বেলার পেট টেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। অাট-ন’ মাসের পোয়াতি। স্বামী যখন যায় ও জানতনা ও পোয়াতি হয়েছে। কদিনপর বেলাকে দেখে রানু পিসি চমকে ওঠে।
:ও বাবা, বেলা! তুই পোয়াতী বুঝিসনি?
বেলা মাথা নারে। এমনতো কতবারই সন্দেহের তীর এসেছিল, ও পোয়াতী হয়েছে। কই হল নাতো!
:তুতো তিনচার মাসের পোয়াতীগো!
এরপর বেলা নিজেই টের পায়। কি করবে? অঞ্জন বাড়ি নেই। কাশীপুর অাখড়া ছেড়ে স্কুলের রাস্তা ধরে পালবাড়ির মোড়ে কতদিন এসে দাঁড়িয়েছে বেলা। নাহ্, অঞ্জনের দেখা পায়নি। ও শুনেছে যুদ্ধ বেশ চলছে। মিলিটারী মাধবদী এসেছে। মুক্তিরাও ছদ্মবশে এসেছে। যদি অঞ্জনের দেখা মেলে! বেলা বলবে।
:ওগো, তুমি বাবা হচ্ছ।
স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। অঞ্জন কই? কারো মুখে শোনে গাজীপুর বেশ বড় যুদ্ধ চলছে। সেখানে অঞ্জন অাছে। বেলার শ্বশুর শাশুড়ী কলকাতা পাড়ি দিয়েছে। বেলাকে অনেক সেধেছে। বেলা যায়নি। যদি অঞ্জন অাসে! বেলা এসে উঠেছে ছবির চাচার বাড়ি। পালবাড়ি এখন খাঁ খাঁ করছে। সেখানে কেউ নেই। অঞ্জনের বন্ধু শোয়েব এসে বেলাকে দিয়ে গেছে অালগী। ছবির চাচার বাড়ি। চাচার চালের অাড়ত বাজারে। ছেলে থাকে জার্মানী। ছেলেও নিঃসস্তান। বাড়িতে চাচী অার চাচা। দু বুড়াবুড়ি। চাচীর জ্বর। বেলা ভাত বসাচ্ছে। জোরে চিল্লায় বেলা।
:চাচা, অাজ কজন অাইবো?
:কেনো মাইয়ো?
:ভাত কতটুক বয়াইতাম।
:অাঙগো সহ অারো বাড়তি পাঁচ মেমান হিসাব করে দে।
বেলা চাল ধোয়। কলের নিচে রাখা স্টিলের থালে ওর প্রতিবিম্বর দিকে তাকায়। তিরতির পানিতে ওর মুখটা দেখা যাচ্ছে। বড্ড মলিন। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। হাতের শাঁখা দুখানাও খুলে রেখেছে। এইতো কালও পিশাচের দল এসেছিল। শ্বেত শুভ্র দাড়ির ছবির চাচাকে বেশ শাসিয়ে গেছে।
:ক্যায়া বাত হ্যায়! তুম মুক্তি হো?
:নেহি। হাম ছোটি অাদমী হ্যায় জনাব।
:সাচ্চি হ্যায় ক্যায়া?
:অালবৎ হুজুর।
ঘরে তখন বেলার খাটের নিচে নিজাম ছিল। সতের বছরের টগবগে কিশোর। কাঁধে মুক্তির বোঝা নিয়ে।
:দিদি, ঘর কি সার্চ করবে?
:চুপ কর। ইশ্বর অাছেন না।
এক সেনা হাতের বন্দুকখান নিয়ে ঘরে ঢোকে। সবুরা খাতুন খাটে শোয়া।
:ঘর ম্যা কৌন কৌন হ্যায়।
:তিন অাদমী হ্যায়।
:তিসরা কৌন হ্যায়?
:মেরী বেটি জনাব।
:কাহা হ্যায়?
চাচা ডাকলেন বেলাকে। ভাগ্যিস বেলা শাঁখা খুলে রেখেছিল। সিঁদুর দেয়নি চাচার নিষেধে।
:ইয়ে মেরী বেটি হ্যায় হুজুর। পেট ম্যা হ্যায়।
বেলা মাথা নিচু করে থাকে। তাকালে দেখতে পেত ছয় জোড় লোলুপ চোখ ওকে চেটে খাচ্ছে। পোয়াতী তো কি হয়েছে! নারী মাংশ। বুটের ঘটঘট অাওয়াজ তুলে চলে গেল। চাচা তাকালেন অপরাধী দৃষ্টিতে।
:অাবার অাইবো মা।
:জানি।
:নিজামরে পার করতে অইব।
:অামি যাইতাছি চাচা।
নিজামকে হাত চেপে ধরে ছোটে বেলা। সরু রাস্তাটা ধরে গাঙপাড় পৌছে ওরা। বেলা ঠেলে দেয় নৌকাটা। অল্প জল। তাতে কি। শক্ত হাতে বৈঠা ঠেলে বেলা। নিজাম নরোম চোখে তাকায়।
:দিদি, কষ্ট হইতাছে না?
বেলা হাসে।
:কয়দিনের বোকা! দেশ যেদিন স্বাধীন হবে সব কষ্ট শেষ।
:দাদার কতা মনে অয়?
:দেকা অইলে দাদারে কইস, দি অপেক্ষায়।
পারে এসে অারেকবার বেলা নিজামকে অঞ্জনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ফিরতি পথ ধরে বেলা। পুরোন ঘাটে নামতেই রশীদ মুন্সির সংগে চোখাচোখি। নোংরা মুখে দাঁত খুটে চলেছে।
:কেডায়?
বেলা ঘোমটাটা টেনে দেয়। পা চালায় তড়িঘড়ি।
:অঞ্জনের বৌ না ছবিরের মাইয়া?
বেলা পিছন তাকায় না। সরু রাস্তা ধরে চলে। কে জানে এযে ওর কাল ডেকে অানবে!
পরদিন ভাত চড়ায় বেলা। শফিক, নেবুদা, রমিজ, মনির, বিপ্লব এসে ওঠে বাড়িতে। ছবির চাচা বেলার ঘরে ওদের নিয়ে বসে। এ ঘরটা পেছনে। অার যাবার পথও রেখেছে ছবির চাচা। শফিক অশ্রু চোখে বর্ণনা দেয় কষ্টের, অত্যাচারের বর্ণনা। মা, বোন, এমনকি শিশুদেরও রেহাই দেয় না পিশাচরা। চাচার চোখে অাগুন। শফিক খবর বলে।
:অঞ্জন মারা গেছে টাঙ্গাইলে। ওর হাতটাই বোমায় শেষ অয়া গেছিলগা। অার বেশী দেরী নাই, মুক্তি দরজায় কড়া নাড়ে।
:অাজ কয় তারিখ?
:ডিসেম্বর বলে।
:তোরা মুক্তি ছিনিয়ে অান। তোরাই পারবি।
বেলার চোখ থেকে অঝোরে জল ঝরে। কখন চুলায় ভাতের মাড় উপচে পড়ে। বেলা ঠিকা দেয় ভাতের। হাত মুছে দরজায় টোকা দেয়। ভেতরে ঢোকে মাত্র। বাইরের দরজা খুলে যায়। সবাই স্তব্ধ। বেয়নেট উচিয়ে পাঁচ পিশাচের প্রবেশ। সংগে নোয়াপাড়ার রশীদ মুন্সি। ছবির চাচা পানি অানতে বাইরে গেলেন বোধহয়। ঠা ঠা অাওয়াজে পাঁচটা প্রাণ শুয়ে পড়ে। রক্তে সয়লাব মেঝে। বেলা দুহাতে কান চেপে ধরে। রশীদ মুন্সি দাঁত কেলিয়ে হাসে।
:ইয়ে হ্যায় খেয়া পারের বেলা। মুক্তিকো পাড় মে লে যায়ে। ওয়ি হ্যায় হুজুর।
:উসকো উঠাকে লে চলো।
বেলার চিৎকার কারও কাছেই পৌঁছেনা। পোয়াতী তো কি হয়েছে! নিস্তার নেই। সারারাত চলে অত্যাচার।
কয়দিন! হয়ত দুদিন। বেলার মনে নেই। রক্তে ভেসে গেছে সব। বেলার সম্বিৎ ফিরল এক সকালে। ভোর হয় হয়। নরপিশাচরা সব উধাও। কারণ কি? বেলা পড়ে অাছে সরু রাস্তাটার ধারে। রক্ত পড়ছে দু পা বেয়ে। বেলাকে যেতে হবে। ছবির চাচা দুহাতে বেলাকে মেঝেতে শুইয়ে দেয়। চাচীর জ্বর কোথায় চলে গেছে! চাচী গরম জল নিয়ে অাসেন। নতুন ব্লেড, তোয়ালে। শেষসময়। বেলা হাসে।
:কি হবে চাচী?
:চুপ কর মা। দেখতাছি।
:বাঁইচা থাইকা অার কি লাভ?
:মুক্তির গান শুনবিনে?
ছোট্ট চিৎকারে মুখরিত হয় ঘরখানা। বেলা তাকায়। ছবির চাচার রেকর্ডারে গান বাজছে।
পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে…রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল
জনসমুদ্রে জোয়ার এনেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল…
:ও সবুরা, বেলারে কও দেশ মুক্ত হয়েছে। অাজকে। ১৬ ই ডিসেম্বর।
বেলা স্মিত হাসে।
:চাচী অামনেগো মেলে অামার মুক্তিরে থুইয়া গেলাম।
সবুরা খাতুন কোলে নেয় মুক্তিকে। বেলার নিথর দেহখানা সামনে।
:মা, তারপর? মুক্তির কি হল?
:মুক্তি এখন মিউনিখে। ইসার নদীর তীরে এক খেয়া পারের বেলাকে হারিয়ে অারেক বেলার মা হয়ে দাঁড়িয়ে।
একুশ বর্ষীয়া বেলা জল উপচানো চোখে তাকায় মায়ের দিকে। হাতে লাল সবুজ পতাকা। গুন গুন করে গায়,
অামার সোনার বাংলা
অামি তোমায় ভালবাসি
চিরদিন তোমার অাকাশ,
চিরদিন তোমার অাকাশ,
তোমার বাতাস,
অামার প্রাণে,
ওমা অামার প্রাণে বাজায় বাঁশি…