মানত

মানত

ঠাকুরঘরে কৃষ্ণনাম জপ করতে করতেই সুহাসিনীদেবী টের পেলেন যে বিলু চুপচাপ তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বিলুটা বরাবরই বড্ড ন্যাওটা তাঁর। একটু বাদেই পুজো হয়ে গেলে দু’টি বাতাসা বা নকুলদানা যতক্ষণ না তিনি দেবেন, ততক্ষণ বিলু ঐভাবেই চেয়ে থাকবে। তাড়াতাড়ি মন্ত্র জপের গতি বাড়িয়ে দিলেন সুহাসিনীদেবী।

মোহরগঞ্জের দীননাথ মুখুজ্জের বাড়িতে ভাদ্রকালীর পুজো বলে কথা, সারা গাঁ যেন ভেঙে পড়েছে। সকাল থেকে বাড়ির বড়মা অর্থাৎ দীননাথ বাবুর স্ত্রী নিজের হাতে পুজোর সব দেখাশুনা করছেন। তাঁদের একমাত্র নাতি, বংশের সলতে বিশ্বনাথ দু’মাস ধরে প্রবল জ্বরে শয্যাশায়ী। হোমিওপ্যাথি-অ্যালোপ্যাথ-কবিরাজী-তাবিজ-মাদুলি কিছুতেই সে আর সারে না। শেষে কুলপুরোহিত বিধান দিলেন – ভাদ্রমাসের অমাবস্যায় দক্ষিণাকালীর কাছে কুচকুচে কালো একটি নধর নিখুঁত পাঁঠা বলি দিলে এই মারণজ্বর থামবে।

কালু ঘোষের ছোট্ট মেয়ে কালিন্দীর খুব মনখারাপ। সকাল থেকেই তাঁদের কেষ্টকে পাওয়া যাচ্ছে না। কেষ্টর মা কেষ্ট জন্মানোর পরপরই মারা গিয়েছিল। নিজের হাতে খাইয়ে দাইয়ে কেষ্টকে বড় করেছে কালিন্দী। কেষ্ট নামটাও ওরই দেওয়া। ওরকম কুচকুচে কালো রং, টানা টানা চোখ। উফফ কেষ্টকে খাওয়ানো কি চাট্টিখানি কথা! সেই কেষ্ট আজ চারবছরের জোয়ান, অভাবের সংসারেও কেষ্টর জন্য কোনো অসুবিধে হয়নি কোনওদিন, ওর খাওয়ার ব্যবস্থা কালিন্দীই করেছে বরাবর। রোজ সকালে কচি কচি কাঁঠালপাতা নিয়ে আসত কেষ্টর জন্য।

“মা―মা―” রবের মাঝখানে সিঁদুরমাখানো খাঁড়াটা তীব্রবেগে নেমে এল। ধড়টা একবার ঝটকা মেরেই থেমে গেল চিরতরে। এক মুহূর্তের জন্য পাঁঠাটার চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন সুহাসিনীদেবী, বড্ড মায়াময় চোখদুটো, কিন্তু ঠাকুরের সামনে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকা বিলুর চোখদুটোর কাছে এর মূল্য কিছুই না।

কালু ঘোষ আজ অনেকদিন বাদে শান্তিতে ঘুমোলেন। দেড়বিঘা জমি সেই বাপের আমল থেকে বন্ধক ছিল মুখুজ্জেদের কাছে। নিজের জমিতেই বাবাকে ভাগচাষী হয়ে থাকতে দেখেছেন জন্মাবধি। নাঃ, আজ থেকে ওই জমির মালিক আবার কালু ঘোষ নিজেই। একেই বলে কপাল, নাহলে পাঁঠার কি আর অভাব গ্রামে? কিন্তু ওই কুচকুচে কালো, বিলুর বয়সী অর্থাৎ চার বছরের, নিখুঁত পাঁঠা আশেপাশের গ্রাম মিলিয়েও ওই একটিই ছিল। মেয়েটা কাঁদছে সকাল থেকে, খায়নি কিছুই, ও দু’দিন বাদে ঠিক হয়ে যাবে সব।

বিলু আর ওঠেনি কোনোদিন। সম্মিলিত “মা―মা―” রবের মাঝখানে তার শেষ “মা―” ডাকটা কারোর কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। ঠাকুরের আশীর্বাদী ফুল নিয়ে বিলুর মাথায় ছোঁয়াতে গিয়ে সুহাসিনীদেবী দেখলেন চোখদুটো স্থির হয়ে গেছে।

কিন্তু ঠাকুরঘরে রোজ দুপুরে বাতাসা খাবার জন্য তাঁর দিকে চেয়ে থাকে বিলু। তড়িঘড়ি জপ শেষ করে ছোট্ট প্লেটে বাতাসা আর নকুলদানা সাজিয়ে নাতির ফটোর সামনে রাখলেন সুহাসিনীদেবী।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত