আজ অবনীর মন খারাপ। সামান্য একটা কথার জন্য শেষে কিনা গায়ে হাত তুললো? তবে কি কথাটা সামান্য ছিল নাহ্? দুইটা প্রশ্ন যখন অবনীর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে,তখনি কানে আসলো,
-হুমমম তুমি রেডি থাকো আমি এখনি আসছি ।
কথাটা বলতে বলতেই দড়জাটা লেগে গেল।
অবনীর মাথায় আরও দুইটা প্রশ্নের আর্বিভাব হলো।
প্রথমত, সজীব কাকে তৈরি থাকতে বলল? আর দ্বিতীয়ত, সজীব এত রাতেই বা কোথায় যাচ্ছে।
অবনী দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটার দিকে তাকালো। ঘড়ির কাটা বলছে রাত ২টা বেজে ৩৫ মিনিট। হু হু করে কান্না আসছে ভিতর থেকে। কিন্তু পাশের রুমে শ্বশুর-শাশুরি শোয়া। দুই চোখ দিয়ে ঝরা পানিগুলো গাল বেয়ে বেয়ে পরছে।
অবনী আয়নার সামনে গিয়ে দাড়াল। গালে এখনো সজীবের দেওয়া ৩টা আঙ্গুলের দাগ বেশ ভালো ভাবেই ফুলে আছে। জায়গাটা বাজে ভাবে লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে নাহ্ সারারাতে মুছে যাবে। আর যদি সজীবের মা বাবা এই টা দেখে তবে কি না ভাববে, এই কথা ভেবেই শাড়ির আচল দিয়ে নিজের গালে ঘুষতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর দেখল দাগটা তো কমে নি বরং আরও বেশি লাল বর্ণ আকার ধারণ করেছে।
দুই তলার জানালা দিয়ে বার বার দেখার চেষ্টা করছে সজীব আসছে কি না। বার বারই ব্যর্থ, সজীবের আশার কোন নাম গন্ধই নেই। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে নিজের কাছে। ইচ্ছা করছে শেষ করে দিতে সব কিছু এমন কি নিজেকেও। কিন্তু অবনী জানে মাথা গরম করে আর রাগের বসে কোন কিছু করে বসলে সেটাকে বুদ্ধিহীনতা, মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই বলে নাহ্।। সেইদিক থেকে অবনী যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।আর হুটহাট করে এমন কোন কাজ যে সে করবে সেটা সবারই জানা। কিন্তু আজকে সবার জানা কথাটাও যেন মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। বার বার অবনী নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।
পারিবারিক ভাবেই হয়েছিল বিয়েটা। প্রথমে কোন অভিযোগ আসে নি শ্বশুরবাড়ীর লোকজনের থেকে কিন্তু বিয়ের ৫বছর পরও যখন কোল আলো করে কেউ আসলো নাহ্ অভিযোগটা তখন থেকেই। বাড়ীর আর যে যাই বলুক সজীব কখনোই কোন অভিযোগ করে নি। বরং সব সময় উৎসাহ্ দিয়েছে। অবনী প্রায় শ্বশুরের ঘর থেকে কথার শব্দ শোনে দড়জায় দাড়িয়ে।
“অনেক তো দেখলাম আর কত? তবে কী বংশের বাতি জ্বলবে নাহ্? ছেলেটাকে আবার বিয়ে দিবো। এই ভাবে তো আর চলে নাহ্। ”
কথাটা শুনে দড়জার এপার থেকেই মনটা হু হু করে উঠে। কথাটা অবশ্য সজীবকে জানিয়েছে।
-বলছিলাম কি সবাই যখন চাচ্ছে, তখন আপনি আরেকটা বিয়ে করুন।
অবনীর কথায় সজীব মুসকি হাসি দিয়ে বলে,
যে যাই বলুক, ওদের কথায় কান দিবে নাহ্। আমি ভালো আছি তোমাকে নিয়েই। আর কাকে কখন সন্তান দিবেন সেটা সম্পূর্ণ আল্লাহ্ তায়ালার হাতে, এতে মানুষের কোন হাত নেই।
সজীব সব সময় এমনি কথা বলতো অবনীকে। কিন্তু দুইদিন থেকে সজীবের ব্যবহার কেমন যেন বদলে গেল। সেই সজীবটা অবনীর কাছে বড্ড অচেনা হয়ে উঠলো এই দুই দিনেই। দেরি করে বাসায় ফেরা, ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলা, হুট হাট করেই রাতবিরেতে বেড়িয়ে যাওয়া। আর অবনীর দিকে তো তেমন খেয়ালই নেই। যা অবনী মেনে নিতে পারছে নাহ্।
অবনীর একটাই প্রশ্ন,আমি তো এইসবে কখনো বাধা দিই নি তবে কেন আমার সাথে এতো লুকোচুরি? বরং আমি তো নিজ থেকেই বলেছি এমন কিছু একটা করার জন্য। তাইলে?
দুই দিন কেটে গেল অবনী আর সজীবের মধ্যে কথা হয় নাহ্। গুমরে কাঁদে মেয়েটা আর সজীব মেতে থাকে নিজের কাজে। আজকে শুধু অবনী বলছিল,
-আচ্ছা মেয়েটা দেখতে কেমন? আমার থেকেও অনেক সুন্দর তাই নাহ্?? তা কবে বিয়ে করছেন আপনারা?? শোনেন আমি কিন্তু আপনাদের বাসর ঘরটা সাজিয়ে দিবো এই বলে রাখলাম, আর হ্যাঁ অবশ্যই সেটার জন্য মোটা অংকের বকশিস দিতে হবে হি হি।
কথাগুলো বলতে গলাটা বারে বারে আটকে গেলেও কথার শেষে একটা হাসি জুড়ে দিল।
নীল একটু অবাকই হয়ে গেল। তারপর বিরক্তিমিশ্রিত কণ্ঠে বলল, কোন মেয়েটা?
অবনী আবার হেসে বলল,
যার সাথে প্রেম করছেনন সে। আর হ্যাঁ একটা কথা আপনাদের বাচ্চাটাকে কিন্তু আমিই মানুষ করবো বলে রাখলাম। জানেনই তো আমার আবার বাচ্চা-কাচ্চা খুব ভালো লাগে।
কথাটা শুনেই সজীব কষে একটা চড় মেরে দিলো অবনীর গালে। তারপর হন হন করে বেরিয়ে গেল।
চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পরছে অবনীর। সকাল যখন হয় হয় ভাব সজীবের ফেরার কোন নাম নেই। সারারাত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে একটু খানি চোখটা লেগে এসেছে বুঝতেই পারে নি।
চোখ যখন খুলল তখন চারিদিকের আধার কেটে গেছে। তার বদলে সূর্যটা উঁকি দিয়েছে। সকালের এই সূর্যটা অবনীর খুব প্রিয়। ইচ্ছে করে হাত বাড়িয়ে একমুঠো সূর্যের আলো দিয়ে নিজেকে রাঙ্গিয়ে তুলতে।
কিন্তু তৎক্ষনাৎ মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। সজীব সারারাত বাসায় ফেরে নি। চোখ গুলো আবার ছলছল করে উঠলো। আবারও রাস্তার দিকে তাকালে অবনী। আর তাকাতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল। হ্যাঁ, সজীব আসছে, হাতে একটা মোটা কোর্টফাইলের ন্যায়। তবে কি আজই আমাকে ডির্ভোস দিয়ে দিবে ?? নাকি আজই বিয়ে করল নতুন মেয়েটাকে??আর সেই কাগজগুলো এনেছে সাথে?
কথাগুলো ভাবতেই বুকটা ছ্যেৎ করে উঠল।না না কি ভাবছি এই সব সজীব আমার গায়ে হাত তুলতে পারে কিন্তু ছেড়ে দিবে এটা আমি বিশ্বাস করি নাহ্।।
নিজেকেই সান্তনা দিল অবনী।।
দড়জার একটা শব্দ করে গলাতে হালকা কৃত্রিম কাশি এনে নিজের উপস্থিতি জানান দিল সজীব।অবনী লোকটার দিকে তাকাতে পারছে নাহ্।। তাকালেই যদি বলে উঠে অবনী আজকেই আমাদের ডিভোর্স, আমি সাক্ষর করেছি এবার তুমি করো। কিংবা যদি বলে অবনী নতুন বউকেই এই ঘরে রাখবো।
তখন কি করবে অবনী?? শুধু এইটা ভেবেই পিছনে তাকানোর সাহস হচ্ছে নাহ্। হঠাতই কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে চুমকে উঠল। পিছনে তাকাতেই দেখল সজীব মুসকি মুসকি হাসছে। তারপর চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো আমি বাবা হতে চলেছি আর তুমি মা।
অবনী যেন প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে নাহ্। এ যেন এক বড় প্রাপ্তি এই জীবনে, চোখের পানি ছেড়ে দিল সজীবের বুকে মাথা রেখে। আজকে আর কাদতে বাঁধা নেই। ইচ্ছামত কাঁদবে অবনী। কিন্তু একটুপরেই মাথাটা সরিয়ে নিলো সজীবের বুক থেকে। তারপর অভিমান আর কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,,,তাইলে এই তিনদিন আমাকে কষ্ট দিলেন কেন?
সজীব মুসকি হেসে বলল,
তুমি তো নিজেই কষ্ট পাইছো। ভূল ধারণা নিয়ে পড়ে থাকো তো তাই।
তোমার মনে আছে গতমাসে তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম??
অবনী মাথা নাড়াল।
অবনীর থেকে জবার পেয়ে আবার বলা শুরু করল সজীব।
“আর সেখানে আমার এক পরিচিত ডাক্তার ছিল সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। আর গত তিনদিন আগে আমাকে সিওর করে যে,রিপোর্ট পজেটিব।কিন্তু আমি আরও সিওর হওয়ার জন্য নানান হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি। আর প্রয়োজনের তাগিতেই তাদের সাথে কথা বলা। বুঝেছো এবার? ”
অবনী আর কোন কথা নাহ্ বলে আবার সজীবের বুকে মাথা রাখলো।
আর সজীব অবনীর মাথায়।
সমাপ্ত