খুট করে শব্দ হতেই শম্পা বুঝতে পারে সোহাগ এখন ভাল মানুষের মুখ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে দরজা ভেঙ্গে দুজনকেই ঘুসি মেরে বলে, এই তোদের সাহিত্যচর্চা! শূয়োরের বাচ্চা – সোহাগ, এতদিন কচি কচি মেয়েদের পেছনে লেগে এখন বুড়িদের কোল খাচ্ছিস! তোর দাঁত আমি ফেলে দেব হারামির বাচ্চা, খচ্চর। ফাতনা ছিঁড়ে খোজা করে দেব তোকে, কুত্তার বাচ্চা!
ফিজিক্সের বই উলটে পড়ে আছে। আগামীকাল পরীক্ষা। শম্পার মাথায় কিছুতেই পড়া ঢুকছে না। দপদপ করছে শিরা, লালকালো ফুটকি দিয়ে রাগ দৌড়াচ্ছে মাথার ভেতর। কি অসহ্য এই চারপাশ। কি অসভ্য এই মহিলা। বাবাইকে বলে দেবে? প্রলয় হয়ে যাবে বাড়িতে। কিন্তু তাতে কি সোহাগ লম্পট থেকে দরবেশ হয়ে যাবে? লম্পট অলওয়েজ লম্পট। পেন্সিলের শিস ভেঙ্গে হেড ডাউন করে কাঁদতে থাকে শম্পা।
বেগুনী শিফন হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে। উপুড় হয়ে কবিতা লিখছে জয়া। কবিতা জয়ার প্রাণ। ওর কবিতা নিয়ে আজকাল বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন সাহিত্যের ঠেক থেকে প্রশ্ন উঠছে, ‘কে এই মহিলা? মহিলা, নাকি কোনও পুরুষ ছদ্মনামে কবিতা লিখে চলেছে!’ খবরগুলো ভক্তদের কাছ থেকে শুনে জয়ার বুকের ভেতর আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। তার কবিতার শরীর সাধাসিধে, শব্দ গঠন ও বাক্যে অনেক গভীর ভাবনা থাকে। দুটি শব্দের মাঝে গোপনে শুয়ে থাকে অনেক না বলা সুখ দুঃখের ভেজা শীতল পাটি। যারা আবিস্কার করতে পারে তারা হাত খুলে প্রশংসা করে। জয়ার কবিতা পড়ে মনেই হয় না কোনও নারী এমন কবিতা লিখতে পারে! যা কিছু সমালোচনা ওই ছন্দ নিয়ে।
বৈশাখী অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে সোহাগ আসতেই জয়া বালিকা বালিকা ভাবে হাত ধরে বলে ওঠে, “তুমি আমাকে ছন্দ শেখাবা সোহাগ?”
সোহাগ ভেতরে ভেতরে চমকে যায়। জয়া আপা কি কিছুই জানে না তার সম্পর্কে? নাকি সব জেনেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে? সাহিত্য আসরে খুকি খুকি ন্যাকামি অনেকেই করে। বিশেষ করে বড় বড় ছেলেমেয়েদের মা হয়েও খুকিপানা করতে এই সব মহিলাদের বোধহয় ভাল লাগে। লেডি জোকার জোকার যে লাগে তা অবশ্য এরা বোঝে না। আবার কিছু মহিলা আছে কঠিন মুখ করে গল্প কবিতা নিয়ে পরিমিত আড্ডা দিয়ে ঘরে ফিরে যায়। অনেকটা পাটিসাপটা পিঠের মত। এরা বেশ সচেতন। ভালই জানে সঠিক প্যাঁচে মুড়তে না পারলে পিঠা লেপটে যাবে। সোহাগকে এরা পাত্তা দেয় না। জিগোলো ভেবে এড়িয়ে যায়। এই সব সতী সাধ্বীরা চলে যেতেই লেখক কবিরা মুক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে ফুট কাটে, সিক্রেশনে ঘাটতি আছে রে। মহিলাদের শরীরের মাপ থেকে হরমোন সিক্রেশন কিছুই বাদ যায় না। সিনিয়র কবিরাও জিভের ঝোল টানে, “কি সোহাগ হিপটা মাপতে পারছ নাকি এখনও ফ্লুইট বাজাইতাছ?” -সোহাগ লজ্জা পায় না। হাবেভাবে বোঝায়, “কি যে বলেন, উনি ত আমার আন্টি লাগেন!” মন্তুর দোকানে হাসির ধুন ছোটে। সেই মূহূর্তে বুদ্ধদা থাকলে সোহাগের পিঠ চাপড়ে বলেন,
“মাতৃহীন পুরুষ কবিদের কি মা কিবা সখী, সবার বাঁটেই মুখ দেওয়ার অধিকার আছে। লজ্জা কিসের বস, চালিয়ে যাও!”
সোহাগের বুকের কোথাও জ্বলে উঠে। মা নেই, বাবাও বিয়ে করেনি দ্বিতীয়বার। নারী বিবর্জিত জীবনে সোহাগ জানত না প্রচণ্ড মাথা ব্যাথায় একটি নারীর হাত কি করে শুষে নিতে পারে সব ব্যাথা অথবা জ্বরতপ্ত শরীরে একজন নারী কি করে জল ঢেলে ধুয়ে দিতে পারে আগ্রাসী জ্বরের তামাটে রঙ। মুসুরি ডাল কেমন মহার্ঘ হয়ে উঠতে পারে সামান্য পেঁয়াজ, রসুন জিরা আর একটি নারীর চুড়িপরা হাতের সম্ভারে। সোহাগ বোঝে মা কিম্বা বউদের ফ্রেমবন্দী ছবি হয়ে দেয়ালে ঝুলে থাকতে নেই। বুদ্ধদার দেওয়া বিশেষ সিগ্রেট একটানে অনেকখানি নামিয়ে সোহাগ ইশকুল টিচার গোলগাল মৃত মায়ের কথা ভাবে। মায়ের ছবির সামনে ধূপ জ্বালাতে একদিনও ভুল হয় না বাবার। মার শাড়িগুলো রোদে দিয়ে তুলে রাখে এখনও। বুদ্ধদা একসময় মায়ের প্রেমিক ছিল। কেন যেন মা রিজেক্ট করে দিয়েছিল লোকটাকে। নাকি মা বুঝে গেছিল, বুদ্ধদা একজন খেলারাম মাছরাঙ্গা! মাছের জন্যেই কেবল জলকে ভালবাসে! জলের জন্যে বুদ্ধদার গভীর গোপন কোনও ভালবাসা নেই!
জয়ার কথায় চমকে উঠলেও সামলে নেয়। জয়াআপু আবার সবাইকে চান্স দেয় না। ও বোঝে, সব জেনেই জয়াআপু ওকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সোহাগ ঠিক করে, সে যাবে জয়া আপুর বাসায়। সত্যি বড় ভাল কবিতা লিখেন উনি। কেবল ছন্দের সামান্য খামতি রয়েছে এই যা সমালোচনা।
সোহাগ চোখ কুঁচকে রোদ ঠেকায়, “পারিশ্রমিক পাবো তো?” -জয়া কিশোরী মেয়েদের মত ঢলে উঠে, “কবিতার জন্যে আমি পাতালের অন্ধকারও ছানতে পারি, সোহাগ।” ছন্দে সোহাগের জ্ঞান অসাধারণ। মাঝে মাঝে তাই অন্য রকম ভাব নেয়। কবিরাও খাতির করে। Treat দেয়। সোহাগ শুনেছে জয়াআপু একটি অর্ধ জীবন যাপন করে। হঠাৎ বিয়ে। সন্তানসহ বয়স্ক দোজবর স্বামী। জয়াআপুর জন্যে মায়া হয়। কেমন পদ্মপাতা জীবন!
জয়ার স্বামী অফিস গেলেই শুরু হয় ছন্দবদ্ধ খেলা। তাতে দরজা বন্ধ হয়, জোরে গান বাজে আর মাঝে মাঝে কিছু আস্বাভাবিক শব্দ, নিঃশ্বাস, কাতরতা শোনা যায়। কলেজে পড়া শম্পার বুঝতে অসুবিধা হয় না, কি হচ্ছে। কিন্তু সোহাগ? কিছুদিন আগেও কলেজের রাস্তায় তার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকত। শহরের এমন কোনও মেয়ে নেই যারা সোহাগকে পছন্দ করে না। সোহাগের হন্ডা যে রাস্তা দিয়ে ছুটে যায় সেই রাস্তার তরুণী কিশোরীদের বুকে বেজে যায় একটি প্রশ্ন, কার জন্যে সোহাগ? কার জন্যে? সেই সোহাগ শম্পাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে কতবার। শম্পা ইগনোর করে গেছে। কিন্তু বুকের কোথাও সোহাগ ছিল। মনে মনে খুব চেয়েছে সোহাগ সাচ্চা প্রেমিক হয়ে উঠুক। কেবল ওর প্রেমিক।
সারাদিনে আজকাল কোনও কথাবার্তা হয় না জয়ার সাথে। তাতে জয়ার কিছু যায় আসে না। নর্মাল সংসার করে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার জন্যে তাগাদা দিচ্ছে। তাদের রেজাল্ট কার্ডে নাম্বার কম এলে টিচারদের সাথে কোন্দল করে নিজেই পড়াচ্ছে। অফিস থেকে হাবি ফিরলে নিজের হাতে চা বিস্কিট চানাচুর মুড়ি মেখে, তাতে পেয়াজের বড়া ফেলে সুখী দম্পতির মত বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে। আলুভর্তায় ঘি জবজবে করে মাখিয়ে ছোট মেয়ে শায়লাকে সাবধান করছে, “খবরদার ভর্তায় হাত দিও না। জানো তো তোমার শম্পা দিভাই এ বাসার রাজকন্যা! নাকি আবার বলতে হবে!”
শম্পার চোখে পানি চলে আসে। নিজের মায়ের মুখ সে দেখেনি কিন্তু মা মানেই তো জয়া। সে তো তাই জেনে দেখে এসেছে। এমনকি মামাবাড়ির শহরেও কেউ কখনও বলে না সে সুমীর মেয়ে। সুমী নামের পনের বছরের মা-মেয়েটি হারিয়ে গেছে জয়া নামের সাহসী মা-মেয়েটির কাছে।
দাদাবাড়িতে থেকে ইশকুল ফাইন্যাল পাশ করে এখানকার কলেজে ভর্তি হয়েছে মাত্র চার মাস হলো। একটু একটু করে চিনে নিচ্ছে সবকিছু। এরমধ্যে কলেজের প্রাক্তনীদের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ে হাত তালির সাথে ফ্রেন্ড রিকু পাচ্ছে ভুরি ভুরি। সোহাগ যেচে কথা বলেছিলো শম্পার সাথে। অন্যরকমের একটি ভাল লাগায় ভাসছিল শম্পা। বন্ধু অপর্ণা সাবধান করে, এই শহরের কৃষ্ণ হচ্ছে সোহাগ। কিশোরী, যুবতী, কম বেশী বয়সের বিবাহিত অবিবাহিত সকল নারীর কৃষ। অন লাইনে পাওয়া যায়। হোলসেল প্রাইস। তো সাবধান।
প্যারেন্টস মিটিঙয়ে কালো হয়ে যায় জয়ার মুখ। শম্পা তো খারাপ স্টুডেন্ড নয়। তবে? কদিন কেমন বদলেও গেছে। কথা বলে না। দূরে দূরে এড়িয়ে থাকে। তা থাকুক। কলেজে উঠেছে। এখন তো ছোট্টটি আর নেই। কিন্তু রেজাল্ট কেন খারাপ হবে? বই পাড়া দিয়ে শম্পার বন্ধু রুদালীদের বাসা হয়ে ঘরে ফিরছে জয়া। আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। যে কোনও সময় বৃষ্টি আসবে। কেমন যেন অনুভূতি বাজছে বুকের ভেতর। সোহাগ অবশ্য বলেছিল এবার কলেজে নতুন আসা একটি মেয়ে অসাম কবিতা আবৃত্তি করেছে। ও ফিদা হয়ে আছে সেই মেয়ের জন্যে। সে কি শম্পা? শম্পা কি তবে সোহাগের প্রেমে পড়েছে! জয়ার মাতৃহৃদয়ে অশনি গাইতে শুরু করে। কিছুতেই না। সবে সতের বছর শম্পার। অনেক দূর যেতে হবে ওকে। শম্পার টেবিল, কবিতার বই, ল্যাপটপ খুঁজে সোহাগের কোনও চিহ্ন পায় না জয়া।
শম্পা কি তবে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছে সোহাগকে? কবিতা লেখা মাথায় ওঠে জয়ার। শম্পাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। সাতমাসের শম্পা তার বুকের ভেতর তোলপাড় করে খুঁজে নিয়েছে মাতৃত্বকে। মা না হয়েও সে শম্পার মুখে তুলে দিয়েছে তার দুগ্ধহীন অপাপ স্তন। ভুল সে কিছুতেই করতে দেবে না শম্পাকে। দোতলার সিঁড়ি ভাঙ্গে জান্তব গতিতে, ‘শম্পা শম্পা।’
শম্পা নেই নীচের ঘরে। ছ্যাৎ করে উঠে বুক। ছোট মেয়েকে ঝাঁকিয়ে জিগ্যেস করে, “তোর দিভাই কই রে? কোথায় শম্পা? কেউ এসেছিল বাসায়? কে কে?” উত্তেজিত কর্কশ জিজ্ঞাসায় চমকে উঠে শায়লা। মা কি পাগল হয়ে গেছে? দিভাইয়ের রেজাল্ট ভাল হয়নি বোঝা যাচ্ছে। তাই বলে এত রাগের কি আছে? এ তো ফাইন্যাল না। অপর্ণাদি আর দিভাই পাওয়ার হাউসের বড় পুকুরের পাশে গল্প করছে। ম্যাথ ফিজিক্সে দুজনেই ফেল। অপর্ণাদির বাবা ধাওয়া দিয়েছে। অগত্যা দুজনেই– ছুটতে ছুটতে আসে জয়া। পা উলটে স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। নখ ভেঙ্গে গেছে সিওর। কি যে এক ভয় ওকে ছুটিয়ে নিয়ে আসে, শম্পা শম্পা। জয়ার পেছনে শায়লাও ছুটেছে।
চমকে উঠে শম্পা আর অপর্ণা। কি হলো রে? ভাইটা অসম্ভব চঞ্চল। ভাইয়ের কি কিছু হলো? এ শহরে অনেক পুকুর ডোবা। সাঁতার জানে না তবুও জলে নামবেই শায়ক। সারাক্ষণ টেনশনে থাকে সবাই। শম্পা ছাড়া কাউকে পাত্তা দেয় না শায়ক। গেল রাতেই শম্পাকে বলেছে, “প্রমিজ দিভাই, তিনদিনের ভেতর আমি সাঁতার শিখব। শিখবই।”
উদ্বিগ্ন শম্পা ছুটে আসে, “মা, কি হয়েছে? মা! ওমা!” শম্পাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে জয়া। অপর্ণা দ্রুত শায়লার কাছে গিয়ে সভয়ে জানতে চায়, “কি হয়েছে রে শায়লা? শায়ক ঠিক আছে তো?”
শঙ্খের মত ফাঁকা গলায় বলে উঠে জয়া, “আমি কি তোর মা নই, শম্পা?” শম্পা বিহ্বল। “আমার তো তোরা ছাড়া আর কিছু নেই রে।”
মাকে জড়িয়ে ধরে শম্পা, “কি হয়েছে মা?”
জয়া বসে পড়ে মাটিতে। সর্বহারা গলায় বলে উঠে, “হয়তো অনেক ভুল করি। যদি বলিস আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দেব।”
“মা! কেউ কিছু বলেছে তোমাকে? কে, কি বলেছে? বল মা!” ব্যাকুল হয় শম্পা।
ফর্সা ভেজা গাল, জয়া পাখির মত চোখ তুলে বলে, “তুই হেরে গেলে যে আমি হেরে যাই শম্পা।”
শায়লা এসে জড়িয়ে ধরে। ঘন হয়ে জমে থাকা মায়া মেঘের পাশে দাঁড়িযে বাবার জন্যে অপর্ণার মন কেমন করে উঠে। বাবার চোখে জেগে থাকা স্বপ্নকে এই মূহূর্তে পড়ে ফেলতে পারে সে। “কাকিমা চললাম, আসিরে শম্পা…”