তিতির বিছানায় শুয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। দেয়ালে টিপ এখানে সেখানে ইতস্তত লাগানো। টিপ গুনলো ও। সতেরো টা টিপ।ঠিক আছে। বাসায় এসেছে ও সতেরো দিন। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দেয়ালে পা তুলে দিল।বাজে অভ্যাস।দেয়ালে পা ঠেকিয়ে শোবেই।মা কতদিন বকেছে। কে শোনে কার কথা! গান শুনতে শুনতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম ভাঙলো একেবারে সন্ধ্যের মুখে। মায়ের চিল্লাচিল্লিতে। মীরা আপা মা কে কি যেন বললো নীচু গলায়।মা আরো রেগে গলা বাড়িয়ে বলছে ‘তুই মরিস না মুখপুড়ি ‘। তিতির হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে উঠলো। এক কাপ চা দরকার।গা ম্যাজম্যাজ করছে।জ্বর আসবে। খুব খারাপ হবে। আর দুমাস পর ওর অনার্স ফাইনাল । এখনো কিছুই পড়া হয়নি।তিতিরকে দেখে মা আর মীরা আপা চুপ হয়ে গেল।
-কড়া এক কাপ চা দেবে মা?
মীরা আপা বললো,
-আমাকেও দিও মা এক কাপ
মা কিছু না বলে উঠে গেল।তিতির মীরার পাশে বসলো,
-কি অবস্থা আপা। পেট তো ভালোই ফুলেছে।দুইটা হবে নাকি?
মীরা হাসলো।
-বেশ হবে।একটা তুই রাখবি।
তিতির হাসলো। জানে মীরা খুব বাচ্চা পছন্দ করে। রাশেদ ভাইও।
মীরা তিতিরের বড় বোন।বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক।রাশেদ ভাই অগ্রণী ব্যাংকে আছে। মীরা আপার মুখে একটা সুখী সুখী ভাব আছে। কে জানে! হয়তো তিতিরই ভুল ভাবে। বাবা মাকে তো কিছুই বলে না।তবুও তো মা কে দেখলে কেন জানি মনে হয় মা এই সংসার করে খুশি নয়।
দাদীও মা কে খুব ভালোবাসে।কিন্তু কই! মা তো দাদীকে খুব একটা ডাকে না। সংসার জিনিসটা তিতিরের কাছে জটিল লাগে খুব।
সকাল সকাল বাবার সামনে পড়ে গেল তিতির।
-কে! মীরা নাকি?
-বাবা চশমা পড়ো তো।আমি তিতির।
-তিতির। শোন তো।এদিকে আয়।তোর সাথে কথা ছিল।
-একটু পরে আসি বাবা?আমি ফিজিক্সের একটা জটিল থিওরী বোঝার চেষ্টা করছি।
-আরে রাখ তোর ফিজিক্স।ফিজিক্স পড়ে কোন পাগলে?আয় এদিকে।কথা শোন।
তিতির হতাশ হয়ে বই বন্ধ করলো।বাবার সামনে গিয়ে বসলো।
-বলো।
-তোর মা আর বড় আপার মধ্যে তো ভীষণ ফাইট হচ্ছে।বুঝলি?
তিতির আরো দ্বিগুণ হতাশ হলো।এই কথা বলার জন্য বাবা ওকে ডেকেছে!
-তোর জন্য রাশেদ একটা প্রস্তাব এনেছে । তোর মা পছন্দ করে নি।মীরা জোর করায় মীরাকেই আবার বিয়ে করতে বলেছে।ব্যস!লেগে গেছে।
তিতির কিছু বললো না।মীরা আপা বাবা মা দুজনেরই কাছের।আপা আর মা কে দেখলো দুই বান্ধবী বলে চালিয়ে দেয়া যায়।কিন্তু তিতির কেন জানি দূরের হয়ে গেছে।
-বাবা!
-বল।
-আমার সামনে এক্সাম।আমি যাই?
-আরে দূর।এত পড়ে কি হবে। আমি কি কিছু করতে পারছি বল?
তিতির জানে ওর বাবার গভীর একটা ক্ষোভ আছে। রাবির মত জায়গা থেকে টপ মার্ক নিয়ে এল.এল.বি. পড়েও খুব বেশি কিছু হয় নি। কারণ বাবার খুঁটির জোর ছিল না।
-তোমার গল্প পরে শুনবো।এখন যাই বাবা?
-আর একটু বস না।
-আমার ইচ্ছে করছে না বাবা
তিতির উঠলো।হোস্টেল ছেড়ে বাসায় আসাটা উচিত হয়নি।
প্রচণ্ড ব্যস্ততা যাচ্ছে তিতিরের। পরীক্ষার টাইট শিডিউল। এর মধ্যে বাড়ি থেকে ফোন। মা।
-হ্যা মা। বলো।
-তুই বাসায় আসবি কবে?
-আরো তের দিন মা।
-পরীক্ষা শেষ করেই বাসায় ফিরবি।
-কেন না?
-এত কেনর উত্তর দিতে পারবো না।
মা ফোন রেখে দিল।তিতিরের মেজাজ খারাপ হলো।কোনো মানে হয়?
তিতির বাড়ি ফিরেই হতভম্ভ হয়ে গেছে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজনে।
মীরা তিতিরকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠলো। ফোলা পেট নিয়ে কেমন থপ থপ করে এগিয়ে আসছে।
-এইতো তিতির এসেছে।
মা এগিয়ে এসে তিতিরের হাত ধরে রুমে নিয়ে গেল।
-গোসল করে নে।
-সে তো করবোই।কিন্তু ব্যাপার কি বলো তো মা?
-তেমন কিছু না। রাশেদ তোর জন্য একটা ছেলে এনেছে। দেখতে আসবে।
তিতিরের মা ভেবেছিল তিতির রেগে যাবে।কিন্তু খুব সহজ ভাবেই বললো,
-আমার তো শাড়ি – টাড়ি নেই কিছু।তোমার সবুজ শাড়িটা দাও তো মা।
তিতিরের মা হাঁফ ছাড়লো।খুশিতে মনে হয় বয়স অর্ধেক কমে গেল তার।আনন্দিত গলায় বললো,
-এক্ষুনি দিচ্ছি।
রাফির সাথে কিভাবে যেন বিয়েটা হয়ে গেছে তিতিরের। সেদিন দেখতে এলো।তারপরই বিয়ে।যেন ভোজবাজির মত ব্যাপার স্যাপার। তিতিরের হাসি পায় মাঝে মাঝে। ফিলসফির প্রফেসরের নাম রাফি! ছাত্ররা একে মানে তো? দেখা গেল আড়ালে নাম দিয়ে রেখেছে কাফি পাগলা। তিতিরের ধারণা ওদের ছেলে মেয়ে হলে সবগুলো রোবট হবে বাপের মতো। পেটে বোমা মারলেও মুখ দিয়ে কথা বেরুবে না। হাতে গোনা দশ থেকে বারোটা কথা হয়েছে রাফির সাথে ওর। রাফির বাবা মা নেই। দূর সম্পর্কের এক মামার কাছে মানুষ হয়েছে। তিতিরের রেজাল্ট বেরোয় নি।রান্না করতে করতে গান শুনছিল। কলিংবেলের শব্দে গেল দরজা খুলতে।দরজা খুলে থমকে গেল। মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। হাতে এক গুচ্ছ চন্দ্রমল্লিকা । তিতিরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোনো কথা না বলে চলে গেল রুমের দিকে।তিতির দরজা লাগিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো । ভালোলাগছে ওর। ভীষণ। রান্না শেষ করে দরজায় যেয়ে দাঁড়ালো। রাফি টেবিলে বসে কি একটা বইয়ে মুখ গুঁজে দিয়েছে। গোসল দিয়েছে।মাথা থেকে টপটপিয়ে পানি ঝরছে।যে শৈত্যপ্রবাহ চলছে। তার মধ্যে হালকা একটা চাদর গায়ে জড়ানো শুধু।তিতির দরজা নক করলো না।আচমকা একটা ভীষণ সাহসী কাজ করে ফেললো। দুম করে তোয়ালে নিয়ে রাফির মাথা মুছে দিল। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে রাফির মুগ্ধ চোখ দেখতে পেল না তিতির। জানলো না একটা মানুষ কতটা খুশি হয়েছে।
-খাবেন চলুন
-চলুন
খাবার টেবিলে বসে রাফি হেসে ফেললো। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতে ঘি গলছে, বেগুনের চাকা ভাজি, কাঁচামরিচ ফালি করে দেয়া কড়া করে আলু ভাজি, ধনিয়াপাতা দিয়ে মসুর ডাল ভুনা, ক্ষীর।
-আপনি তো আমাকে খাইয়ে রীতিমতো নাদুসনুদুস বানিয়ে ফেলবেন।
-ভালোই তো।গাড়ি লাগবে না। বাসা থেকে ধাক্কা দিব গড়াতে গড়াতে ভার্সিটি যাবেন।ভার্সিটি থেকে এক ধাক্কায় গড়াতে গড়াতে বাড়ি।
রাফি হেসে ফেললো উচ্চস্বরে।তিতিরের বুকে লাগলো শব্দটা। কি সুন্দর করে হাসে মানুষটা। এই হাসির জন্যই মানুষটার সব গাম্ভীর্য মাফ করে দেয়া যায়।
তিতির শাল দিয়ে মুড়ে বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিল।রাফি বই হাতে লুকিয়ে লুকিয়ে তিতিরকে দেখছিল।মেয়েটির চোখ দুটো অতল গভীর। চোখ তুলে যখন তাকায় তখন রাফির বলতে ইচ্ছে করে ‘পাখির নীড়ের মত চোখ ‘। মেয়েটি হাসলে গালে টোল পড়ে।ঠোঁটের নীচে অদ্ভুত একটা ভাঁজ পড়ে । রাফির ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেয়।মেয়েটা মালির সাথে হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন কথা বলছে।রাফির ইচ্ছে হয় তিতির ওর সাথেও ওইভাবে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করুক।কথার মাঝখানে চুলে হাত দিক।আবার তাকাতে যেয়েই চমকে গেল। তিতির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি এলো কখন।
-চলুন বাগানে যাই।হাঁটবেন।
-পড়ছি।
-তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
বইটা টান দিয়ে সোজা করে হাতে ধরিয়ে দিল তিতির। মুখে চকলেট নিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়া বাচ্চার মত চেহারা হলো রাফির।
-অনেক পড়াশোনা হয়েছে। চলুন তো।
তিতির রাফির হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো বাগানে ।
হালকা খুনসুটি,আনন্দে তিতির-রাফির সংসার কেটে যায়।মাঝে মাঝে মীরা আপার সাথে কথা বলে তিতির। আপার প্রায় নমাস হয়ে গেছে । তিতির মীরা আপার কন্ঠে উত্তেজনা ঠিক পায়। তিতিরের মনে হয় সাদাসিধে জীবনটা মন্দ নয়। এর মধ্যে তিতিরের রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে।রেজাল্টের দিন এক কান্ডই করেছে।দুপুরে রাফি বাসায় ফিরেছে গম্ভীর হয়ে। ফিরেই বললো,
-রুমে আসুন
তিতির রাফির গম্ভীর কন্ঠে না চমকালেও উদ্বিগ্ন হলো।
-বলুন
-ব্যাগ গোছান।আপনাকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসবো।
-কেন?
-আপনি মহা অন্যায় করে ফেলেছেন।আপনার বাবা বলেছিল আপনি খুব ভাল মেয়ে। তেমন পড়াশোনায় ভালো না। কিন্তু…
তিতিরের গলা শুকিয়ে গেল।
-কিন্তু?
-আরে! আপনি ফিজিক্স থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছেন। কম কথা!আমাকে বলেন নি আপনি এত ভাল ছাত্রী।
তিতির ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললো।রাফি বিব্রত হয়ে উঠে এলো।
-আরে আপনি কাঁদছেন কেন?আমি ঠাট্টা করছিলাম তো।
তিতির রাফির শার্টের হাতায় নাক মুছতে মুছতে বলেছিল,
-আমাকে ভয় দেখান? হু? রাতের খাবার বন্ধ।
রাফি হেসেছিল।ও একটা বাচ্চা মেয়ে পেয়েছে। আদুরে, উষ্ণ, ভালোবাসাময়।
.
সবেই ক্লাস থেকে বেরিয়েছে রাফি।এর মধ্যে ফোন বেজে উঠলো।
রাশেদ ভাই ফোন দিয়েছে।আজ মীরা আপার ডেলিভারি হওয়ার ডেট। ফোন ধরলো রাফি।
-হ্যা রাশেদ ভাই
-তুই কই রে?
-এইতো ভার্সিটি তে।
-আব্বার সাথে কথা বল তো।
-রাফি বাবা
-হ্যা আব্বা
-তুমি তাড়াতাড়ি সদরে আসো।
-কেন? কোনো সমস্যা আপার?
-না। মীরার নয়।তিতিরের।মীরার টুইন বাচ্চা দেখার পর থেকে ভেউ ভেউ করে কেঁদেই চলেছে। আমার মেয়েটা কখনো এমন ভেবলি গোছের ছিল না তো।
-আমি আসছি
রাফিকে দেখে তিতিরের কান্না আরো বাড়লো। রাফিকে হতভম্ভ করে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।রাফি তিতিরের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
তিতির রাফির শার্টের হাতায় নাক মুছতে মুছতে বললো,
-আমার বাচ্চা চাই
তিতিরের বাবা, মা, রাশেদ, রাফি সহ আশেপাশের দুই একজন নার্স – ডক্টর দুমুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তারপর এক সাথে হেসে উঠলো সবাই।রাফি বিব্রত গলায় বললো,
-তোমার সাথে এটা নিয়ে রাতে কথা বলি তিতির?
-না। এক্ষুনি।
রাশেদ বললো,
-নাও, হয়ে গেল আজকে।
তিতিরের বাবা বললো,
-আহা! জামাই আমার!!
তিতিরের মা মুচকি হাসলো।
রাফি তিতিরকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-আব্বা, আপনার মেয়ে যেভাবে কিছু হলেই নাকের পানি চোখের পানি এক করে।বাচ্চা হওয়ার পর তো আমাকে বাচ্চা, বাচ্চার মা ;দুটো বাচ্চা সামলাতে হবে।অফিস কে করবে ভাবছি।মেটারনাল লিভ নিবো আমি।
হেসে ফেললো আবার সবাই।রাফি তিতিরের কানে কানে বললো,
-মেয়ে, আজ রাত থেকে দশটা মাস তো ধৈর্য ধরতেই হবে ।
তিতির মুখ লুকালো রাফির বুকে।