ধূপকাঠির গন্ধ

ধূপকাঠির গন্ধ

বাথরুম থেকে মোবাইল এর রিংটোন শুনতে পেয়েই কোনওরকমে হাউস কোটটা গলিয়েই বেরিয়ে আসে দোয়েল। আজ মামনির গিফ্ট করা অনলাইন ড্রেসটার ডেলিভারি হবে। মামনি ঋতব্রত-র মা।সামনেই ঋতব্রত আর দোয়েলের আন্দামান ট্যুর। দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমা।

বেরোতে বেরোতেই ফোনটা কেটে গেল। টাওয়েলটা ভেজা চুল থেকে সরিয়ে হেয়ার ড্রায়ারটা খুঁজতে থাকে দোয়েল। সদ্য দমদম থেকে শিলিগুড়ি শিফ্ট করার দরুন ফ্ল্যাটটা এখনও অগোছালো। যদিও ঋতব্রত ছমাস আগেই এসেছে, একটি ন্যাশনালাইসড ব্যাংক-এর ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসাবে। দোয়েল এসেছে দিন কয়েক হলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে ডাঁই করা অনেক গুলি ধূপকাঠির বাক্স। দোয়েল মনেমনে হাসে আর বলে “নাস্তিক মায়ের ছেলের আবার দেখো কী ধূপকাঠি প্রীতি!”

সত্যি! দমদমের বাড়িতে থাকতে দেখেছে মামনি পুজো-আর্চা একদমই করতেন না।ভীষণ আধুনিক! অথচ কি স্নেহশীলা! ঋতব্রত মায়েরই ধারা পেয়েছে। নইলে কি আর…

হঠাৎই সুনামির চিৎকারে সম্বিৎ ফেরে। “বৌদি একজন মহিলা এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি চললাম। পরে এসে ঘর মুছবো।দরজাটা কিন্তু খোলা রইলো।” বলেই সুনামি -সুনামির মতো চলে যায়। সুনামির আসল নাম মালতী। এই অ্যাপার্টমেন্টে সে সুনামি নামে পরিচিত। পুরো অ্যাপার্টমেন্টের কারও না কারও ঘরে সকাল থেকে সন্ধ্যে সে কাজে ব্যাস্ত। দোয়েল মনে মনে ভাবলো “কে আবার দেখা করতে এলো, এই অ্যাপার্টমেন্টের কেউ হবে হয়তো।”

বৈঠকখানায় এসে দোয়েল যা দেখলো তাতে পায়ের তলার মাটি ক্রমশ সরে যেতে লাগল। মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করছে। এখুনি হয়তো টাল খেয়ে পড়ে যাবে। সামনেই সোফায় বসে আছেন সরমা।

সরমা সান্টুর মা। সান্টু… যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল সপ্তদশী দোয়েল। একমাস সংসারও করেছিল রেল কলোনির একটা ঘুপচি ঘরে। দিন দশেকের মধ্যেই অভাব আর মাতাল সান্টুর মারধোরে সব মোহ ঘুচে যায়। একদিন কাকভোরে পালিয়ে গিয়েছিলো বাবা-মায়ের কাছে।

তারপরই কলকাতায় চলে যাওয়া। আর কখনও জলপাইগুড়ি আসেনি। একে একে নতুন স্কুল, নতুন কলেজ, নাচ, গান, নতুন বন্ধু-বান্ধব – সব কিছুর মধ্য দিয়ে কবেই অবাঞ্ছিত অতীতটাকে মুছে দিয়েছে সে।

সরমা জড়সড় হয়ে বসে আছে। রোদ থেকে এসেছিল বলেই সরমা ঘামছিল। হঠাৎই পর্দা সরিয়ে দোয়েলকে বেরিয়ে আসতে দেখে তার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।

যে তীব্র যন্ত্রণায় তার স্বামী আজ শয্যাশায়ী, যে তীব্র যন্ত্রণায় ন্যুব্জ শিরদাঁড়াটাকে জোর করে সোজা করে জীবনযুদ্ধে শরিক হয়েছে সে, আজ সেই যন্ত্রণা সমস্ত রুহ ভেঙে বুকফাটা হাহাকার হয়ে বেরিয়ে এলো।

এই সেই মেয়ে যার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে বছর বারো আগে হাজির হয়েছিল তার একমাত্র ছেলে সান্টু। বলেছিল মা এই দেখো তোমার বৌমা। বছর কুড়ি বয়স তখন। পৌলট্রির ব্যাবসা করতো ছেলেটা। সংসারটাও চলে যেত তাতে। বিয়ের দিন দশ যেতে না যেতেই শুরু হলো পুলিশ আর পার্টির ছেলেদের হুমকী। আর তার জেরেই অনেক রাতে এক গলা মদ গিলে চোরের মতো বাড়িতে ফিরত। মেয়েটার গায়েও হাত তুলতো। বড়োলোকের আদুরে মেয়ে, তায় এত কাঁচা বয়স -সহ্য করবে কেন! একদিন পালিয়ে গেল বাপ মায়ের কাছে।

কিছুদিন পর মেয়েটার বাবা এসেছিল কতগুলো ছেলে নিয়ে। কি সব কাগজে সই-সাবুদ করে, মোবাইলের সিম কার্ডটা ভেঙে দিলো। আর সেইসঙ্গে মুছে দিয়ে গেল পুতুল খেলা বিয়ের সব চিহ্ন। সান্টুটা আর কোনদিনও মেয়েটার কথা বলেনি। দিনের পর দিন একটু একটু করে অন্ধকার আর নেশায় তলিয়ে গেল। যে আগুন নিয়ে ও খেলেছিল, সেই আগুন দিয়েই নিজেকে চিরদিনের মতো পুড়িয়ে শেষ করলো আর ভেঙে দিয়ে গেল বৃদ্ধ, নিঃসহায় বাবা-মায়ের শিরদাঁড়াটা।

সরমা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন আর অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে একটাই অস্ফুট শব্দ উচ্চারিত হলো, “বৌমা!” নিজেকে সামলাতে পারলো না দোয়েল, বলে ফেললো, ” আপনি এখানে কেন এসেছেন? কার সঙ্গে এসেছেন? কি চান?”

সরমা কোনওভাবে নিজেকে সামলে বলে উঠলো ভাঙা গলায় “বৌমা …আমি তো শুধু ….জেরক্স কপিটা….। ” দোয়েল উত্তেজিত ভাবে বলে ফেলে, “থামুন! আমি আপনার বৌমা নই…. কত টাকা চাই আপনার? কে আপনাকে পাঠিয়েছে? আপনি কি আমার সংসার ভাঙতে এসেছেন?” সরমা আঁচলের প্রান্ত দিয়ে চোখটা মুছে, শান্ত ভাবে বলে “না মাগো! আমার টাকা পয়সা লাগবেনা। সান্টুটা চলে যাবার পর থেকে আমি তো ধূপকাঠি বিক্রী করি…..তাতে পঙ্গু বুড়োটাকে নিয়ে চলে যায়। মেয়েটা পেশেন্টের ডিউটি করে। নাতনিটারও বিয়ে হয়ে গেছে”। দোয়েলের গলাটা নরম হয়ে আসে বলে, “আপনারা শিলিগুড়ি এলেন কবে?” সরমা বলে, “তুমি তো রানীকে দেখোনি। রানী এনজিপির কাছে একটা কলোনীতে থাকতো। জামাইটা অকালে চলে গেল…. তারপর থেকেই…..”।

ধীরে ধীরে উঠে পরে সরমা, দরজার কাছে এসে বলে, “জানি ভালো আছো …তবু আশীর্বাদ করি ভালো থেকো….সুখে থেকো….”

সরমা চলে যায়। হতভম্বের মতো সোফায় বসে পরে দোয়েল।

সান্টুর মারধোরের দিন গুলোতে সরমাই দোয়েলকে আগলে রাখতো। অভাবের সংসারে সবচেয়ে ভালোটুকু তার পাতে দেবার চেষ্টা করেছেন।

আজ বড় অবহেলা আর উপেক্ষা নিয়ে চলে গেলেন সরমা। দোয়েল মনে মনে ভাবে একটা প্রণাম করলে কি বা ক্ষতি হতো! এমনতো নয় যে সরমাকে দেখলে তার সুখের সংসারে ভাঙন ধরতো। ঋতব্রত তো জানে কিছুটা। বাকিটা দোয়েল বলতে চেয়েছিল, ঋতব্রতই শোনেনি।

দোয়েলের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে। বারবার মনে হয়, ভর দুপুরে এসেছিলেন… এক গ্লাস জলও সে দিতে পারেনি। কেন এত রূঢ় ভাবে কথা বলল সে। আর হয়তো কোনওদিন দেখা হবেনা।

বারো বছর এমন কিছু বেশি সময় নয়। কিন্তু একদিন জোর করে যে অধ্যায়টা বন্ধ করে দিয়েছিল, আজ যেন একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে সেই বন্ধ করা অধ্যায়ের একটা ছেঁড়া পাতা তার কাছে উড়িয়ে এনে দিলো। ঝাপসা হয়ে যাওয়া সান্টুর মুখটা আজ অনেক দিন পর মনে পরে গেল। না, ভালোবাসা নয়। …তবে আজকের পরিণত মনে সান্টুর জন্য কষ্ট হচ্ছিল বৈকি!

ভাবতে ভাবতে কখন বেলা পরে গেছে খেয়াল করেনি দোয়েল। দরজাটাও বন্ধ করেনি। মালতী ইতিমধ্যে এসে ঝাড়ু দিতে দিতে বক্তৃতা দিয়ে চলছে। হঠাৎই মালতী প্রশ্ন করে, “বৌদি ওই বুড়িটা কে? সকালে দাদাবাবু নিয়ে এসে বসালো জল দিলো নিজের হাতে, তারপর তোমাকে ডাকতে বলে বেরিয়ে গেল।” দোয়েল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “দাদাবাবু নিয়ে এল? কখন?” “সকালে যখন তুমি স্নান করছিলে, তখন”…

মালতীর কোনও কথাই আর দোয়েলের কানে আসেনা। মনে মনে যোগসূত্র খুঁজতে থাকে। হঠাৎ -ই চোখে পড়ে সোফার নিচে একটা প্যাকেট। দোয়েল এগিয়ে এসে প্যাকেটটা খোলে। প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসে কতগুলো ধূপকাঠির বাক্স আর সরমা দাসের সচিত্র ভোটের কার্ডের একটা জেরক্স কপি। ধূপকাঠির বাক্স থেকে একটা ধূপকাঠি বের করে নেয় দোয়েল। ধূপকাঠির সুরভিত সুবাসের সঙ্গে ধীরে ধীরে সব ধোঁয়াশা কেটে যেতে থাকে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত