ষাটোর্ধ ভদ্রলোক মাথায় কলপ করেন, ঠিক কালো নয়, লালাভ । পায়ে স্নিকার, পিঠে ল্যাপি । মেট্রো রেলে সিনিয়ার সিটিজেনদের আসনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেঁথে ফেললেন বিতানের দৃষ্টি । বিতান উঠে দাঁড়াল । ক্লান্তিতে মাথা ঝুঁকে আসছে । আজ ভোর থেকে অবস্হান বিক্ষোভ ছিল শিক্ষা দপ্তরের বাইরে । বিতানরা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি নিয়ে আন্দোলন করছে । সবাই বলল, তাই ।
বিতান সবুজ পুলিস, গেরুয়া স্বেচ্ছাসেবক বা লাল মিছিলে যেতে পারে নি কোন দিন । দুটো সহজ টিউশনির পয়সায় সিগারেট পুড়িয়ে পড়ে থাকে মিস কল । তানি অবশ্য কল ব্যাক করে । ওর অবশ্যম্ভাবী শেষ প্রশ্ন, আর কত দিন ? তারপর শব্দহীনতার ধূসর উপত্যকা । ফোন কেটে যায় । মেট্রো থেকে নেমে ভদ্রলোক রিক্সায় গুছিয়ে বসলেন । রিক্সাওয়ালা অহেতুক বেল বাজিয়ে বিতানকে অতিক্রম করল । ও হাঁটছে । সদূর একটা ভ্যানিশিং পয়েন্টে মিলিয়ে যায় রিক্সাটা । শহরে দিগন্ত বলে কিছু হয় না । নজর রোধ করে ফ্ল্যাট বাড়ি । তার উপরে চাঁদ । ভ্যানিশিং পয়েন্টটা যেন চাঁদে চলে গেছে ।
বাবার বন্ধু রনিকাকু ভাল পদে চাকরি করেন । বাবা বোঝে না, ওই চেয়ার থেকে ছাপোষাদের ঝাপসা দেখায় । তবু বিতান দেখা করেছিল । বোন চায়নার কাপে স্বচ্ছ্ব দার্জিলিং চা । তিনি বললেন, আসলে এখন কোম্পানীগুলো অবসরপ্রাপ্ত লোকেদের মডারেট স্যালারিতে জয়েন করাচ্ছে । তাতে অভিজ্ঞতা আর ক্যাচ দুটোই মাগনা লাভ । বিতান ক্যাচ ফসকাল ।
তানি বলেছিল দেখা করবে । শেষ কথাটা ও কী বলবে, বিতান তবু শুনতে চায় । আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে মিহি সন্ধ্যা । তানির এক ফালি চুল উড়ছে উতল বাতাসে, ও সতর্কতার সাথে খেয়াল করল না । পারফিউমের গন্ধটাও যেন আগলে রেখেছে নিজের শরীরে । হলুদ বুক শালিখ দিনের শেষ আলো খুঁটে খায় । উৎসাহী রাতচরা পাখিটা হোঁচট খেল সূর্যাস্তের মসৃণ আলোয় । তানি কখনও জিজ্ঞাসা করবে না, আর কত দিন ? চাঁদ উঠেছে নিঃশব্ধে । সেই আলো ভেঙে যায় গঙ্গায় । বিতানের বলতে ইচ্ছা করছিল, কোন দিন চাঁদ মাখা জল হাতে নিয়ে দেখি নি, হাতে চাঁদ ওঠে কি না । তানি, কত দিন বলি নি, ভালবাসি । তোমার ওই প্রশ্নটা –
বিতান ঘাড় ঘোড়াল । তানি চলে গেছে । আন্দোলনরত চাকরী প্রার্থীদের উপর পুলিশ নির্মম লাঠি চালিয়েছে । বিতান লাঠি খায় নি, ও পালিয়েছে । রাতে হাসপাতালে গিয়ে অনেক বন্ধুর রক্ত দেখেছে । সেদিন রাতে ও খেতে পারে নি । খেতে পারে নি সেই অশ্রাব্য শব্দটা, তুই পালালি কেন ?
একটা ভ্যানিশিং পয়েন্ট ক্রমশঃ গ্রাস করছে বিতানকে, নিঃশব্দে ।
তানি যাকে বিয়ে করেছে, সে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পেয়েছে কয়েক লাখ গুঁজে । এর মধ্যে কোন শ্লাঘা নেই । জয় আছে । রাস্তায় যেদিন দেখা হয়েছিল, তানি খুব সাবলীল ছিল । বিতান অহেতুক রুমালে মুখের অস্বস্তি মোছে । সেদিন তানির শেষ কথাটা শোনা হয় নি । আজ বলল সটান । দুটো ব্যর্থতার কোন ফারাক নেই ।
ব্যর্থতাও ভাগ করে নিতে হয় দায় কমাতে । ইদানীং বিতানের বাবার সাথে অশ্লীল শব্দের চালাচালি হয় । বিতান মুখ ফসকে বলে বসে, কোমড়ের জোড় না থাকলে জন্ম দাও কেন ? ষাটোর্ধ ওই ভদ্রলোক দু কেজি গলদার অর্ডার দিয়ে ক্লাসিকের নতুন প্যাকেটের মোড়ক খোলেন । তিনি ছেলের বউকে হীরের আংটি কিনে দেন ।
তানি আংটিটা দেখিয়ে বলেছিল, আসলে ওনার ছেলে তো খুব সহজ সরল, তাই তিনি আমার উপর ভরসা করেন বেশী ।
সহজ সরল কথাটার মানে বিতান বুঝেছিল দিন কয়েক বাদে । ছেলেটির স্নায়ুর সমস্যা আছে ।
ষাটোর্ধ ভদ্রলোক মাথায় কলপ করেন, ঠিক কালো নয়, লালাভ । পায়ে স্নিকার, পিঠে ল্যাপি । মেট্রো রেলে সিনিয়ার সিটিজেনদের আসনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেঁথে ফেললেন বিতানের দৃষ্টি । বিতান উঠে দাঁড়াল না । ভদ্রলোক এবার আক্রমণ করলেন, লেখাপড়া শেখ নি ?
সমাজের নিয়ম জান না ? সবাই এক সাথে বলে উঠল, সমাজের নিয়ম ।
ঠিক তখন ভ্যানিশিং পয়েন্টটা খুলে যায় । বিতান সিট ছেড়ে নেমে পড়ল পরের স্টেষানে । তানিকে একটা মিস কল করল । কল ব্যাক করে তানি । বিতান বলল, আর অপেক্ষা করতে হবে না । আমি তোমাকে আদর করব ।