নাবিলা ফোন দিয়ে বললো, ও মা হয়েছে। বিশ্বাস করি নি। সেদিন বিয়ে হলো, এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা! ওকে বললাম, সেদিন তোর বিয়ে হলো, এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা? তুই ঢপ দিচ্ছিস।
– ঢপ? তোর সময় জ্ঞান আছে? আমার বিয়ের দুই বছর হলো!
– দুই বছর? এই তো সেদিনের কথা? এত তাড়াতাড়ি দুই বছর চলে গেলো?
মুখে বললাম। সেই সাথে মনে মনে হিসাব কষলাম। ঠিক ই তো, দুই বছর পার হয়ে গেছে নাবিলা’র সংসার হবার। অথচ আমার মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা! কিভাবে চলে গেল দুই বছর , বুঝতেই পারলাম না! দুই বছর এত্ত ছোট সময়?
– তুই যেমন ভূত হয়ে মামার ঘাড়ে চেপে বসে আছিস, সময় তো আর তেমন বসে থাকে না! বলি কি, আর কতদিন এভাবে? কোন একটা আয়ের পথ বেঁচে নিয়ে মামার ঘাড় হতে তোর বোঝার ভূতটা সরিয়ে নে।
না পরের ঘরে গিয়েও মোটেই বদলে যায় নি! আগের মতোই সূচনা পেলেই সেই তসবির মতো জপতে শুরু করে আয়ের পথ খুজে নিতে! ও কি জানে সেই কাজটাই করছি এখন।
– আচ্ছা বাদ দে ওসব। বলি, ছেলে না মেয়ে হয়েছে?
.
– আমি বলবো কেন? তুই এসে দেখে যাবি তোর ভাগ্নে না কি ভাগ্নি হয়েছে। বল আসছিস কবে?
– আসছি কবে মানে? নারে, যাওয়া হবে না ।
– তাহলে আর কখনো তোর সাথে কথা বলবো না। কক্ষনো না। তোর সাথে আমার বন্ধুত্বের এখানেই ইতি।
নাবিলার শ্বশুড় বাড়িতে এসেছি। এ নিয়ে দ্বিতীয় বার। এর আগে ওর বিয়ের সময় এসেছিলাম। আমাকে বাইরে বসতে দিল । ওর শ্বাশুড়ি বললো, বাবা এখন ঘরে যাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ বাইরে বসে থাকতে হবে।
ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি, কেন? কিন্তু তা করলাম না। অভদ্রতা হতে পারে! আঙ্গিনায় চেয়ার এনে দিল, তাতে বসলাম।
নাবিলা ঘরে । ওর বাচ্চা ঘরে। ওকে আর ওর বাচ্চা দেখার জন্যই আসা। অথচ ঘরে যাওয়া যাবে না! ভাবলাম কিছু সময়ের জন্য! না দীর্ঘ আধঘন্টা যাবৎকাল পর্যন্ত বসে থাকতে হলো। অপেক্ষা করতে করতে মেজাজটাই খারাপ হচ্ছে? ঘরের ভেতর কি এমন কাজ- যার জন্য এত সময় আমাকে বাইরে বসে থাকতে হচ্ছে? একসময় ভাবতে হলো, না! চলে যাই।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। নাবিলার শ্বাশুড়ি এসে বললো, বাবাজি, যাও, তোমার ভাগ্নিকে দেখো।
তাহলে নাবিলা মেয়ের মা হয়েছে! ঘরে ভিতরে গেলাম । নাবিলা শুয়ে আছে। বাচ্চাটা পাশে। নিষ্পাপ শিশুর ঘুমন্ত মুখ, স্বর্গীয় প্রশান্তি মাখা। বাচ্চার অমন চাঁদমুখে কালির দাগ! কপালে কালো টিপ । সব মায়েরাই তাদের সন্তানের কপালে কালো টিপ দেয়। এতে না কি কারো নজর লাগতে পারে না! সত্যতা কতটুকু জানি না। কিন্তু রহিমা ভাবীর কোলের ছেলেটা যখন মারা যায় তখনো ছেলেটার কপালে এ টিপ ছিল! তবু কিভাবে যে আযরাইল আঃ এর নজর লাগলো ছেলেটার উপর!
নাবিলা আমাকে দেখে মুচকি হাঁসলো। বললাম, কেমন আছিস?
– ভালো। তুই?
– আমিও। ভাগ্নি কেমন আছে?
– ভালো। কান্না করছিল, দুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে এখন। তুই এত শুকিয়ে গেছিস ক্যান?
– শুকিয়েছি!
– হু । খুব চিন্তা করিস বুঝি আজকাল?
– আরে না!
– সরি রে, তোকে এতটা সময় বসে থাকতে হলো। পরের বাড়ির নিয়ম, বুঝিস ই তো!
– বাড়ির নিয়ম?
– নিয়ম ঠিক না। ঠিক লোককথার মতো বিশ্বাস আর কি। তুই বাইরের মানুষ। কত যায়গা ঘুড়ে তবে এসেছিস। তোর সাথে অশুভ কিছু যদি ঘরে আসে তবে তো বাচ্চার ক্ষতি হবে । সেজন্যই তোকে কিছুক্ষণ বসে রাখা।
– অশুভ কিছু মানে?
– ভূত প্রেত।
– তুই এসব বিশ্বাস করিস? যত্ত সব কুসংস্কার।
– আমার বিশ্বাসে কি আসে যায়? এটা তাদের বাড়ি, তাদের সন্তান? বুঝবি কি? তুই তো মেয়ে না!
ফেরার কিছু আগে, নাবিলার শ্বাশুড়ি বললো, বাবাজি যখন যাবে, তখন বৌমার সাথে কোন কথা বলবে না।
– কেন?
– তাহলে বাচ্চা আর বাচ্চার মায়ের ক্ষতি হবে।
আমি বলে আসাতে বাচ্চা আর বাচ্চার মায়ের ক্ষতি হবে! কি সাংঘাতিক আরোপ! ভাবা যায়? আমার বলে আসা কথাগুলো কি ভাইরাস ছড়াবে? না কি কোন বিষাক্ত গ্যাস ছড়াবে – যার ফলে মা ও বাচ্চার ক্ষতি হবে! এ তো স্রেফ অন্ধ বিশ্বাস, এ কুসংস্কার।
অথচ সত্য এ যে, কারো কাছে গেলে, তার কাছ হতে বিদায নিয়ে না আসলে সেটা হয় অভদ্রোচিত আচরন ! অথচ এখানে উল্টো। নাবিলার শ্বাশুড়ি ঘর হতে বের হতেই নাবিলাকে বললাম, কি রে কি বললো এসব? সত্যি?
– কি জানি রে! জানি না। শুধু যাওয়ার মহুর্তে তুই আমাকে বলে যাবি না। ব্যাস । বুঝেছিস।
বুঝলাম। বেশ ভালোকরেই বুঝতে হলো। এ ছাড়া ভিন্ন পথ কোথায়? বললাম, তুইও?
তবু ভুল করলাম। আসার জন্য যখন বের হলাম তখন বলেই ফেললাম, ” থাকরে যাই। ভালো থাকিস। আর আমাদের বাড়ি আসিস। ” বলা শেষ হতেই জিহ্বাগ্রে কামর দিলাম! এ কি করলাম? বাধ্য হয়ে আবার বসতে হলো। কিছুক্ষণ পর আবার যখন উঠলাম ফেরার জন্য, তখনো ভুল করলাম। চতুর্থ বার কোন কথা না বলে বোবার মতো ঘর হতে বের হয়ে এলাম।
একটা বাচ্চা জন্মমাত্রই সে কুসংস্কার এর মাঝে বেড়ে উঠতে শুরু করে, সে বাচ্চা ভবিষ্যৎকালে কতটুকু আলোর সন্ধান পাবে – সে খোদা মালুম।