কিছুই ভালো লাগছে না রাজকুমারীর। আকাশে সোনা রংয়ের রোদ্দুর। গাছে গাছে মিষ্টি পাখি। এ ডাল থেকে ও ডাল। এই পাতা থেকে ওই খানে লাল হলদে ফুলের ভেতর। কাঠবেড়ালি দৌড়ে চলে গেলো ওই উঁচু ডালে। বাগানে শীতের বাতাস। রাজকুমারী শুধু জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। কত উঁচু বাড়ি তার। কতবড় জানলা। প্রহরীরা দিনরাত লাঠি উঁচিয়ে ডাক দেয় ‘কৌন হ্য়? কৌন হ্য়?
রাজকুমারীর জানলার শেষে বিরাট বড় রাজবাগান। সেখানে যত্ন করা ফলফুল। শীতের দিনে ডালিয়া, গোলাপ, ক্যালেন্ডুলার ভিড়। গরম এলে মাধবীলতা, জুঁই। ছোটছোট বনসাই গাছ। ডালপালা ছেঁটে মজার মজার হাতি, ঘোড়া, বাঘ বানিয়েছে মালী। রাজকুমারী তবু হাসেনা। এমনকি এক ঝুড়ি ধপধপে সাদা স্নোবলেও না। রাজকুমারী পড়ে, লেখে, গানও গায়। কেবল রং তুলি নিলে একটা আকাশ এঁকে বসে থাকে চুপটি করে। রাণীমা কোলে নিয়ে চুমো দেন। জিজ্ঞেস করেন-
-কি হয়েছে রাজকুমারী? শুধু আকাশ কেন? জল নেই, মাঠ নেই, মেঘ নেই! এ তবে কেমন ছবি মাগো?
রাজকুমারী আরো একটা আকাশ এঁকে বলে
-ভেজা পাতায় একবিন্দু নীল আর তারপর মিলেমিশে আকাশ হলো! আমি আঁকলাম কই? বাকি সব ভালো লাগে না আমার। শুধু আকাশ ভালো লাগে।
রানীমা ভয় পেলেন। চলে গেলেন। রাজামশাইকে কেঁদেকেটে বললেন
-আকাশ ছাড়া কিছু ভালো লাগে না তার! কি হবে এবার!?
রাজামশাই হেসে বললেন
-ছেলেমানুষ! এখুনি সোনার তারা জড়ানো জামা আর কাচের জুতো পেলেই মনখারাপ ভ্যানিস!
রাজকুমারী চুল বাঁধেনা। মনখারাপ তো। এলো চুলেই জানলা দিয়ে বাগান দেখে একলা। খাঁচার টিয়ে গান শোনায়। গান ফুরোলেই চিত্কার! খেতে দাও মা!
খাঁচার ভেতর বেদানা দেয় দাসী। টিয়া বেদানা খায়। ঘাড় দুলিয়ে বলে – বাহ্!বাহ্!বাহ্!
রাজকুমারীর মনখারাপ বাড়ে।
আজ আকাশে মেঘ জমেছে খানিক। বিকেলেই চাদ্দিক অন্ধকার হয়ে এলো। জানলা ঘিরে নেমে এলো কাচের পর্দা। স্পষ্ট করে দেখা যায়না। তবুও দেখা যায় গাছেগাছে ঠোকা লাগছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সাদা আলোয় চোখ ধাঁদিয়ে যায়। দারোয়ান তখন খড়ের চালায়। ফুল, ফল, পাতা নষ্ট হচ্ছে ঝড়ে। রাজকুমারী আবার আকাশ আঁকে। এইবারে একটা ঝড়ের আকাশ ঠিক! কালো কালো! রাগী! রাজামশাই দেখে বলেন
– বাহ্! খুব সুন্দর। তোমার জন্যে এনেছি কি দেখো! কাচের জুতো। হাঁটলে মুখ দেখা যায়! জরির জামা; তারার মতো ঝলমল করে রাতে! আর তো নেই মনখারাপ?! আমি এখন আসি। নতুন জামা, নতুন জুতো পরিয়ে দিস দাসী।
এদিকে ঝড় বাড়ছে। ঘূর্ণি বাতাস। বরফ নামছে বৃষ্টিতে। কাচের দরজা গেলো ফেটে। দাসীরা সব রইরই করে চেঁচিয়ে উঠলো একসাথে। বাজ পড়ল কাছেই। শব্দ, আলোয় ধাঁধাঁ লাগে।
রাজকুমারী বেরিয়ে পড়েছে একাই। জানলা খোলা ছিল। কাঠবেড়ালির ছোট্ট ছানাটা জলে ভিজে কাঁপছিল। জুতোয় করে তাকে কোটরে রেখে দিল রাজকুমারী। কত জল! কত বৃষ্টি! পাতায় পাতায় কি নাচন! রাস্তাঘাট জলে ভাসছে। ভয় করছে রাজকুমারীর; ভালোও লাগছে! এত বৃষ্টি সে আগে কখনও দেখেনি যে! বৃষ্টি নামলে চুপটি করে পালঙ্কে শুয়ে থাকাই রাজবাড়ীর নিয়ম। আজ নেহাত দুর্ঘটনা! বাজ পড়ল। কাচ ফাটল। দাসীরা ভয়ে চোখ বুজলো আর রাজকুমারী বেরিয়ে এলো কাঠবেড়ালির ছানার জন্যে একাই। আহা! সে এখন আরামে ঘুমোচ্ছে। রাজকুমারীর মাফলারে দিব্যি সুন্দর গা গরম। বৃষ্টিতে মিষ্টি ঘুম। রাজকুমারী হাত বুলিয়ে দিল! কি নরম! যেন পশম!
এখন গাঢ় রাত। বৃষ্টি কমছে। বাতাসে জোলো গন্ধ। ব্যাঙ গাইছে কটর কট! কটর কট! গ্যাং!
আজ আর ফিরবেনা রাজকুমারী। সামনে থেকে সূর্য ওঠা দেখবে! বেশ হবে। কখন যেন ভোর হয়েছে! কাক ডাকছে কাছেই। ঘুঘু উড়ছে সর্ষেক্ষেতের পেটে! যেখানটায় শুয়ে রয়েছে রাজকুমারী… পাশেই কুলুকুলু নদী। এতোবড় বটের ছায়া! কত পাতা বিছিয়ে আছে পথে। ভারি নরম একটা রোদ্দুর ছুঁয়ে রয়েছে পাজোড়া একসাথে। যেন ভারি ভাব! কতদিনের বন্ধু। রাজকুমারী হাত রাখলো রোদ্দুরে। হেসে ফেললো।
দূরে যেন কিসের সুর! ও কি বাজে? কে বাজায়? কেমন গান? কি অর্থ? রাজকুমারী চোখ রাখলো দূরে!
একটা খালি গা ছেলে। তারই মতো বয়েস। মাথায় ফেট্টি বাঁধা। ধুলোবালির ফুলপ্যান্ট। রঙবেরঙের সেলাই। শীতের হাওয়ায় খড়ি ফুটেছে মুখে। অবশেষে দেখা হয় দুজনের। ছেলেটির হাতে মলিন একতারা । সে বাজনা থামিয়ে হাসে। রাজকুমারী অবাক হয়!
-তুমি আমায় অভিবাদন করবেনা? আমি যে রাজকুমারী!
– হাসলাম যে। ভালো লাগেনি?
-কিন্তু আমি যে রাজকুমারী! আচ্ছা বেশ! তুমি কে বলো?
-আমি রাখাল। গরু চরাই। ওই দেখো ওরা ওখানে ঘাস খাচ্ছে কেমন। খুব মজা হয়।
-কেমন মজা?
-গাছের ফল …এই এত্ত বড়! কত্ত মিষ্টি। পেট পুরে খাই। ক্লান্ত হলে নদীর জল নিই চোখেমুখে। কি ঠাণ্ডা। নদীতে কত মাছ। কত রকম রং। বেঁটে, মোটা, গোল কত রকম আকার। যাবে তুমি?
-আমাকে যেতে আছে? আমি তো রাজকুমারী।
-আমিও তো রাজকুমার। এই আমার রাজপাট।
-কই দেখি?
-ঐ যে দেখছো পাহাড়চূড়া! দেখো বরফে রোদ লেগে কেমন রামধনু! সবই তো আমার। তোমারও।
-একসাথে কি করে হবে? রাজ্যে তো রাজা এক।
-আমিও যদি রাজা নাই হই তবে তোমার সাথে কথা কই কি করে? সমানে সমানে না হলে কি বন্ধু হতে আছে?
-এসব কথা কে বলেছে তোমায়!?
-আছে এক! দাড়ি দাদু। অনেক অনেক গান লিখেছে। ওর সুরেই তো বাজনা বাজাই। ভালো লেগেছে তোমার?
-লেগেছে বেশ! শুনলেই মনে হয় রোদ্দুরে দাঁড়াই। এখন চলো রাজত্ব দেখি তোমার!
দুজনে মাঠভর্তি সূর্যমুখী আর উড়তি টিয়ার হাসি শুনল। গিরগিটিদের রং দেখলো। নদীর নিচে বালি দেখলো। বালির ভেতর কত শ্যাওলা! আলো লেগে রামধনু হয়। আলভর্তি জল দেখলো। দীঘিজোড়া কচুরিপানা আর তেচোখা মাছ গুনলো। রাখাল তাকে দাড়ি দাদুর কত কত গান শোনালো। আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দীঘির ওপারে কমে আসা সূর্য দেখে রাখাল বলল
-বাড়ি যাও তবে। আবার এসো কখনো। ভ্রমর রঙের মধু খাওয়া দেখাব তোমায়।
-আজই দেখাও।
-আজ আর নয়। পরে একদিন। এবার থেকে আকাশ শুধু নয় অনেক পাখি আর ঘাসফুল এঁকো। সবই তো চেনো এখন। এবার থেকে সবাই বন্ধু। সবাই রাজা; রাজার রাজত্বে।
রাজ্যে এখন বসন্ত এসেছে। শীত নেই আর। রোদেরও তাপ নেই তেমন। গাছে গাছে কোকিল ডাকছে। বাগানে কত ঘাসফুল। মালী ওদের জল দেয়না। মাটির সাথে ভারি ভাব ওদের; ঠিক বেঁচে থাকে। রাজকুমারীর আর মনখারাপ হয়না। সে এখন অনেক কিছু আঁকতে পারে। তেচোখা মাছ। দীঘি। সূর্য। পাহাড়। গরু আর একতারা হাতে রাজা রাখাল। দিব্যি আঁকে সে; সবই যে নিজের চোখে দেখা। শুধু দাড়িবুড়োকে আঁকতে পারেনা রাজকুমারী।
রাখালের সাথে দেখা হলো একদিন। দাড়িবুড়োকে দেখার আবদার করতেই রাখাল বলল
-বুড়ো গান লিখেছে আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে, এই আকাশে। বুড়োকে ওইখানে পাবে …ওই গাছের ছায়ায়। বুড়োকে এখানেও পাবে এই একতারায়, ওই নদীর মাছ… অথবা আমাতে …তোমাতেও!
– সে কেমন করে বুঝবো? আমিতো পারিনে! তুমিই শিখিয়ে দাও!
-এই ধরো একদিন ভয় করছে খুব। অথবা বড্ড মনখারাপ। কাকে মনে পড়ে?
-রাজামশাই …রাণীমা …উঁ, উঁ …মিস্টুনি সখী …কাঠবেড়ালির ছানা ওদের কথা ভাবি।
-কেন ভাবো বলো?
-ভাবি আর কই? মনে পড়ে যায়? অমনিই! নিজে নিজেই।
-ভালোবাসলে অমনই তো হয়।
-ও! তাই তবে হবে।
-হুঁ! দাড়িবুড়ো কে ভালবাসলেও ….এমনই কাণ্ড হবে। মনখারাপে, ভয়ের রাতে চোখ বুজলেই দেখতে পাবে স্পষ্ট। তোমার এই রাজ্য …এই গাছপালা …ওই কুলুকুলু নদী সব, সবটা জুড়ে দাড়িবুড়োর ছবি।
-ও! শুধু ভালবাসলেই অমন হয় বুঝি?
-হয় গো। ভালবাসলে সব হয়। সবকিছুই হয়।
-আর ভালবাসা কি?
-ওই যে যেবার ঝড়বৃষ্টি! প্রথম বেরিয়েছিলে …কাঠবেড়ালির ছানা ভিজে ঠকঠকিয়ে কাঁপছিল, তাই তো? ওর জন্যে কষ্ট হলো। তুমি ওকে কোটরে শুইয়ে দিলে। এইসবই তো ভালবাসা মেয়ে। অন্যের কষ্ট বুঝতে পারলে; ভালবাসা সে তো আপনি জন্মে যায়। ভালবাসা ভীষণ সহজ। কঠিন কিচ্ছু নয়।