আমি হাঁটছি; হেঁটেই যাচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে কোন বিদেশে এসে পরেছি জানি না। আমার এই হাঁটা বন্ধ হবে সেই পথে, যে পথে আমি নিঃপ্রাণ হবো। আমার মৃত্যুই পারবে আমাকে থামাতে। মৃত্যুর চেয়ে করুণ, দিনারুণ কিছুই পারবে না আমার হাঁটায় গতিবদ্ধ করতে। আমি হাঁটতে পারি, অনেক হাঁটতে পারি। যখন খুব মন খারাপ কিংবা রাগ হয়, তখনই রাস্তায় হাঁটতে নেমে পরি। এক গন্তব্যহীন হাঁটা। জানি না কোথায় যাচ্ছি, কোন গন্তব্য আমায় টানছে আমি বুঝতেও পারিনা।
আজও আমার ভীষণ এক মন খারাপের এই রাতে গন্তব্যশূন্য হয়ে হাঁটছি। নিয়ন আলোয় রাস্তায়গুলো মনে হচ্ছে সোনার তৈরি। এই সোনার রাস্তায় হাঁটছি; পথগুলো সম্পূর্ণ নতুন। পা-দুটো আমায় বলতে চাচ্ছে “আর নয়”। আমিও তাকে বলতে চাচ্ছি, “যা হয় হোক”। আমি আর ফিরে যাবো না। পথে পথেই হাটঁবো। কার কাছে ফিরে যাবো? আমার মন খারাপের রাতে যখন রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যাই তখন কেউতো আমায় হাত বাড়িয়ে বলে না, “যাস না”। আমি হিসাব ছাড়া কত রাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছি। কেউতো বলেনি, “খেয়ে ঘুমোও”।
সে-দিন রাতেইতো মরার উপক্রম শুরু হলো; পেটের ব্যাথায় পেট ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতে মন চাচ্ছিলো। কোথায়? কেউতো আমায় মাথায় হাত দিয়ে শান্তনা দিলো না; ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো না। মানবতা যে কারোই নেই। মানুষ নামিক এই জীবগুলো বড়ই উদ্ভুত। স্বার্থ ছাড়া দুই-পা এগোয় না। শুধু এগোয় রক্তের পোষক– “বাবা-মা”। তারাও যে এগোলো না। তারাতো তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে মুক্তি নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে।
মা-র চেহারা মনে নেই। বাবা আমায় পোষণের জন্য একজন মহিলাকে রাখলো। তার নাম ছিলো ভানু। তাকেই মা ভাবতাম। মা বলতেই বুঝতাম একটা নারী দেহ যার চেহারায় ‘মা’ ‘মা ভাব থাকে। তাকে “মা” ডাকতাম আড়াই বছর থেকে আট বছর পর্যন্ত। তারপর একদিন কি কারণে এই “মা” আর এলো না। আমি সঙ্গীহীন হতে শুরু করি। বাবা-কে জিজ্ঞাস করেছিলাম ভানু-মা কোথায়। তিনি বললেন, ভানু গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। আর আসবে না। ভানু-মা চলে গেলো। তারপর আরজ চাচা আসলো। বাসার কাজ কর্ম করতো আর সুযোগ পেলে আমার সাথে নূন্য সময় দিতো। একদিন বাবাও চলে গেলো। অফিস যাওয়ার অজুহাতে বাসা থেকে বের হওয়া পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো। কিন্তু বাসে উঠতে গিয়েই উঠে গেলো দেহ থেকে নিরাকার প্রাণ। বাস দুর্ঘটনায় বাবকেও হারালাম। তারপর চাচার দ্বারে ভরনপোষন হতে লাগলাম। কিন্তু আমাকে তারা মূল্যায়ন করতো না। বাসায় একটা কুকুর পুষলেও তার একবেলা খাবারের জন্য হলেও মালিক খোজ করে। অথচ আমি সেই কুকুরের সম্মানটুকুও পাইনি। ক্ষুধা লাগলে গিয়ে বলতে হতো– চাচি ভাত দিন। সকালে ভাত চাইলে দুপুরে আসতো এরকম অবস্থা। তারপর রাগ করে চলে গেলাম চাচার বাড়ি ছেড়ে।
জীবনের ১৮ বছর হতেই আমার শুরু হয় যায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। পিয়নের কাজ করি; নিজের পেট চালাতে কোন অসুবিধা হয় না। বরং আরো অনেকটাই থেকে যায়। ওই থেকে যাওয়া অর্থ জমিয়ে শুরু করি ব্যবসা। এখন আর কারো ফরমায়েশ খাটতে হয় না; স্বাধীন পেশায় আছি। পৃথিবীতে তারাই মনে হয় কিছু করতে পারে যাদের করার মাঝে স্বার্থকতা নাই। অনাথ-ই এই কিছু করতে পারার মতো একটি শ্রেণী।
আমিও পেরেছি; বিশাল পরিধিতে আমার সফলতা ছড়িয়ে গেলো। এখন আমার বাংলাদেশের কয়েক জেলায় নিজের রেষ্টুরেন্ট আছে। আমার এই সফলতায় এতো বেশি সময় লাগেনি। আমার বাবাও সফল ছিলেন; চাচা সব হাতিয়ে নিয়ে গেলো। কোনদিন আর ফিরে যাইনি প্রাপ্য বুঝে নিতে। আমার সফলতার স্বার্থকতা কি? আমার সম্পদ কে ভোগ করবে? আমার নিজের রক্ত আমায় অনাথ করে চলে গেলো।
দিনশেষে আমি নিঃসঙ্গ হয়ে বিছানায় শুই। কাজের বুয়া বা কাউকে বাড়িতে আশ্রয় দিইনা। আমি বাহিরে খাওয়া-দাওয়া করি। কারণ কাজের মানুষ রাখলে হয়তো ভানু-মা আর আরজ চাচার মতো তাদের মায়াও পরে যাবো। অনাথদের মায়ায় জরাতে নেই। এই মায়া তাদের নিঃশেষ করে দিতে পারে। তবুও শুধু মাত্র দুইজন ড্রাইভার ছিলো।
প্রয়াই রাতে যখন বাসায় ফিরে বিছানায় শিয়রটাকে বালিশে কোমল করে বিছাই তখন একাকীত্বে আমার হৃদয় বিলয় হতে থাকে। আমি তখনই, বাইরে হাঁটতে থাকি; পায়ে চলেই হাঁটি। আমার গাড়ি তার জায়গাতেই থাকে। এই নিরুদ্দেশ পায়ে হাঁটার মাঝে আমার নিঃসঙ্গতাকে শত মানুষের আড়ালে ঢেকে রাখি। কিন্তু আর একাকীত্বেরর যন্ত্রণা নিতে পারলাম না। আমি আমার চাচার কাছে গেলাম। তার কাছে থাকতে নয়। তার মেয়েকে আমার স্ত্রী-র সম্মান দেয়ার জন্য। আমি ছোট থেকে তাকে পছন্দ করতাম হয়তো ভালোবাসতাম। ভালোবাসা কি সেটাও জানি না। কারণ আমার জীবনে ভালোবাসা কখনো আশ্রয় নিয়েছে কিনা জানি না। তবে চাচার মেয়ে শোভাকে ভেবে প্রায়ই এক ধরনের অনুভূতি হতো। হয়তো এটাকেও ভালোবাসার সংজ্ঞায় নেয়া যায়। কিন্তু চাচা আমায় অপমান করে ফিরিয়ে দিলো।
আমি বললাম— চাচা! আমারতো অঢেল অর্থ আছে, শোভা কি কখনো দুঃখে থাকবে? চাচা বললেন, তুই অনাথ। যার বাবা-মা নাই তোকে কার ভরসায় আমার মেয়েকে দিবো। তুই যাই হস না কেনো, তোর যত সম্পদ থাকুন না কেনো আমার মেয়েকে তোর কাছে দেয়া সম্ভব নয়। চাচার এই কথাগুলোই আজ আমার মনে তীরের মতো আঘাত হেনেছে। তাই আজ আবারও হাঁটতে বের হলাম এক আর্ত হৃদয়ে চেপে। এই আর্ত কি আমার একাকীত্ব পূরণ না হওয়ায় নাকি চাচার কথায় নাকি আমার অনুমান করা ভালোবাসার সংজ্ঞিত তাকে না পাওয়ার। হয়তো এই তিনটার সমন্বয় আমার আর্তের কারণ। অনাথ হওয়া কি পাপ নাকি অভিশাপ অনাথই জানে নিজের গল্পগুলো কাউকে না শুনিয়ে নিজের মাঝেই চেপে রাখতে। অনাথরাই হয়তো পারে মৃতের মতো অনাকাঙ্ক্ষায় বেঁচে থাকতে। কিন্তু আমি বেঁচে থাকবো না। আজ আমি হাঁটতে হাঁটতে মরে যাবো। হাঁটতে হাঁটতে যখন আমার পা দুটো ভেঙে পরে যাবে মাটিতে তখন যেনো আমার দেহ থেকে একটা নিরাকার প্রাণও বেড়িয়ে যায়। এই নিঃসঙ্গ দেহের দরকার নেই। অনাথের যেখানে পৃথিবীর সব জায়গায় উপহাস সেখানে পৃথিবীর বাহিরে হয়তো কোন সুখ লুকিয়ে আছে।
আর হাঁটতে পারছি না। একটু দাড়াতে হলোই। সামনে ফাঁকা রাস্তায় নিয়নের আলোয় সোনার মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে। এতো রাতে রাস্তায় বসে আছে। আমি আরেকটু হেঁটে গেলাম। মানুষটার গায়ে ময়লা ছেড়া কাপড়। তার হাতে একটি আধ টুকোর চক। স্লেটে আকার জন্য আগে গ্রামে দেশে যে সাদা চক ব্যবহার করতো সেই চক। দেখলাম তিনি চক দিয়ে দুইটি বাচ্চার অবয়বের মতো ছবি আঁকলো বাচ্চাগুলোর পাশে সম্ভবত তাদের মা দাড়িয়ে। আকা শেষে তিনি ছবির পাশেই শুয়ে পরলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলছে– মানুষগুলো খুব নিষ্ঠুর। আপনিও কি মানুষ?
আমি অবাক হয়ে গেলাম। কি বলবো বুঝতেছিনা। আমি বললাম– না, আমি মৃত মানুষ। লোকটা শোয়া থেকেই দ্রুত উঠে আমার হাত ধরে বললো, মৃত মানুষ ফিরে আসে! তাহলে কি আমার মেয়ে দুটো আর তাদের মা ফিরে আসবে। আমি বাকরুদ্ধ। সারা পৃথিবীর যতো ভাষা আছে সব আমার মুখ থেকে হারিয়ে গেছে। তিনি আবার বলছে– আমাকে বলেছে আমার ছোট মেয়েটা, আমি মরে গেলেও নাকি তাদের কাছে যেতে পারবো না। পৃথিবী থেকেই নাকি তাদের খুজে নিতে হবে। তাহলে কি মৃত মানুষ পৃথিবীতে ফিরে আসে? আমার মেয়ে আর স্ত্রী-ও কি আসবে, না আসছে? আমার কাছে তার এই প্রশ্নের উত্তর নেই। আমি যে পথে আসছিলাম সে পথেই আবার হাঁটছি।
হঠ্যাৎ-ই বাবা সামনে এসে পরলো। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলছে–“বাবা! দুঃখ কোরো না। তুমি অনাথ নও। তুমি তোমার বাবা-মাকে পৃথিবীতেই খুজে পাবে। জীবনযুদ্ধে হার মানতে নেই। তুমি এতো বড় একজন বিজনেসম্যান; ব্যবসায় তোমার এতো সফলতা। তুমি কি তোমার জীবনকে সফল করতে পারবে না। গো ফরওয়ার্ড! বায়।
বাবাও আমায় মিথ্যে প্রত্যাশা দিয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেলো। এটা সম্ভবত আমার অবচেতন মনের কোন খেলা। তবুও বাবার কথা মতোই সামনে এগোচ্ছি। জানি না, এভাবেই বেঁচে থাকার নাম কী জীবন-যুদ্ধ।