলজ্যান্ত অনৈতিক আর আমি নিশ্চিতভাবেই মিথির ভালোবাসাকে চরমভাবে অবমাননা করছিলাম। অথচ মিথি বা ইরা কেউ আমার অমন দ্বন্দ্ব বুঝতে পারে নি। তবে সেটা ইরার কাছে পরিস্কার হতে খুব বেশী সময় লাগেনি। সোহরাওয়ার্দীর সামনের ঝালমুড়ির দোকানে মিথি ঝালমুড়ির অর্ডার দিচ্ছিলো। আমি না হেসে খুব কনফিডেন্টলি ইরাকে বলেছিলাম, “তুমি কি জানো ইরা, তোমার হাসি অন্য কারো মনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?”
ইরা হেসে বলেছিলো, “মিথির হাসিও তো সুন্দর।”
আমি কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ঠিক আগের মতোই কনফিডেন্টলি বলেছিলাম, “অন্ততঃ তোমার মতো না।”
ইরার মুখ থেকে হাসির রেশটা উবে গেলো। আমি এর পরে ওর মুখ থেকে কোনো একটা বাক্য আশা করছিলাম। তখনি মিথি ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা হাতে আমার দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে বললো, “কিরে তোরা ঝগড়া করেছিস নাকি? চুপচাপ যে!”
সে রাতে ফোনে প্রথম ইরার সাথে কথা হলো। ওর যাদুকরী কন্ঠের মাদকতায় আমার তখনই বলতে ইচ্ছে করছিলো, “ইরা তোমাকে আমার প্রয়োজন, নিজের করে না হলেও আমার সত্ত্বার প্রশান্তির জন্য তোমাকে প্রয়োজন। তুমি প্রশ্ন করোনা আমি কেন এমনটা বলছি, শুধু আমার আমিত্বকে তোমার মাঝে হারিয়েছি, বিশ্বাস করো এতে আমার কোনো হাত নেই। একটা অনুরোধ করি ইরা? তুমি সেই অন্তর্বাসটা পরে কাল এসো, যেটা তুমি মিথি পরতে দিয়েছিলে!”
ওসব বলা হয়নি। আলাপচারিতার শেষ দিকে ফোন রেখে দেয়ার সময় কিছুটা জড়ানো কন্ঠে বলেছিলাম, “কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”
“হ্যাঁ, বলো।”
“নাহ, কিছু না। আচ্ছা রাখছি।”
পরদিন সকালে ইরা আমাকে ফোন দিয়ে হন্তদন্তভাবে বললো যেনো আমি মিথির হলের সামনে আসি। ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে মিথির মাথার পেছনের অংশ বিশ্রীভাবে কেটে গিয়েছিলো। ব্লিডিং না থামায় ওকে বাধ্য হয়ে ডিএমসিএইচে এডমিট করতে হয়েছিলো।
হাসাপাতালের প্রথম রাতে আমরা নির্ঘুম ছিলাম। মিথিকে ঘুমের ঔষধ প্রয়োগে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিলো। সকাল বেলায় আমি সামাম্য ঘুমালেও ইরা জেগে ছিলো। দ্বিতীয় রাতে মিথি আমাদের অন্তরঙ্গভাবে দেখে ফেলেছিলো। ব্যান্ডেজ মাথায় মিথি উঠে ঘুমন্ত আমাকে ডেকে বলেছিলো, “ছিঃ এসব কি রূপক? তোরা জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছিস? এক বিছানায়?”
আমি নিজেকে সংবরণ করে উঠে বসে বলেছিলাম, “কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝিনি।”
সত্যি অর্থে আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম না। ইরা ঘুমিয়েছিলো। আমি ইরার পাশে ঘুমের ভান করে ওর কোমর জড়িয়ে যুগ্মমূর্তির মতো লেপ্টে ছিলাম। গভীর ঘুমের ভান ধরে উষ্ণ চাপা নিঃশ্বাসের মনোদৈহিক মিশ্র অনুভূতিতে ইরার যতটা কাছে যাওয়া সম্ভব, গিয়েছিলাম। সে মুহূর্তে শরীরগত অনুভূতি আসতেই ওর হাসিটা আমার চোখে ভেসে উঠছিলো আবার তেমন অনুভূতির উল্টোপৃষ্টের প্রেমবোধ জাগ্রত হওয়াতে আমার হৃদয়ের অন্য খন্ডে ওর অন্তর্বাসীয় সুবাসের আকাঙ্ক্ষায় আনচান করছিলো। দুই অনুভূতির সমন্বয়ের পরবর্তী এক পর্যায়ে আমি অনুনয় করে ইরার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেছিলাম, “আমি বোধহয় তোমাকেই চাই, ওই ইরা, তুমি ঘুমাচ্ছো? আমার কথা শুনবা না?”
খুব সম্ভব ইরা আমার কথা শোনে নি। তবে, অল্প কিছুক্ষণ পরে মিথি আমার দিকে না থাকিয়ে বেডে শুয়েই বলেছিলো, “এমনটা যেনো আর কখনো না দেখি রূপক। এবারের মতো কিছু বললাম না!”
হাসপাতাল থেকে রিলিজের পরের দুদিন বিকেলেই আমি আর ইরা একসাথে ঘুরেছিলাম। রিক্সায়, হেঁটে, চারুকলার দেয়ালে ঠেঁস দিয়ে বসে এমনভাবে আমরা মিশেছিলাম যেনো আমরা দীর্ঘদিনের মনোবন্ধনে আবদ্ধ। বন্ধুদের অনেকেই আমাদের একত্রে দেখেছিলো। আমাদের হাসতে দেখেছিলো, গভীর দৃষ্টিতে ইরার নিখুঁত নাক চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলো, দেখেছিলো ছোট ছোট আরাধ্য খুনসুঁটি! সত্যি বলতে হাসপাতাল পরবর্তী মিথির বিশ্রামকালীন সময়ে ইরার সাথে স্বল্প সময়টুকু সম্পূর্ণ একটা অনুচিত প্রাক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা অনিচ্ছার বেড়াজালে ঘোরের মধ্যে কেটেছিলো। আমি কোনোভাবেই চাইছিলাম না সে ঘোর কাটুক। আমি সেই দুইদিনে খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছিলাম, মিথির সাথে আমার সম্পর্ক চালিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি না থাকলে ইরা মেয়েটা আমার জীবনের একটা অধ্যায়ে পরিণত হতে এক মুহূর্তও দেরী করতোনা।
শেষ দিন ইরা আবারো নিজে থেকেই মধ্যরাতে ফোন দিয়েছিলো। বেশ কাঁপাকাঁপা গলায় বলেছিলো, “রূপক, মিথি তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”
আমি সে কথার প্রেক্ষিতে কিছু না বলে চুপ করে ছিলাম। ইরা আগের মতো কাঁপাকাঁপা গলায় বলেছিলো, “আমি কাল চলে যাবো। তোমরা ভালো থাকবা। আমার বন্ধবীকে তুমি ভালো রেখো। আমি চাইনা আমার কারণে তোমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হোক।”
আমার সবকিছু শূন্য শূন্য লাগছিলো। কেউ যেনো আমার গলা চেপে ধরে আমার কন্ঠস্বর থামিয়ে দিয়েছিলো। তাও নিজের দূর্বলতা লুকিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, “তোমার কি হয়েছে ইরা? তুমি এমনভাবে বলছো কেনো?”
আমার প্রশ্ন উপেক্ষা করে ইরা ফোন রেখে দিতে চাইলো। আমি অনুনয়ের চেয়ে খানিকটা কঠিন সুরে ওকে বলেছিলাম, “সত্যি করে একটা কথা বলো, ইরা। আমরা কি এগিয়ে যেতে পারি না?”
নিঃসীম বিষাদ মাখা কন্ঠে ইরা বলেছিলো, “রূপক, কাল আমাকে একটু বাসে উঠিয়ে দিতে পারবা? আমার চলে যাওয়াই তোমাদের জন্য ভালো হবে।”
অনেক ভোরে ইরা হল থেকে বের হয়ে এসেছিলো। আমি ওর জন্য হলগেইটে অপেক্ষা করছিলাম। অতটা ভোরে হয়তবা আশেপাশে কেউ ছিলোনা বলে কি মনে করে যেনো আকস্মিকভাবে মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের কেঁদে দিয়েছিলো। ইরার পেছন পেছন মিথি কখন যে এসেছিলো আমরা কেউ খেয়াল করিনি। আমাদের সেই অন্তরঙ্গ আলিঙ্গন বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো মিথির হাততালিতে।
মুহূর্তেই বিক্ষুব্ধ মিথি ইরাকে টান দিয়ে ওকে যাচ্ছে তাই বলে ভীষণ অপমান করেছিলো। মিথির অমন ক্ষোভ যদিও স্বাভাবিক, তবুও ইরা’কে করা অপমানটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। ইরার হাত টেনে ধরে ওকে সাথে করে আমি ফিরে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে মিথি চিৎকার দিয়ে বলেছিলো, “যা, চোখের সামনে থেকে চলে যা! আমার জীবনে আজ থেকে তোরা মরে গেছিস।”
দুজনের কফি থেকেই ধোঁয়া ওঠার হার অনেকটা কমে এসেছে। চিন্তামগ্ন মিথি কফিতে আরেক চুমুক দিয়ে বললো, “ইরা যেদিন থেকে তোমার হয়েছিলো তখনই আমার কাছে ও মরে গেছে। বাবার বদলীর পর ওদের ওখান থেকে আমরা চলে এসেছিলাম। তোমাদের অমন প্রতারণার পর পেছনের কোন কমিটমেন্ট ছিলো কি ছিলো না সে সব নিয়ে ভাবার আর কোনো প্রয়োজন এখন আর আছে?”
আমি টিস্যু দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছলাম। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে মিথির চোখের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “ইরা মারা গেছে আজ তিন বছর হলো। ওর মৃত্যুর শেষ কয়েক ঘন্টা আমি ওর পাশে ছিলাম। তখন ও বারবার তোমার কথা বলছিলো।”
মিথির হাতের কফি মগটা ধপ করে টেবিলে পড়লো। পৃথিবীর সব মানুষই সম্পর্কের একটা জের বহন করে। সেটা এমন যে, অনেক পুরোনো কোনো অনুপস্থিত সম্পর্কও মাঝে মাঝে সেই পুরোনো সম্পর্কের স্থায়ী ছিন্নতায় মনকে ব্যাকুল করে তোলে। এমন বিয়োগে কালান্তরের চাপা অভিমান নিমিষেই বরফের মতো গলে অশ্রু হয়ে চোখ বেয়ে ঝরে। মিথি কাঁদছে। ওর চোখ গড়িয়ে পড়া অশ্রু ঝরতে দিয়ে আমার হাত ধরে আমাকে সেই চিরচেনা ‘তুই’ সম্মোধনে বললো, “আমাকে একবারও জানাতে পারলি না?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “শুনেছিলাম তুমি নিউজিল্যান্ড চলে গেছো। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে জানাই। পরে আবার ভাবলাম, দেশে ফিরলে সামনাসামনি না হয় বলা যাবে।”
মিথি কোনো কথা বলছে না। আমার হাত ধরে ও কেঁদেই যাচ্ছে। একবার ইচ্ছা হলো ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, “প্রকৃতি যাকে একবার নিয়ে যায় তাকে কি আর ফিরিয়ে আনা যায়? কাঁদিস না মিথি!”
আমার সাহস হলো না। আমি জানি ফেলে আসা হারানো অধিকার কখনোই আগের মতো করে ফিরে পাওয়া যায় না। তাই আমার হাত ধরে রাখা মিথির হাতের উপর আমার অন্য হাতটা চাপিয়ে দিয়ে স্বান্তনার সাময়িক প্রশমনের ইচ্ছা হলেও আমি তা পারলাম না। মিথি কান্নারত অবস্থায় বললো, “কি হইছিলো ইরার? তুই থাকতে ও মরলো কিভাবে?”
আমি আমার হাতটা সরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বললাম, “ছোটবেলায় ইরা তোমাকে কথা দিয়েছিলো, তোমার বাচ্চা হলে তুমি ইরাকে দিবা আর ওর বাচ্চা হলে তোমাকে দেবে। আমাদের একমাত্র মেয়ে মিথিলা জন্ম নেয়ার ঘন্টাখানেক পরেই ইরা মারা যায়। আর, ও নেগেটিভ ব্লাড ম্যানেজ করা ওই অল্প সময়ে সম্ভব ছিলো না…মাত্রাতিরিক্ত ব্লিডিং হচ্ছিলো।
মিথির কান্না এখনো থামছে না। কি জানি কি ভাবছে মেয়েটা! আমি আবার বললাম, “মৃত্যুর ঠিক আগেও আমাকে বলেছিলো আমি যেনো ওর নাম রাখি মিথিলা, আর কথামতো মিথিলাকে যেনো তোমার কাছে পৌঁছে দিই। আমি জানিনা হয়ত এটা তোমাদের ছেলেমানুষী কথাবার্তা ছিলো কিনা! তবে ওর শেষ ইচ্ছা হিসেবে আমি মিথিলাকে তোমার কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা বলতে এসেছি। বাকিটা তোমার ব্যাপার!”
মিথি চমকে উঠে আমাকে বললো, “ও কোথায় এখন?”
মিথিলা গুটিগুটি পায়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এই রেস্টুরেন্টের নিচে চাইল্ড ডে কেয়ারের এক পরিচালিকা ভদ্রমহিলা মিথিলাকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে আসছেন। আমাকে দেখে মিথিলা দৌড়ে এসে আমার কোলে বসলো। বাচ্চা মেয়েটা চোখ গোলগোল করে মিথির দিকে তাকিয়ে আছে। মিথিলাকে দেখে মিথি আবারো নিজের ঠোঁট চেপে গালের দেয়ালে ভাঁজ ফেলে নিঃশব্দে কান্না শুরু করলো।
আমার তিন বছরের ছোট্ট মিথিলা মিথির দিকে তাকিয়ে টেনে টেনে বললো, “আব্বু, এটা কি আম্মু? তুমি চাঁদের বুড়ির কাছ থেকে আমার আম্মুকে নিয়ে কখন এসেছো?”
মিথি এক মুহূর্ত দেরী করলো না। চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ওর গালে, কপালে আর চুলে অনবরত চুমু খেতে খেতে বললো, “তুই আমার কাছেই থাকবি, মা। তুই আর কোত্থাও যাবি না!”
কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যার কিছু অতীত থাকে, কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যা মনের গহীনে অতীতের সেই ভালো বা মন্দ লাগাকে কেন্দ্র করে জমে থাকা বিষাদের পাশাপাশি সুপ্ত ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখে। কে বলে মৃত্যুতেই প্রিয় মানুষের ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়? ভালোবাসা বাঁচে হৃদয় থেকে হৃদয়ে, ভালোবাসার পৃষ্টা উল্টে গেলেও কখনো কখনো ভালোবাসা বেঁচে থাকে প্রতিটা প্রাক্তন সম্পর্কের পরম্পরায়!
আহা! বাচ্চা মেয়েটাকে মিথির বুকে কতো যত্নে লেপ্টে আছে! থাকুক। মিথি এখনো কাঁদছে, কাঁদুক! আরেকটু না হয় কাঁদুক!