: তোমাকে একটা মুরগি চুরি করতে হবে।
: কী বলেন, স্যার! আমি গরু চুরি করি, নিম্নে ছাগল, তাই বলে মুরগি চুরি? সম্ভব না।
: আরে বাবা, পাঁচ হাজার টাকা দেব, আর মুরগিও তোমার থাকবে…
: না স্যার, চোর হইলেও আমগো একটা ইজ্জত আছে। এক কাম করেন…
: কী?
: একটা শিয়াল নিয়া যান, ট্রেনিং দেওয়া শিয়াল আছে আমার।
: কেন? শিয়াল কেন?
: আরে, আমার শিয়াল মুরগি চুরিতে ওস্তাদ!
: আরে, না রে বাবা, ফ্ল্যাটবাড়িতে শিয়াল দিয়ে মুরগি চুরি করব কীভাবে?
: তাইলে স্যার, আমারে খ্যামা দেন। আমি যাই…
: আরে, দাঁড়াও দাঁড়াও; শোনো! ঠিক আছে, দশ হাজার টাকা দেব…
দশ হাজার শুনে গরুচোর ইদ্রিস একটু থমকায়। কিন্তু সে গ্রামগঞ্জের গরুচোর, সে শহরে গিয়ে ফ্ল্যাটবাড়িতে কীভাবে মুরগি চুরি করবে, ঠিক বুঝতে পারে না।
: আচ্ছা স্যার, আগে কন তো, দশ হাজার ট্যাকা দিয়া মুরগি চুরি করাইতে চাইতাছেন, ঘটনাটা কী?
: ঘটনা জটিল! আমাদের ফ্ল্যাটের চেয়ারম্যান বদরুল সাহেব ওই মুরগি পালে। আসলে ঠিক মুরগি না, মোরগ…মোরগ পালে। লাল রঙের একটা বেশ বড়সড় মোরগ। প্রতিদিন সাতসকালে কোঁকর কোঁ, কোঁকর কোঁ বলে চেঁচায় আর সবার ঘুম ভেঙে যায়! শান্তিতে কেউ ঘুমাতে পারে না। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না! চেয়ারম্যান সাহেব লোকটা প্রভাবশালী বলে কিছু বলা যাচ্ছে না। তাই এই চুরির প্ল্যান।
: স্যার, রিস্ক নাই তো? আমি কইলাম গাঁও–গেরামের গরুচোর।
: কোনো রিস্ক নাই, তুমি ধরা পড়লে বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের। খালি মোরগটার একটা ব্যবস্থা করো।
: বেশ, তাইলে কিছু অ্যাডভান্স করেন।
: এই নাও, পাঁচ হাজার টাকা ক্যাশ।
রোজ অ্যাপার্টমেন্টের সি/ফোর–এর ফ্ল্যাট–মালিক নিজাম সাহেব তাঁর গাড়িতে করে ফিরে চললেন শহরে। দশ–বিশ হাজার যাক, কোনো বিষয় নয়। ফ্ল্যাটের সবাই একমত এই মোরগ চুরি করাতে হবে, যেকোনো মূল্যে। সবাই চাঁদা দিয়ে টাকা তুলেছে। চোর জোগাড় করার দায়িত্ব পেয়েছেন নিজাম সাহেব। সুখে–দুঃখে ফ্ল্যাটের সবার সমস্যা তিনি নেপথ্যে থেকে সমাধান করে থাকেন। এবারও তাঁর ঘাড়েই সবাই দায়িত্ব দিয়েছে। বহু খোঁজখবর করে এই ইদ্রিস চোরের সন্ধান পেয়েছেন তিনি।
শনিবার সন্ধ্যার দিকে ইদ্রিস চোর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এল, সঙ্গে একটা বাক্স। নিজাম সাহেব নিরাপদ দূরত্বে অপেক্ষা করছিলেন। ইদ্রিসকে দেখে এগিয়ে গেলেন।
: এসেছ তাহলে?
: জি স্যার, আমরা এক কথার মানুষ। কথা যখন দিছি, কাজ হবে।
: বাক্সে কী?
: স্যার, শিয়াল।
‘শিয়াল?’ আঁতকে ওঠেন নিজাম সাহেব, ‘শিয়াল কেন? তোমাকে না নিষেধ করলাম শিয়াল দিয়ে হবে না!’
: হবে স্যার, হবে! বহু চিন্তা করে দেখলাম, কাজ করাতে হবে আমার শিয়াল দিয়েই। আমি বাড়ি রেকি করে গেছি আগের দিন। মোরগটা আছে দোতলার বারান্দায়, আমি শিয়াল ছাইড়া দিমু গ্যারেজের ছাদে। সে দেয়াল টপকায়া গ্রিলের ফাঁক দিয়া ঢুইকা যাইব। কোনো রিস্ক নাই। আমার ট্রেনিং দেওয়া শিয়াল।
: দেখো, কাজ হবে তো?
: হবে মানে, ষোলো আনার উপরে দুই আনা বেশি হবে। আইজ রাতেই হবে। আপনারা নাকে তেল দিয়া ঘুমান। খালি আমার বাকি টাকা দেন আর উপরি এক হাজার টাকা দিতে হইব।
: কেন? আবার বাড়তি এক হাজার কেন?
: আর স্যার, কী কন! এই শিয়াল আনতে সাত শ টাকা খরচ হইছে। পুলিশ ধরছিল, পুলিশরেও কিছু দিতে হইছে।
যা হোক শেষ পর্যন্ত ছয় হাজার দিয়ে নিজাম সাহেব নিশ্চিন্তে ফ্ল্যাটে ফিরে গেলেন। যাক, আজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে।
কিন্তু একি! পরদিন ভোরে সবার ঘুম ভাঙল প্রথমে সেই বিকট কোঁকর কোঁ, কোঁকর কোঁ মোরগের চিত্কারে! তারপর শুরু হলো শিয়ালের হুক্কা হুয়া…!
নিজাম সাহেব পরদিনই ছুটলেন গাড়ি নিয়ে সেই গ্রামে, ইদ্রিস চোরের গ্রামে। ইদ্রিসকে পাওয়া গেল।
: ইদ্রিস, এটা কী হলো? মোরগ তো মরলই না, উল্টা এখন শিয়ালের চিত্কারে ঘুম হারাম!
: স্যার, কী কমু! এই পরথম সেন্টু বিট্রে করল!
: সেন্টু কে?
‘আমার পালা শিয়ালের নাম। সেন্টু শালা মোরগ তো খাইলই না। উল্টা ওইখানে থাইকা গেল! কত বড় নিমকহারাম, চিন্তা করেন! শিয়াল মোরগ খায় না শুনছেন কখনো? সবই আমার কপাল!’ কপাল থাপড়ায় ইদ্রিস চোর।
: তাহলে এখন কী হবে?
: চিন্তা কইরেন না। আমি ব্যবস্থা করতাছি।
: কী ব্যবস্থা?
: একটা বুদ্ধি বাইর করুম, আপনি যান, কাইলকার মধ্যে দুইটারেই ফিনিশ করুম।
: কীভাবে?
: সেইটা আমি বুঝুম। সেন্টু বিট্রে করছে, এইবার আনুম মেন্টুরে।
: মেন্টু কে?
: সেইটা সময় হইলেই টের পাইবেন।
নাজিম সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে শহরের দিকে রওনা দিলেন। পরবর্তী তিন দিন ওই রোজ অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাটবাসীর ঘুম ভাঙল যথারীতি কোঁকর কোঁ আর হুকা হুয়া ডাকে। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় এসে হাজির হলো ইদ্রিস আলী। এবারও তার মাথায় একটা কাঠের বাক্স, তবে এবারেরটা বেশ লম্বা।
: ইদ্রিস মিয়া, বাক্সে কী?
: মেন্টু।
: মেন্টু কী?
: আমার পালা কুমির।
: কুমির?
: ডরায়েন না, এইবার এক লগে দুইটারে শেষ করুম। খরচা কিন্তু বস কিছু বাইড়া গেল। কিছু ড্যামারেজ দিতে হইব।
: সে দেখা যাবে, আগে ওই দুইটারে শেষ করো। কিন্তু কুমির দিয়ে কী হবে?
: সেইটা সময় হইলেই দেখতে পাইবেন। যান, নাকে তেল দিয়া ঘুমান গিয়া। আর আরও পাঁচ হাজার ট্যাকা দিয়া যান, কুমির ক্যারিং কস্ট দুই হাজার ট্যাকা পরে বিকাশ কইরা দিয়েন।
রোজ অ্যাপার্টমেন্টে সবাই এখন শান্তিতে ঘুমায়। মোরগের কোঁকর কোঁ আর শিয়ালের হুক্কা হুয়া শুনতে হয় না। তবে ফ্ল্যাটের সবাই পানি কিনে খায় বাইরে থেকে। অ্যাপার্টমেন্টের পানি খেতে পারে না, কারণ অ্যাপার্টমেন্টের পানির ট্যাংকে একটা কুমির পালা শুরু করেছেন চেয়ারম্যান বদরুল সাহেব।
রস+আলো