সেদিন অঞ্জলি টানা চারটা ঘন্টা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল আমার জন্য। ওর চোখ দুটো ছিল সামনের দিকে প্রায় স্থির। একটিবারের জন্যও মেয়েটা জায়গা ছেড়ে নড়েনি।
প্রতিদিনের মত আড্ডা দিতে গিয়েছিলাম রূপক মামার পাবলিসিটির দোকানে। যেয়ে দেখি দোকানের সামনের ছোট্ট গলির মাথায় নিজেকে সামান্য আড়াল করে অঞ্জলি দাঁড়িয়ে আছে। ওখানেই ওর বাসা। আমার জন্য শামসুর হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে অপেক্ষা করছে কখন আমি আসব আর উত্তরে ফিরতি একটা চিঠি লিখে আবার শামসুর হাত দিয়ে পাঠাব। আর সেই পূর্ব-পরিকল্পনাহীন অপেক্ষায় কেটে গেছে চারটা ঘন্টা।
ওর সাথে আমার সম্পর্কটা তখন মাস দুয়েকের। শুধু এই একবার নয় কিন্তু এই মেয়ের ধৈর্য্য আমাকে বার বার অবাক করেছে। এই দুইমাসের ভেতর ও আমার জন্য ভাইয়ের হাতে একাধিক বার মার খেয়েছে। ওর ভাই ওকে রান্নার জন্য রাখা চ্যালা কাঠ দিয়ে বেপোরোয়া ভাবে মারতো। ওর বাবা মা, আত্নীয় স্বজন ওকে সুযোগ পেলেই এই সম্পর্ক নিয়ে অপমান করতো। কিন্তু ও ছিল অবিচল। আমার প্রতি ওর বার বার ধৈর্য্যের পরীক্ষা দেখে আমি মুগ্ধ হতাম, গর্ব হত আমার। আমি আমার সারাটাজীবন ধরে চেয়ে এসেছিলাম খুব সাধারণ একটা মেয়েকে ভালোবাসবো আর সেও আমাকেও প্রচুর ভালোবাসা ফেরত দিবে। আর অঞ্জলির রূপে সেই মেয়েটিকে পেয়ে আমার থেকে বেশি খুশী হয়তো আর কেউ ছিল না।
অঞ্জলি যে আমাকে অন্ধের মত বেছে নিয়েছিল সেটাও কিন্তু নয়। আমরা দুই বন্ধু একইসাথে ওকে পছন্দ করলাম। সাধারণ বন্ধু নয়। যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু আমরা নিজেদের মাঝে কোন কলহ করলাম না। নীরবে চুক্তি হয়েছিল যে আমাদের মধ্যে যে ওকে কনভিন্সড করতে পারবে অঞ্জলি হবে তারই। আর অঞ্জলি আমার হয়ে গেল। এটা নিয়ে আমার অনেকদিনের ভুল ধারণা ছিল যে আমার সুন্দর করে কথা বলা আর স্মার্টনেসের জন্য অঞ্জলি আমাকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সত্যিটা দেরি হলেও আমি বুঝেতে পেরেছিলাম।
আজকাল বেশিরভাগ মেয়েরা ছেলেদের দেখে পছন্দ করার সময় দুটি দিক খুব শান্ত এবং শীতলভাবে খেয়াল করে। একটা হলো বাহ্যিক দিক। প্রথমত ছেলেটির উচ্চতা, তার গায়ের রং, চেহারা, তার ব্যবহার, তার জনপ্রিয়তা এইসব আর আরেকটি দিক হলো ছেলেটির বংশ কেমন? বাবা কি করেন? ননদ-দেবর কয়জন? নিজেদের বাড়ি আছে কিনা কিংবা নিদানপক্ষে একটা ফ্ল্যাট আছে কিনা? সরকারী চাকুরী করে কিনা করলেও তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণী না তো? প্রাইভেটে করলে স্যালারি অন্তত পঞ্চাশ হাজার/এক লাখের উপরে তো? এইসব।
জসিম উদ্দীনের রাখালী কবিতার মত গ্রাম্য রাখালের দেয়া কলমি ফুলের নোলক কিংবা হিজল ফুলের মালার সরলতায় আজ আর কোন মেয়ে ভালোবাসতে চায়না। সে অন্য এক যুগে হত। অন্য এক সময়ে সেই ভালোবাসার অস্তিত্ব ছিল।
মেয়েরা এখন তাদের সঙ্গী নির্বাচনে উপরের সবকিছু মস্তিষ্কে ঢেলে এক জটিল গানিতিক সমীকরণ মেলাবার চেষ্টা করে। আর এই সমীকরণে দুর্বল চলকগুলো একের পর এক বাদ পড়তে থাকে।
আসলে এগুলো বলে আমি মেয়েদের উপর দোষারোপ করছিনা। কারণ প্রতিটা মানুষের অধিকার আছে নিজেদের ভাল, নিজেদের মন্দ নিজের হাতে নির্বাচন করার। আর আজকাল মেয়েরা শিক্ষিত এবং অনেক বেশি সচেতন।
গল্পে ফিরে আসি।
জয় ছিল আমার থেকে খানিকটা লম্বা, তুলনামূলক ফর্সা আর সুন্দর। দুইজনকে পাশে রাখা হলে কোনভাবেই আমাকে পছন্দ করার সুযোগ নেই। তবুও অঞ্জলি আমাকে পছন্দ করলো কারণ ছিল জয়ের বাবা। যিনি থেকেও নেই। কোন একটা কারণের ওর মায়ের সাথে বাবার সম্পর্কে একটা টেনসন ছিল তাই ও মাকে নিয়ে থাকে ওর মামাবাড়িতে। ওর মা ছোট একটা চাকুরী করে ছেলেকে মানুষ করার আপ্রাণ সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। জয়ের বাবা না থাকা যার পিছনের ওর কোন দোষ নেই এটাই হয়ে গেলে অঞ্জলির চোখে ওর সবথেকে বড় অযোগ্যতা। আর ও সমীকরণে বাদ পড়লো।
জয় অঞ্জলিকে পছন্দ করেছিল, ভালোবেসেছিল। হয়তো আমার থেকেও বেশি। আমার আর অঞ্জলির সম্পর্ক নিয়ে প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিল। যেদিন ও জানতে পারলো আমাদের সম্পর্কটা হয়ে গেছে সম্ভবত ও সেদিন আমাকে ছাড়া প্রথমবার একা একা নদীর পাড়ে গিয়েছিল। হয়তো কেঁদেছিল।
আমি অঞ্জলিকে শুধু ওকে বলেছিলাম একটা বছর অপেক্ষা করো তারপর তোমাকে নিয়ে আসব। শুধু একটা বছর। ও বলতো, করবো। এক বছর কেন? যতদিন পারি করবো। আমি তখন যেন এক অদ্ভুত সুখে ভেসে চলছিলাম। বার বার এটাই মনে হত এই মেয়েটার ভালোবাসার প্রতিদান দেবার ক্ষমতা আমার নেই।
তারপর একদিন সকালে উঠে সেই রূপক মামার দোকানে গেলাম যার সামনে অঞ্জলি চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক মাস আগে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম অঞ্জলি পালিয়ে গেছে ওর একবোনের দেবরের সাথে। সেই ছেলে একটা মোবাইল কোম্পানীতে চাকুরী করে আর আমি ছাত্র। এইবারের সমীকরণে চলক হিসাবে বাদ পড়লাম আমি।
আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগা উচিৎ, কষ্ট পাওয়া উচিৎ কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমার এসব কিছুই মনে হচ্ছিল না। আমি শুধু জয়কে খুঁজে বের করলাম। তারপর ওর পাশে বসে একটা বেনসনের অর্ধেকটা টেনে বললাম, আজ এটা পুরোটা আমার লাগবে তুই আরেকটা ধরা।