এক চামচ মিষ্টিদই

এক চামচ মিষ্টিদই

“মেল অর ফিমেল?”

“কেন? আমাকে দেখে বোঝা যায় না?”

“না না! সরি ম্যাম্! দাঁড়ান দেখি আপনার জন্যে”

সুবিশাল সুদৃশ্য হাইপারমার্কেটের এক কোণে তাকে তাকে সাজানো দেশি বিদেশি ব্র্যান্ডের বডি স্প্রে । তার সামনে দাঁড়িয়ে কলেজফেরতা জয়শ্রী দিদি । বাইরে গনগনে দুপুরের প্যাচপেচে গরমের ছ্যাঁকা । কিন্তু একটু আগে সহপাঠিনীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপের মধ্যে তিনগুণ ছ্যাঁকা খেয়ে এসেছে সে ।

সকালে জয়শ্রী দিদির ক্লাসে ঢোকার মুখে “জয় ফের মেরে ফেলবে দেখছি”, বলে পাঁচ হাত দূরে সরে বসেছিলো তার এক সহপাঠিনী চিত্রা । তার সাথে সাথে প্রায় তিন-চারজন মিলে মুখ বিকৃত করে সরে যেতে চাইছিলো । কিন্তু সাত বাই দশ ক্লাসরুম ইতিমধ্যে ভর্তি তাই ঘামের দুর্গন্ধ ঠেকাবার সাধ্যি কার আর থাকে ? ক্লাসে অনেকে স্লীভলেস টপ বা চুড়িদার বা ব্লাউজ পরে আসে এই ঘেমো পরিবেশে কিঞ্চিৎ জুতসই লাগার তাগিদে । কেউ কেউ গায়ে সুগন্ধী সাবান ঘষে আসে, কেউ হাতে মুখে ঘাড়ে সেন্টসহ ময়শ্চারাইজিং ক্রিম মেখে আসে, অনেকে আবার বগলে আর বুকে কয়েক গ্যালন ডিও স্প্রে ঢেলে আসে । কিন্তু সব গন্ধকে ছাপিয়ে যায় জয়দির বিদঘুটে ঘাম । সারা পিঠ, বগল, বুক, পেট ঘেমে একাকার । কালচে ঘেমো ক্যানভাসে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সাদা ব্রা-এর নিজস্ব চিত্রপট । দেখে মনে হয় যেন ব্রা-ও বেরিয়ে পালিয়ে আসতে চাইছে । ঘামের এই ভয়ানক গুমোট রূপ সহ্য করার মত ক্ষমতা তার নেই কিনা ?!

“অ্যাই জয় করিসটা কি ?”, কামানের গোলার মত আছড়ে পড়ে পাশের বেঞ্চ থেকে । জয়দি ওড়না দিয়ে মুখে গলায় ঘাড়ে ঘাম মুছতে ব্যস্ত । পরনে তার তেলচিটে মেরুন রঙের চুড়িদার । চার বছর আগে তার বাবা কিনে দিয়েছিলেন অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে । তার একসপ্তাহের মধ্যে তিনদিনের জ্বরে মারা যান চিকিৎসার অভাবে । সংসারে শুধু বিধবা বৃদ্ধা মা । বছর আটেকের বড় এক দাদা ছিলো জয়ের । সে ওদের ফেলে কোথায় চলে গেছে একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে । টিউশন করে যৎসামান্য যা পায় তাতে দুজনের সংসার কোনোরকমে চলে যায় ।

“ওরে মুখপুড়ি শুনছিস কি ? স্নানটান করে আসিস না কি?”

“হ্যাঁ করি তো”

“তাহলে এমন বিকট বোটকা গন্ধ বেরোয় কেন তোর গা থেকে ? তোর নিজের নাকে লাগে না বুঝি?”

“কি করবো বল্? রোজ স্নান করে আসি কিন্তু বাসে যা ভিড় তার উপর প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে কলেজে আসতে হয় । দেরী হয়ে গেলে দৌড়ে আসতে হয় ।”

“তোর তো রোজ দেরী হয় । আজও দৌড়ে এসেছিস নাকি? ঘেমে নেয়ে পুরো পেত্নী হয়ে গেছিস শালা । তার সাথে হাড়জ্বালানো এমন দুর্গন্ধ । নাঃ এবার তোকে অন্য ক্লাসে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে দেখছি ।”

“ঠিক আছে তাই করিস ।”

“আচ্ছা এতো দেরী করে আসছিস ইদানীং । ইয়ে কেউ আছে নাকি যে তোর এই উৎকট গন্ধের প্রেমে একেবারে গদগদ ?”, চরম খোঁচা আসে পেছনের বেঞ্চ থেকে ।

অপমানে সারামুখ লাল একুশ বছর বয়সীর । দেখতে তেমন সুশ্রী নয় । একটুখানি বোঁচা নাক । ঠোঁটের পুরুভাব অস্বাভাবিক । গায়ের রং তার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ কিন্তু কেমন যেন পালিশ নেই । দেখলে ভেজা স্যাঁতসেঁতে পালিশ-না-করা দেয়ালের কথা মনে পড়ে যায় । শরীরের গড়ন কিন্তু চমৎকার । তার শরীরের মত শরীর সচরাচর দেখা যায় না ।

 

“প্লিজ দেখুন ম্যাম । এটা এখনকার সেরা ডিও ।”, বলে ঢাকনায় একটু স্প্রে করে তার নাকের সামনে তুলে ধরলো অল্পবয়সী অনভিজ্ঞ কাস্টমার কেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট । চমকে গিয়ে একটু সরে গেলো জয়দি ।

“দাম কত রে ?”

“আড়াইশো মাত্র, ম্যাম !”

মাথা নেড়ে সে বোঝালো যে এতো দাম দিতে অপারগ । তার বাজেট নিদেনপক্ষে সত্তর-আশি । কিন্তু সেই বাজেটের মধ্যে আর কিছু না পেয়ে গড়িয়াহাটের ফুটপাথ থেকে নন-ব্র্যান্ডেড একটা সস্তা ডিও কিনে নেবে ভেবে ঠিক করলো সে ।

অ্যাসিস্ট্যান্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে গেলো পাশের ষ্টলে । একসেট প্যাড কিনতে । স্টেফ্রি-এর একটা স্মলেস্ট প্যাক তুলে সে ঘুরতে গিয়ে কার সাথে যেন ধাক্কা খেলো । হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলো প্যাকটা । তড়িঘড়ি করে সেটা তুলতে গিয়ে সে দেখলো একজন মধ্যবয়স্ক লোক সেটা নিজের হাতে তুলে নিলো আর তার দিকে বাড়িয়ে দিলো ।

লজ্জায় ভয়ে ঘৃণায় মরমে প্রায় মরে যাচ্ছিলো জয়দি এমন অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে । কোনো ভদ্রলোক এই কাজ করতে পারে ? ন্যূনতম সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারে নিশ্চয় কিন্তু তা বলে প্যাড পর্যন্ত হাতে নিয়ে তার দিকে তাক করে বাড়ানো । অচেনা হাত । অচেনা মুখ । অচেনা পরিস্থিতি । অচেনা অস্বস্তি । যেখানে শরীরের বিশেষ একটি জৈবিক প্রত্যঙ্গ নিয়ে লৈঙ্গিক রাজনীতি, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং বৈষম্যের তারতম্য লক্ষণীয়, সেখানে একজন অচেনা মধ্যবয়স্ক পুরুষের সামনে এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকাটা জয়দির রুচিতে না কি বিবেকে কাঁটা বিঁধছে। সেই বিঁধে যাওয়া কাঁটাটি আপনাআপনি অজস্র শাখা-প্রশাখা গজিয়ে সারা শরীরকে ভেদ করে দিতে চাইছে । অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণাও প্রবলভাবে অচেনা ঠেকছে তার কাছে । পরিস্থিতির সামাল দিতে পারবে না বলে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে এখুনি সে ।

“কি হল ? এই নিন আপনার প্যাক ।”, তাকে ক্ষনিকের জন্যে কাঁপিয়ে দিলো লোকটির ভারী এবং কর্কশ গলা ।

ভয়ে কাঠ হয়ে রইলো জয়দি । নিরুত্তর সে । শেষে লোকটি বিরক্ত হয়ে একটা বাস্কেট জোগাড় করে তাতে প্যাকটি রেখে জয়ের পাশে রেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো । পাশ কাটানোর মুহূর্তে একটি ধারালো অথচ স্পষ্ট কথা বলে তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো, “আমার নিজের মেয়ের জন্যেও একটা প্যাক কিনতে এসেছি । আপনার এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু হয়নি , আপনার মাসিক আপনি নিজে সামলান ।”

চোখে প্রায় অন্ধকার দেখলো , পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলো জয়দি । কোনোরকমে দাম মিটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সে । সোজা বাস ধরলো বাড়ি যাওয়ার জন্যে । ডিও-ঘেমো-ঝামেলা সব ভুলে গেছে ।

“মামণি এসেছিস ?”, বৃদ্ধা মায়ের গলা ভেসে এলো । জয়দির এখন কিছু ভালো লাগছে না । সকাল থেকে-ই চলছে নানা হ্যাপা । প্রায়শ তাকে যতরাজ্যের অস্বস্তিকর ঘটনার শিকার হতে হয় । সংসারের ভিতরের আর বাইরের অন্যায় ও অবিচারের সাথে তার পরিচয় ছিলো , কিন্তু আজকের সামান্য একটি প্যাক নিয়ে ঘটনাটি তার কাছে চূড়ান্ত রকমের রূঢ় লাগলো । নিজের অদৃষ্টকে দুষছে মনে মনে । ঘরে ঢুকে মাকে জড়িয়ে তার কি কান্না !

“কি হয়েছে তোর আবার? ক্লাসে আবার ঘেমো গন্ধের গল্প শুনতে হল বুঝি?”
“মা প্লিজ, আমার কিছু ভালো লাগছে না । আজ…”

“পরে শুনবো সব । এখন স্নানে গিয়ে গা-টা ধুয়ে আয় । যা ঘেমে গেছিস সত্যি তোর গা থেকে যা সব বেরোচ্ছে । আমার গা থেকেও এতো বাজে গন্ধ বেরোয় না “, মায়ের বিরক্তিসূচক ধমক ।

“সব বোঝো, না ! তুমি কত বাইরে বেরোও শুনি? মাসে মোটে একবার না দুবার । আমাকে তো রোজ বেরোতে হয় । সন্ধ্যায় আবার টিউশনে যেতে হয়”, গজগজ করতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো জয়দি ।

প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন বাথরুমে সে সম্পূর্ণ অনাবৃত । দেয়ালের একধারে টাঙানো বহুবছরের জীর্ণ ভাঙ্গা আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো । আন্দাজ করে নিজের শরীরকে মাপার । পাঁচ মিনিটের এই আত্মদর্শনের মধ্যে সে একটি শিহরণ অনুভব করে । গলার মধুসূদনসুলভ দীর্ঘতা, কাঁধদুটির নজরুলী বক্রতা, স্তনদুটির রাবীন্দ্রিক উন্মুক্ততা, কোমরের বঙ্কিমী বাঁক – নিজে নিজের রূপে অহংকার ফুটে ওঠে কবিতার মত । পেছনের ট্রেনের হুইসেলের শব্দ তার বড় প্রিয় । মাথার কাছে আধখোলা কার্নিশের ওপার থেকে দূর আকাশের চিলের সকাতর চিৎকার আছড়ে পড়ে এই নারীশরীরে । প্রতিটা ভাঁজ খুলে দিতে চায় নিখোঁজ খাঁজের খোঁজে । চারধারের দেয়াল তার এই সদর্প আত্মোন্মাদের সাক্ষী ।

পনেরো মিনিট বাদে বেরিয়ে এলো সে । মায়ের কাছে এসে হঠাৎ বললো –
“মা ভাবছি একটা স্লীভলেস ব্লাউজ পরবো । তোমার সেই বিয়েতে পাওয়া ব্লাউজগুলো পড়ে আছে না ? সেগুলোতে কাঁচি চালিয়ে হাতকাটা বানাবো । বগলে হাওয়া লাগবে । পিঠে হাওয়া লাগবে । পেটেও লাগবে । আরাম লাগবে । ঘামটাম বিশেষ হবে না । সেই সাথে গন্ধ উধাও ।”

মা শুনে বললো – “যা করিস মামণি । শুধু সাবধানে চলিস । রাস্তাঘাটে অনেক খারাপ লোক যায় ।” মায়ের গলা জড়িয়ে সে আশ্বাস দিলো । খাটের তলা থেকে পুরোনো ট্রাঙ্ক টেনে মায়ের কয়েকখানা ব্লাউজ বের করে আনলো, নিজের সেলাইয়ের দক্ষতায় বানিয়ে ফেললো দু-তিনটে সুন্দর স্লীভলেস ব্লাউজ ।

 

সন্ধ্যায় টিউশন সেরে বাড়ি ফেরার পথ ধরেছিলো সে । পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠলো –

“এইযে আপনি? কিছুদিন আগে হাইপারমার্কেটে ছিলেন নাকি ? দুপুরের শেষের দিকে ?”

জয়দির বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো । সেই কর্কশ আর ভারী গলা । ফুটপাথে তখনো লোকজনের ভিড় । হকারদের হইহল্লা । বাচ্চাদের কান-ঝালাপালা করে দেওয়া বায়না । পাশের রাস্তা দিয়ে চলা গাড়ির বেপরোয়া হর্ন , বাসের কালো ধোঁয়া , অটোচালকদের দৌরাত্ম্যের বাড়াবাড়ির মাঝে শুধু একমাত্র এই কর্কশ গলাটি তাকে ভীতিসন্ত্রস্ত করে দিলো । গলার আওয়াজের মধ্যে যেন রয়েছে একটি নিষ্ঠুরতা ছাপ, ছুরি দিয়ে কেটে ফালাফালা করে দেওয়ার মত । একেবারে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো । ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকলো সে ।

“আপনি দেখছি অযথা ভয় পাচ্ছেন”, লোকটি তার কাছে এলো । “আপনার রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন একজন বিরাট ক্রিমিনাল, কি এমন ক্রাইম করেছি শুনি আপনার সাথে যে আপনার মুখে রা পর্যন্ত ফুটছে না ।”

তার গলায় আত্মাভিমানের অভিব্যক্তির ঝাঁঝ এতো বেশি যে বাধ্য হয়ে জয়দি ভয়ার্ত মুখ তুলে তাকায় । লোকটিকে দেখতে ভদ্রলোক গোছের বলা যায় । চোখে সুষম ট্রাপিজিয়াম শেপড্ কালো ফ্রেমের চশমা । মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুলের কদমছাঁট । গোঁফদাড়ি কামানো । ছিপছিপে চেহারা । পরনে তার ধোপদুরস্ত শার্ট প্যান্ট । পায়ে পালিশ-করা-শু । কিন্তু কাঁধে বেমানান ঝোলাব্যাগ যা দেখলে বোঝা দায় লোকটি আসলে কি করেন ? কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের কেউ নাকি আধাকবি-আধাচাকুরীজীবী ? বয়স হয়তো পয়তাল্লিশের নিচে হবে না । হাইট বোধহয় ছ’ ফুটের কাছাকাছি । ধ্যাত এতো ভাবছি কেন আমি ? নিজেকে সংযত করলো জয়দি ।

“নমস্কার, আমি বিপিন চক্রবর্তী । কলেজের অধ্যাপক । ফিজিক্স পড়াই । একটু আগে কোচিং সেন্টার-এ লেকচার ঝেড়ে এলাম । পথে আপনাকে হেঁটে যেতে দেখলাম , চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না আমার ।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলার দরুণ জয়দি থতমত খেলো । খানিকক্ষণ পরে সে বুঝতে পারলো যে লোকটি বেশ আলাপী আর টিপিক্যালি বেশ ভদ্র । সে মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিলো এতক্ষণ । সেও প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললো – “আমি জয়শ্রী ধর । বাসন্তীদেবী কলেজে পড়ছি । বি.এ. ফাইনাল ।”

“বেশ বেশ । তা কোনদিকে আপনার বাড়ি ?”

“এইতো সামনের দিকে ।”

“চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি ।”

“না না ঠিক আছে । ধন্যবাদ । আমি একা যেতে পারবো । আচ্ছা আপনার মেয়ে আছে না ?”, জয়শ্রীর সতর্কতা-মিশ্রিত ভদ্রতা ।

“ইয়েস , তেরো বছরের মেয়ে আছে । মা মরা মেয়ে ।”

“ও”, জয়দি একটু থমকে গেলো । নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেলো ।

“আচ্ছা আসি এখন । ভালো লাগলো আলাপ করে আপনার সাথে ।”

জবাবে বিপিনবাবু মাথা নত করলো হাসিমুখে । সাথে সাথে, “এই স্লীভলেস ব্লাউজে আপনাকে ভালো লাগছে”, বলে থাম্বস্ আপ করলো ।

চমকে উঠলো জয়দি এই আকস্মিক মন্তব্যে । যেখানে ব্লাউজ নারীশরীরের ঊর্ধাঙ্গ ঢাকবার বিশেষ কাপড়মাত্র, সেই ব্লাউজের তলায় লুকিয়ে আছে এমনকিছু যা বাইরের জগতের কাছে খুব রহস্যময় এবং নারীলজ্জা সেই ধাঁধালো রহস্যের উল্টোপিঠ । একমাত্র রহস্যবাহী নারী স্বয়ং ধরতে পারে সেই গোপনীয়তার সুত্র যা নারীর অধিকারের চাবি । এই চাবিটা একমাত্র স্বামীর হাতে সমর্পণ করতে পারে যেকোনো বিবাহিতা নারী । সামাজিক সেই সীমিত অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী জয়শ্রীর সারা মনে কিন্তু-কিন্তু ভাব । সে বিপিনবাবুর কথাটির ভিতরে সেরকম ইঙ্গিত খোঁজার চেষ্টা করলো, কিন্তু কোথাও অশ্লীলতা বা যৌনতার আবেদনটুকুর আঁচ পেলো না । খুব সহজ অকপট এবং সপ্রতিভ প্রশংসা বলে মেনে নিতে বাধ্য হয় । এমন কমপ্লিমেন্ট প্রথমবার পেয়ে কিছুটা চমকিত হলেও বেশ লজ্জিত হয়ে পড়লো জয়দি । মন বলছে আরেকটু গল্প করি , ব্রেন বলছে দেরী হয়ে যাচ্ছে বাড়িতে মা একা । ভারী দোটানায় পড়ে গেছিলো সে । বিপিনবাবু যেন বুঝতে পেরে বললো – “আপনার অযথা দেরী করার জন্যে দুঃখিত । আশা করি আবার কথা হবে , আমার এই ফোননম্বর রাখবেন “, বলে বুকপকেট থেকে একটা বিল বের করে তার পেছনে নিজের মোবাইল নম্বর লিখে জয়দির হাতে দিলো । সেও আপত্তি করলো না নিতে ।

বাড়ি ফিরে মাকে সব বলে দিলো । এমনকি ব্লাউজের প্রশংসাও বাদ দিলো না প্রথম আলাপ-কাহিনী থেকে । মা শুনলো শুধু , কিছু বললো না । বাইরের দিকে তাকালো । এই দুনিয়া রহস্যের মূলে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ? নাকি সেই সমাজে নারীর বিশেষ অবস্থান ? শিল্প আর সংস্কৃতি মানুষের স্বভাবচরিত্র বুঝি নিয়ন্ত্রণ করে ? বিপিনবাবুর কথাবার্তা যথেষ্ট শিক্ষিতসমাজের পর্যায়ে ফেলা যায় নিশ্চয় , কিন্তু ভিতরে মানুষটি যে কেমন সেই সংশয় যেন কাটতে চায় না । তার কারণ আছে – ভূমিকা, মেজাজ ও বিশেষ করে অবস্থানের ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্যের কোনো জৈবিক অবদান নেই, আছে কেবল সাংস্কৃতিক অবদান । কিন্তু যুগ যুগ ধরে বহু পুরুষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে এসেছে যে জৈব কারণে পুরুষ শ্রেষ্ঠ ।

বেশ খানিকক্ষণের নীরবতা ভাঙিয়ে মা বললো – ” ঘুমিয়ে পড় মামণি । আর সমঝে চলবে বিপিনবাবুকে ।”, বলে হ্যারিকেনের আলো নিভিয়ে দিলো ।

 

“উফফ ! কি ঝড়বৃষ্টি রে বাবা ! আমার শাড়ীটাকে প্রায় উড়িয়ে দিতে চাইছিলো এই হতভাগা ঝড় !”, বলতে বলতে জয়দি কফিহাউসে একটা টেবিলে বসে পড়লো যেখানে ঘন্টাখানেক আগে থেকে বসেছিলো বিপিনবাবু । আর গভীর মনোযোগে একটা বই পড়ছিলো । মুচকি হাসি হাসলো সে শুধু । জয়শ্রীর ছাতাটা নিয়ে এক কোণে রেখে দিলো । সপ্তাহে অন্তত একবার দেখা করতো দুজনে । বয়সের এই ফারাক কখনো ভাঁটা আনতে পারে নি ওদের বন্ধুত্বে ।

“পুরো ভিজে এলি জয় !”

“হ্যা যা হচ্ছে বাইরে । তুমি কি বই পড়ছো এতো মন দিয়ে, বিপিনদা ? দেখি তো বইটা”

“ওই আর কি ?! দ্যাখ্”

“বাপরে ! কিসব কঠিন বিষয় নিয়ে পড়ো আমি কিছু বুঝি না । কোনোদিন আমাকে বুঝিয়ে দাও না কেন কতবার যে বলি বোঝাতে । আমি বুঝি খুব বোকা মেয়ে ?”, বইটি হাতে নিয়ে কয়েকটা পাতা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো জয়দি।

“বোকা কাকে বলে ?”, বিপিনবাবুর সকৌতুক খোঁচা ।

“যার বুদ্ধি কম”, জয়দি ফিক করে হাসে ।

“তুই কি তাই ?”

“হয়তো তাই । অন্ততঃ তোমার কাছে তাই । কারণ তুমি কিছুতে-ই বোঝাতে চাও না ।”

“ধুর । আমার এতো জ্ঞান দিতে ভালো লাগে না । তুই নিজে বইটা পড় , পড়তে পড়তে বুঝে যাবি । কারোর সাহায্যের দরকার পড়ে না বোঝার জন্যে । তোর কিন্তু সেই পড়ার আগ্রহটুকু নেই ।”

“হুম তুমি এতো বোঝো কি করে ? আমার পড়তে একটুও ভালোলাগে না সত্যি । আমার দ্বারা কিস্যু হবে না গো বিপিনদা” , মুখ বেঁকালো জয়দি । বিপিনবাবু শুনে একচোট হাসলো । আচমকা চোখদুটো উল্টে গেলো আর চেতনা হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো চেয়ার উল্টে ।

কিছু বুঝে ওঠার আগে জয়দি দেখলো বিপিনবাবুর মুখের কষ বেয়ে রক্ত বেরোচ্ছে । ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো জয়দি – “বিপিন দা, বিপিন দা , কি হল গো তোমার ?” তার চিৎকারে আশেপাশের লোকজন জড়ো হলো । পাশে জয়দি তখন আদ্যোপান্ত নার্ভাস । হাত-পা কাঁপছিলো সমানে । তার উপরে ঝুঁকে পড়ে বার বার বিপিনদা, বিপিনদা বলে ডাকতে থাকলো । একজন এসে জলের বোতল খুলে চোখে মুখে জল ছিটালো কিন্তু কিছুতে-ই চেতনা ফেরে না। ভিড়ের মধ্যে একজন প্রবীণ বলে উঠলো – হাসপাতালে ভর্তি করান আপনার দাদাকে । সিরিয়াস কিছু একটা হয়েছে এনার ।

“আমি যে হাসপাতাল চিনি না । কেউ যদি বলে দিন ঠিকানা”, কেঁদে ফেললো অসহায় জয়দি ।

“এই নিন ঠিকানা । আপনি এনাকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে চলে যান । আর দেরী করবেন না”, প্রবীণ ব্যাক্তিটি নিজে এগিয়ে দিলেন কাগজে ঠিকানা লিখে । কয়েকজন মিলে বিপিনবাবুকে কোলে ধরে নিচে নেমে একটা ট্যাক্সি ডেকে পেছনের সীটে তুলে দিলো । সাথে উঠে বসলো জয়দি । সোজা চলে গেলো সেই ঠিকানায় ।

প্রাথমিক চিকিৎসায় তেমন কোনো সাড়া না পাওয়ায় ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হলো নিউরোলজিস্ট ডক্টর হাজরার তত্বাবধানে ।

“সো আর ইউ ফ্রেন্ড অফ মিস্টার চক্রবর্তী ? প্লিজ ফলো মি টু মাই চেম্বার ।”, জয়দি চেম্বারে ঢুকলো ডক্টর হাজরার সাথে সাথে ।

“ম্যাম ! আয়াম ভেরি সরি টু সে দ্যাট দিস ইজ আ ভেরি ক্রিটিকাল কেস । ইট সিমস্ হি নিডস মোর অবজারভেশন । আনলেস ফার্দার ইনফরমেশন উই ক্যান্ট কমিট এনিথিং । ডু ইউ নো এনিওয়ান ফ্রম হিজ ফ্যামিলি ?”, ডক্টর হাজরা নোটপ্যাডে কিছু লিখছিলেন ।

“হ্যাঁ হ্যাঁ । বিদিশা । বিপিনদার একমাত্র মেয়ে । ও বিপত্নীক । কল করে ডাকবো কি বিদিশাকে ? বুঝতে পারছি না কিছু আমি”, দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকলো জয়দি ।

“কাম ডাউন ম্যাম । প্লিজ ওয়েট আউটসাইড ফর হাফ এন আওয়ার । উই কল ইউ এগেইন । থ্যাঙ্কু ।”

এস.এম.এস. করে জানানো হলো বিদিশাকে । সে আসছে স্কুল থেকে দশমিনিটের মধ্যে । লবিতে বসে আছে জয়দি । শূন্যদৃষ্টি তার । চোখের আয়নায় এসে দেখা দেয় বাইরের বৃষ্টি ।

 

“জয়দি, বাবা কোথায় ?”, বিদিশা কখন এসে পড়লো খেয়াল নেই । বিদিশাকে দেখতে বেশ সুশ্রী । বাবার মত ছিপছিপে চেহারা পেয়েছে । বেশ ফর্সা । পড়াশুনায় ব্রিলিয়ান্ট । এখন ওদের দুজনের মধ্যে ভাব অনেক । বিদিশা মাঝে মাঝে জয়শ্রীর বাড়িতে যায় । তেলমুড়ি খায় আর দেদার গল্প জুড়ে দেয় জয়দি আর তার মায়ের সাথে ।

“সি.সি.ইউ. তে আছে”, বিদিশাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নেয় । তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় । এক নারীচোখের জলে ভিজে যায় আরেক নারীবুক ।

“বাবার কি হয়েছে, জয়দি ? মরে যাবে না তো ?”

“না না ওইসব বলিস না পাগলি । ঠিক হয়ে যাবে । আগে আসুক ডাক্তারবাবু কি বলে দেখা যাক !”

“জানো, আমি আজ একটি কাণ্ড করেছি স্কুলে । ক্লাসের বেস্টফ্রেন্ডকে বলে ফেলেছি জয়দি যদি আমার মা হত, তো কেমন হত ? তারপর এই বিকেলে তোমার মেসেজ পেলাম । সবকিছু-ই গোলমাল লাগছে তখন থেকে । বিধাতা এমন প্রবঞ্চক হতে পারে কল্পনা করি নি, জয়দি…”

তাকে থামিয়ে তার দুই গাল হাত দিয়ে মুছতে মুছতে জয়দি বললো – “চিন্তা করিস না । আমি আছি না ?”

একটু পরে-ই ডাক পড়লো ওদের । চেম্বারে বসতে বললেন ডক্টর হাজরা । কপালে তার সুচিন্তিত ভাঁজ , মুখখানা ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত । বার বার বিড় বিড় করলেন – “নট ইজি । নট সো ইজি ।”

চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলে রেখে গলার টাইয়ের ফাঁস আলগা করলেন পঁয়ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতাপূর্ণ ডাক্তার কৌশিক হাজরা ।

“ফ্রান্কলি টু সে, ইন মাই কেরিয়ার দিস ইজ ভেরি নিউ টু মি । আই নেভার গট দিস কেস বিফোর ইন মাই লাইফ । উই হ্যাড আ ডিসকাসন উইথ টিম । সো ফার উই অবজার্ভড, দিস ইজ ফাউন্ড এজ মেনিংগোএনসেফালাইটিস্ (meningoencephalitis) অ্যাকর্ডিং টু মেডিক্যাল সায়েন্স ।”

“মানে ?”, প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো বিদিশা আর জয়দি । দুজনের চোখে মুখে ভয় ও অনিশ্চয়তার ছাপ ।

“দিস ইজ লাইক ইনফ্লামেশন অফ দি মেমব্রেনস্ অফ দি ব্রেন এজ ওয়েল এজ অফ দি মেনিনজেস্ ।”

“প্লিজ বাংলায় বুঝিয়ে দেবেন ডাক্তারবাবু ?”, জয়দির সকাতর অনুরোধ ।

“নিশ্চয় ম্যাডাম বলছি । এই কেসটা হয় যখন ব্রেনের মধ্যে যে স্নায়ুতন্ত্র থাকে সেখানে সংক্রমণ হলে । এই সংক্রমণ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে । তাই বর্তমান কোনো ওষুধে সাড়া দিচ্ছে না ।”

“এর কোনো প্রতিকার নেই কি ডাক্তারবাবু ?”, জয়দির সটান প্রশ্ন । বিদিশা ‘বাবা’ বলে কাঁদতে কাঁদতে তার মাথা রাখলো জয়দির কাঁধে ।

“এই মুহূর্তে বলা মুস্কিল ম্যাডাম । তবে আমাদের টিম একটা লাস্ট উপায় ভেবে রেখেছে যদিও সেটা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ । সেটি হলো ইন্ডিউজ্ড কোমায় রাখা হবে পেশেন্টকে । এটি একটা বিশেষ পদ্ধতি যা দিয়ে সংক্রামিত ব্রেনের যাতে আর ক্ষতি না হয় তাকে প্রোটেক্ট করা হয় আর অন্যান্য শারীরিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া চালু রাখা হবে । সাথে রেগুলার মনিটর করে যেতে হবে ।”

“এতে কি বাবা বেঁচে ফিরে আসতে পারবে ?”, বিদিশার উৎকন্ঠা ।

“লেটস্ হোপ্ সো । বাট কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছি না আমরা কেউ । এটি একমাত্র শেষ উপায় ।”

বিদিশাকে ওর মামার বাড়িতে রেখে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরলো জয়দি । সারারাত খাওয়া নেই । ঘুম নেই । এর মধ্যে মনের সমস্ত চেতনা সেই বিপিনদাকে নিয়ে জড়িয়ে আছে এই কয়েকমাসে । বিপিনদা তাকে চিনিয়ে দিয়েছে কঠিনবাস্তবের মুখোমুখি করতে । ব্যাঙ্কে কিছু টাকা ফিক্সড টার্মসে জমিয়ে রেখেছে বিপিনদার কথামত । বেশ কয়েকটি জায়গায় জব আপ্লাই করেছে তার পরামর্শে । দু-তিনটে জায়গা থেকে ইন্টারভিউয়ের কল পেয়েছে ইতিমধ্যে । প্রথম ইন্টারভিউ আছে নেক্সট উইকে । তার মধ্যে বিপিনদার এই দশা হবে কে জানতো ?! কৃতজ্ঞতার সাথে ভালোবাসায় তার বুক দারুণ কষ্টে মোচড় দিলো । একপাশ ফিরলো । তার মুখের উপরে এসে পড়ে বৃষ্টির ছাঁট । তার চোখ জানালার দিকে । বাইরে প্রকৃতি এখনো অবিচল । নির্বিকার । নিযমের আজকাল কোনো বালাই নেই । ফিরে ফিরে আসে , ফিরে ফিরে যায় । জীবনটা-ও কি তাই ? এতো অনিয়মে ভরা জীবন ? বৃষ্টির মত থামে , আবার চলতে থাকে ? বৃষ্টির সাথে জীবনকে তুলনা করতে গিয়ে হঠাৎ তার মনে হলো – সম্ভব ! ফিরে আসা সম্ভব যদি প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে বৃষ্টি বার বার নামে , তাহলে জীবন কেন বা থেমে যাবে ?

 

সে সাইবার কাফে ঢুকে ঘন্টাখানেক ধরে নেট-সার্ফ করে নানা ডাক্তারি তথ্য জোগাড় করলো বিপিনদার কেস সংক্রান্ত । সেগুলোর মধ্যে পাওয়া একটা তথ্য অনেকখানি বল এনে দিয়েছিলো তার মনে । সেটি হলো এই সেম কেসটা হয়েছিলো বিখ্যাত এফ ওয়ান লিজেন্ড মাইকেল সুমাকার, প্রাক্তন ইজরায়েল মুখ্যমন্ত্রী আরিয়েল শ্যারন প্রমূখ ব্যক্তিত্বের । প্রত্যেকে প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছেন এই বিশেষ কোমায় দীর্ঘকালীন থাকার পরে । এই হীরের মত টুকরো আশা বুকে বেঁধে সে রওনা দিলো হাসপাতালে । ডাক্তারবাবুর সাথে দেখা করে জানালো সব তথ্য । ডাক্তারবাবু বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখলেন এই তথ্যসংগ্রহকারী আশাবাদী নারীর মুখের দিকে । শুধু বললেন – “আশা তাহলে রাখা যায় নিশ্চয় , শুধু আপনার সহযোগিতা চাই আমাদের ট্রিটমেন্টে । কেউ রাতের দিকে থাকতে চাইছে না মনিটরের সময়ে । আপনি কি পারবেন কাউকে রাখার ব্যবস্থা করে দিতে ?”

“খুব পারবো । আর কাউকে দরকার পড়বে না ডাক্তারবাবু । আমি রোজ রাতে আসবো । ওর পাশে থাকবো । নজর রাখবো ।”

“ভেরি গুড”, নার্সকে ডেকে সব বুঝিয়ে দিতে বললেন জয়দিকে রাতে রোগী দেখভাল করার যাবতীয় নিয়মগুলো । “কোনো দরকার পড়লে আমাকে ইমিডিয়েটলি কল করবেন ।”, বলে অন্য রোগীকে দেখতে চলে গেলেন ডক্টর হাজরা ।

বাঁক নেয় জয়দির রুটিনমাফিক চাকা । রোজ নিয়ম করে সকালে মায়ের জন্যে রান্না করে বেরিয়ে পড়ে , কলেজ করে হাসপাতালে যায় কোমায় আচ্ছন্ন বিপিনদাকে দেখতে , তার কপালে হাত বুলিয়ে দেয় । নার্সের কাছে নিয়মিত জেনে নেয় কোনো ওষুধ লাগবে বা স্যালাইন লাগবে কিনা । দরকার পড়লে ওষুধের দোকানে গিয়ে কিনে আনে । সন্ধ্যায় টিউশনে যায় । বাড়ি ফিরে মাকে একটু দেখে আবার হাসপাতালে যায় । বিপিনদার বেডের পাশে চেয়ারে বসে সারারাত কাটায় । মাসে ৩-৪ বার বিদিশা দেখতে আসে বাবাকে । জয়দির দিকে চেয়ে থাকে বেচারা মেয়েটি । জয়দি চোখ বন্ধ করে তাকে আশ্বাস দেয় । দিন দিন রোগা হতে থাকে জয়দি, তবুও জেদের কাছে সব হার মানে । বিনাবাক্যে চাকাটিকে গড়িয়ে দেয় দিনের পর দিন । রাতের পর রাত । সপ্তাহের পর সপ্তাহ । মাসের পর মাস ।

বাইরে তখন ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা । গায়ে তার নতুন জ্যাকেট । নিজের মাইনের টাকায় কেনা । আগের মাসে একটা কোম্পানিতে জব পেয়েছে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে । শুধু নিজের জন্যে জ্যাকেট নয়, মায়ের জন্যে কিনেছে তিনখানা কাশ্মীরি শাল, বিদিশার জন্যে দুটো শিফন শাড়ি – একটির বেবি পিঙ্ক কালার, অন্যটি স্কাই ব্লু । আর বিপিনবাবুর জন্যে বেশ কয়েকটি দার্শনিক বই । বিপিনদার খুব প্রিয় বিষয় যে দর্শন এই কয়েকদিনে নিজে একা পড়ে বুঝতে পেরেছে জয়দি ।

নতুন বছরের আগের দিন । চেয়ারে বসে একটি বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমে ঢুলে পড়েছিল জয়দি । এমন সময় কে যেন ডাকলো কর্কশ গলায়,

– “জয় !! কি করছিস ?”

সেই চেনা কর্কশ গলা । সেই চেনা ভারী গলা । যার ভয়ে এতোটাই কুঁকড়ে যেতো আগেকার জয়দি । এখন তার সারা বুকজুড়ে ভিতরে একঝাঁক পাখি যেন একসাথে ডানা ঝাপ্টাতে লাগলো প্রাণপণে । নিজে একটা বিশাল পরিণত পাখি যে প্রায় উড়তে উড়তে বিপিনদার বুকের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়লো । কান্নায় ভেঙে পড়লো । “বিপিনদা, আমার বিপিনদা ! আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে । জানতাম …”

বিপিনবাবু তার দুর্বল দুই হাত অনেক কষ্টে তুলে জয়দির মুখ ধরলো ।

“জানিস জয় ! আমার বুকের ভিতরে একটা শিশু বহুকাল ধরে শুয়ে ছিলো । অবহেলিত হয়ে । সমস্তরকম যত্ন-আত্তি বর্জিত সে । তোকে দেখতে পেয়ে সে এখন এক গাল হাসছে ।”, বিপিনবাবুর বাঁ-চোখের কোণ বেয়ে একটি শৈশবিক ধারা নেমে এলো । ঠোঁটের ফাঁকে দেখা দিলো এক খুচরো ম্লান হাসি ।

“আর ভাত নিবি ?”, ব্যস্ত হয়ে পড়লো জয়দি । আমি কিছু না বলে মুগ্ধশ্রোতা হয়ে শুধু চেয়ে ছিলাম আমার সামনে বসা জয়শ্রী দিদির দিকে । এই দিদি আর সেই ছোটবেলায় দেখা ভিতু ঘরকুনো ক্যাবলা দিদি নয় যার কাছে ছোটবেলায় মাঝে মাঝে খেলতে যেতাম । তার কেয়াতলার সেই হাড়জিরজিরে বস্তিবাড়িতে । আমার চেয়ে বছর ছয়েকের বড় জয়দি এখন অনেক পরিণত । দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা, প্রবঞ্চনা, আকস্মিক বিরলতম দুর্ঘটনার মাঝে নিজের পায়ের উপরে দাঁড়ানো নারীশক্তির একজন উজ্জ্বল প্রতীক সে । বিপিনবাবু হরফে জামাইবাবুর সাথে জয়শ্রী দিদি কিনেছিলো একটি ছিমছাম টু-বেডরুম ফ্ল্যাট । বেশ যত্ন করে সাজানো গোছানো তাদের পূর্বাচলের ফ্ল্যাট । সেই ফ্ল্যাটের দশ বাই বারো হলের উত্তরদিকে ডাইনিং টেবিলে সেদিন আমন্ত্রিত ছিলাম আমি । এক চামচ মিষ্টিদই মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ামাত্র আপনা থেকে বন্ধ হয়ে যায় আমার চোখদুটো । মনে হলো জয়দির মুখে শোনা বিষাদভরা এই যুদ্ধক্ষেত্রের একটা মিষ্টি মোড়ে এসে পৌঁছালাম । এবার বাড়ি ফেরার তাড়া ।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত