সহস্র বার হারাচ্ছি আমি

সহস্র বার হারাচ্ছি আমি

দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ভালো করে নিজের রুমের খাটের দিকে তাকালাম। রজনীগন্ধা আর গোলাপে সাজানো খাটে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে আমার সদ্য বিয়ে করা বউ। তাকে দেখতে গিয়ে তার মুখে বিয়ের আগেই শুনেছিলাম তার নাম মিলি। নাম টা বড্ড আদুরে আর মায়াবী, সাথে সেও।
একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাহস করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো’।
আমার কণ্ঠ শুনেই মিলি খাট থেকে নেমে হয়তো আমাকে সালাম করতে চাইলো। তবে আমি তার আগেই বললাম,
‘আপনি বরং বসেই থাকুন’।
সে উঠতে গিয়ে আবার ভালো করে ঘোমটা টেনে বসে আস্তে করে বললো,
‘জ্বী বলুন’।
আমি বলতে চেয়েও বলতে পারছি না। বড্ড ভয় ভয় করছে। কারণ কথা টা বলার পর মিলির আচরণ হয়তো এমন থাকবে না৷

আমার চুপ থাকা দেখে মিলিই বললো,
‘আপনি না আমাকে কিছু বলতে চাইলেন’।
আমি ওর কথাতে মলিন হাসি হেসে বললাম,
‘আসলে কথা গুলো যে কেমন করে বলবো তাই বুঝতে পারছি না’।
‘সমস্যা নেই আমি শুনতে প্রস্তুত আছি আপনি বলুন’।
‘আসলে মিলি, আপনাকে মনে হয় আমি ঠকাতে যাচ্ছি’।
‘ঠকাতে যাচ্ছেন মানে’! একটু হতভম্ব হয়েই বললো মিলি।
আমিও ভয়ে ভয়েই বললাম,
‘হ্যাঁ, আমি হয়তো আসলেই আপনাকে ঠকাতে যাচ্ছি’।
‘আপনার কথার আগাগোড়া কিছুই তো বুঝতে পারছি না। একটু সহজ করে বলবেন’?
আমি একটু চুপ হয়ে গেলাম৷ কারণ এত কড়া কথা কি করে বলবো সেটাই বুঝতে পারছি না।
‘সমস্যা নেই আপনি কথাটি বলতে পারেন। আমি অনেক ধৈর্যশীল একটা মেয়ে। আপনার কথাতে আর যাই হোক ভেঙে পড়বো না’।

মিলির কথা শুনে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেই বললাম,
‘আসলে মিলি আমার বাবা-মা, বোন এমন কি আমিও আপনার আর আপনাদের পরিবারের কাছে একটা কথা লুকিয়েছি। অবশ্য আমি বলতে চেয়েছিলাম আগেই। তবে আমার মা-বাবা, বোন তারা তো আর আমার খারাপ চাইতে পারে না তাই তারা আমাকে বলতে নিষেধ করেছিলেন। তবে আপনাকে সহ একটা পরিবারকে ঠকাতে আমার বিবেকে বাঁধা লাগছে’।
‘কি এমন কথা যে সেটা আমাদের কাছে লুকিয়ে আপনি নিজেকে এতটা অপমানিত ভাবছেন’?
‘আসলে মিলি, আমার না ছোটবেলায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল আর সেটার অপারেশনের কারণে আমি আমার পুরুষত্ব হারিয়ে ফেলেছি। আমার এই সমস্যার জন্য আমি কখনোই আপনাকে “মা” হওয়ার স্বাদ দিতে পারবো না’।
কিন্তু আমার মা-বাবা আর বোন, তারা তো আমার ভালো চায়, তারা তো চায় আমারও একটা সংসার হোক তাই আমাকে এভাবে বিয়ে দিয়েছে। তবে আমি সত্য টা গোপন রাখতে পারছিলাম না বলেই আপনাকে বলে দিলাম’।
‘এই কথাটা কি বিয়ের আগেই বলা উচিত ছিলো না’?
‘আমি আপনার বিষয় টা বুঝতে পারছি। তবে আমিও যে নিরুপায় ছিলাম’।
‘আপনারা শুধু একটা পরিবারকেই যে ঠকালেন তা কিন্তু না সাথে একটা মেয়ের সব’চে বড় স্বপ্নটাও কিন্তু ভেঙে দিলেন’।

‘আমাকে মাফ করবেন প্লিজ’।
মিলি কিছুই আর বললো না৷ তবে আমি ওর ফুঁপিয়ে কান্না করার শব্দ শুনতে পেলাম। কাঁদবে না ই বা কেন? সব মেয়েরই ইচ্ছে থাকে “মা” ডাক শোনার আর বিয়ের রাতেই কে বা বরের মুখে এমন কথা আশা করে?
হতাশ হয়েই বললাম,
‘দেখুন মিলি, আমি চাইলেই এই কথাটি আপনার কাছ থেকে লুকিয়ে ভালো থাকতে পারতাম। আমাদের হয়তো একটা সুখের সংসার ও হতো। তবে সেই সংসারে সুখ বেশিদিন টিকতো না। একটা বাচ্চাই হলো সংসারের পূর্ণতা। আর আমি এভাবে মিথ্যে বলে থাকতেও পারতাম না।
এখন তাই সত্য টা বললাম। আপনি চাইলে কালই চলে যেতে পারেন অথবা আমাকে ডিভোর্স ও দিতে পারেন। আমি চাই না আমার জন্য কারও জীবন, কারও পরিবার, কারও স্বপ্ন ভেঙে যাক। আপনি মন খারাপ না করে ঘুমিয়ে পড়ুন আমি বারান্দায় যাচ্ছি। কাল না হয় সবাইকে বলে চলে যাবেন’।
কথাটি বলেই আমি ঘর থেকে বারান্দায় এসে রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম। আমি জানি মিলি নামের মিষ্টি মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে খুব। তবে আমিও যে নিরুপায়।

কতক্ষণ বারান্দায় বসে বসে ভাবনার জগতে ডুবে ছিলাম মনে নেই তবে ঘোর কাটলো মিলির ডাকে। সে বললো,
‘এমনিতেই বাইরে অনেক ঠাণ্ডা তার উপর বাতাসও হচ্ছে আপনি রুমে আসুন’।
‘সমস্যা নেই আপনি যান’।
‘বাইরে না থেকে রুমে আসুন’।
তার কথার আর অগ্রাহ্য করতে পারলাম না তাই উঠে রুমে চলে আসলাম। এতক্ষণে মিলি শাড়ি পাল্টে একটা কালো রঙয়ের থ্রি-পিচ পড়েছে। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে।
‘রিয়াদ সাহেব একটা কথা বলি’? আমার পাশে বসে মিলি বললো।
‘জ্বী বলুন’।
‘সব মেয়েরই জীবনে কিছু গোপন ইচ্ছে থাকে৷ আমারও ছিলো। আমি সব সময়ই চাইতাম আমার বরকে ভালোবাসবো। প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসবো। আমার একটা ছোট্ট সংসার হবে। দুইটা ছোট্ট ছোট্ট বাবু থাকবে। ওদের পদচারনাতে সারা ঘর মুখরিত থাকবে। তবে সবার ভাগ্যে সব কিছু থাকে না। হয়তো তাই আমারও ছিলো না। তবে রিয়াদ সাহেব,
মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়। আমারও হয়েছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই আমি আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাতে শুরু করেছিলাম। অনেক সংসারেই তো ছেলেমেয়ে হয় না তবে তারা কি সংসার করে না? আমরা না হয় একটা বাচ্চা এডপ্ট নেবো। তবুও আমি আপনাকে ডিভোর্স দেবো না’৷
মিলির মুখে এমন কথা শুনে আমি একদম জমে গেলাম৷ একটা মেয়ে কি করে এতটা ধৈর্যশীল, এতটা কঠোর হতে পারে!

‘রিয়াদ সাহেব’!
‘বলুন’।
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কেন জানেন? কারণ আপনি সত্য টা বলে অনেকটা কষ্ট হালকা করে দিয়েছেন। আর আপনারই তো কষ্ট আমার চেয়ে বেশি৷ ছোট থেকেই এই কষ্ট বোঝা করে চলছেন’।
মিলির কথা শুনে টুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গাল বেঁয়ে গড়িয়ে পড়লো। আমি ওর কথাতে বারংবার মুগ্ধ হচ্ছি।
‘আমি আপনাকে আগে থেকেই স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছি আর আশা করি আপনিও আমাকে বউ হিসেবে মেনে নেবেন। আর আট দশটা সংসারের মতোই আমি সংসার করতে চাই। তবে আমার পরিবারের কেউ যেন আপনার এই সমস্যার কথা না জানতে পারে। বাচ্চা নেবো না নেবো না বলে বছর খানেক কাটিয়ে দেয়ার পর যখন তারা তোড়জোড় করবে তখন বুঝিয়ে বললেই হবে৷ এত বছর পর তো তারা আর সমস্যা করবে না’।
আমি মিলির মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি আর ভাবছি,
আচ্ছা, এটা কি সত্যি কোনো মেয়ে! কোনো মেয়ে এতটাও নির্দয় হতে পারে!
‘রিয়াদ সাহেব শুয়ে পড়ুন। আমারও ঘুম পাচ্ছে। তবে আমাদের আচরণে কেউ যেন না বুঝে যে আমরা অসুখী’।

আমি তার কথাতে শুধু মাথা নাড়ালাম। সে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। আমিও কাপড় বদলে এসে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ঘরে এখন ড্রিমলাইট জ্বলছে। এই ক্ষীণ আলোতেও আমি স্পষ্ট মিলির মুখটা দেখতে পেলাম। কাজল কালো চোখ দু’টো দিয়ে থেকে থেকেই জল গড়িয়ে পড়ছে।
আমাদের বিয়ের তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। আত্মীয়রা যে যার বাড়িতে চলে গেছে। ওদের বাসার আনা নেয়ার কাজও শেষ।
আমার মা তো মিলিকে ঘরের বউ হিসেবে পেয়ে বড্ড খুশি। সব সময়ই আমার বাবাকে বলে,
‘রিয়াদের আব্বা, আমার রিয়াদের বউটা খুব মিষ্টি দেখতে তাই না? যেমন চাঁদবদনী মুখ তেমন সুন্দর তার হাতের রান্না! আমার ঘরটা আলো করে লক্ষ্মী এসেছে’।
মায়ের এমন কথা শুনে মন টা ভরে যায়। আসলেই মিলি নামের মিষ্টি মেয়েটা অনেক মায়াবতী। মাত্র কয়েকটা দিনেই সব কিছু কেমন আপন করে নিয়েছে। ঘরের সব কাজ একা হাতে সামলায়। বাবার খাওয়াদাওয়া, মায়ের ঠিকমত ঔষধ খাওয়ানো, রান্নাবান্না করা সব, সব একাই করছে। মিলিও আমার মা’কে অনেক ভালোবাসে। মা আর বাবার সাথে ওর মিল দেখলে আমারই হিংসে করে। অনেক সংসারেই দেখা যায় বউ আর শাশুড়ির ঝগড়াঝাটির

কথা। অথচ মিলি আর আমার মায়ের মায়া-মমতা দেখলে কেউ বলতেই পারবে না যে এরা বউ-শ্বাশুড়ি।
তবে হ্যাঁ, সবার সাথে মিলি নিজেকে সহজে মানিয়ে নিলেও আমার সাথে ঠিক ততটা মানিয়ে নিতে পারে নি। তবে আমাকে যে ও এড়িয়ে চলে তাও না। আমার সাথে কথা বলে, গল্প করে, অফিসের জন্য খাবার দিয়ে দেয়, সাবধানে যেতে বলে। সব কিছুই ঠিকই আছে। শুধু ভালোবাসার জায়গায় বিশাল বড় ফাঁকা।
আমি প্রায় রাতেই ঘুম ভেঙে দেখি মিলি নামের মিষ্টি মেয়েটা জায়নামাজে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বলছে,
আল্লাহ, আমাকে তুমি ধৈর্যশীল হওয়ার তাওফিক দান করো, সবার সাথে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ থাকার তাওফিক দান করো। আমাদের সংসারে তুমি রহমত দান করো।
মিলির এমন কাজে আমার চোখ দিয়েও টুপ করে জল পড়ে প্রায় রাতেই। মিলিকে বুঝতে দেই না। তবে ভেবে দেখলাম,
সে তো মেয়ে। তারও ভালোবাসার চাহিদা আছে। আমি তাকে কেন তা থেকে বঞ্চিত করছি? এটাও তো ঠকানো।
প্রায় রাতের মতোই আজও কান্নার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। মিলি হুঁ হুঁ করে ডুঁকরে কাঁদছে। আর আল্লাহর কাছে

রহমত, ধৈর্য চাচ্ছে। নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না আর আজ। উঠে গিয়ে মিলির পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে আমিও কেঁদে দিলাম। মিলি শুধু বললো,
‘জানেন তো, আমি না আপনাকে অনেক ভালোবাসি। তবে কোথাও একটা বাঁধা পায় জন্য বলতে পারি না। আমি সব সময় আপনাকে চাই। আপনিও কি ভালোবাসেন’?
আমি যে মিলিকে কতটা ভালোবাসি তা হয়তো বলে বুঝাতে পারবো না। তাই চুপটি করে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকালম। মিলি আমাকে নিয়ে ওর মনের হাজারও কথার খই ফুটাতে শুরু করলো। আমি শুধু ওর কথা শুনছি আর ভালোবাসার পাহাড় বানাচ্ছি। মিলি আমাকে এতটা ভালোবাসে!
মিলিকে প্রথমবারের মত ভালোবাসার বাহুডোরে জরিয়ে নিলাম। আর আমাদের প্রথমবারের মত শারীরিক সম্পর্কটাও হয়ে গেলো।
শেষ রাতের দিকে মিলি আমার বুকে মাথা রেখে বললো,
‘এই ভালোবাসা থেকে কখনও বঞ্চিত করবেন না প্লিজ ‘।
আমিও ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘কখনও করবো না’।
আমাদের প্রথম সম্পর্ক হওয়ার পর থেকেই দু’জনে অনেকটাই গভীর হয়ে গেলাম। মিলিকে এখন হাসিখুশি একটু হলেও দেখা যায়। মেয়েটা আসলেই ভালোবাসার কাঙাল।
দিন যেতে লাগলো। আমার আর মিলির ভালোবাসাও গভীর হতে লাগলো। ওকে হাসিখুশি দেখলে এখন অনেক ভালোলাগে আমার। মায়ের সাথে ওকে এখন আরও অনেক হাসতে দেখা যায়। আমি শুধু দূর থেকে তাকিয়ে দেখি। তবে এখনও মিলি মাঝে মাঝেই রাতে উঠে মোনাজাতে বসে কাঁদে।
কয়েকদিন ধরেই মিলির শরীরটা খারাপ। বারবার মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। বমিও করছে।
মা তাই আজকে আমাকে অফিসে কিছু সময়ের ছুটি নিতে বলে বললেন বউকে নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতে যেতে।
আমিও কয়েক ঘন্টার ছুটি নিয়ে ওকে সহ ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার ভালো করে মিলিকে দেখে মুচকি হেসে বললো,

‘কতদিন হলো বিয়ে করেছেন’?
‘এইতো প্রায় এক বছর’। মিলি বললো।
‘খুশির সংবাদে মিষ্টি খাওয়াবেন না’? বলেই ডাক্তার জোরে জোরে হাসতে লাগলো। আমি চুপচাপ বসে আছি। মিলি ডাক্তারের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো,
‘খুশির সংবাদ মানে’!
‘আরে বোকা মেয়ে তুমি মা হতে চলেছো। তোমার পেটে প্রায় এক মাসের বাচ্চা। সে কারণেই একটু শরীর খারাপ হয়েছে’।
ডাক্তারের কথা শুনে মিলি অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকালো। আমিও সেভাবেই ওর দিকে তাকালাম। ডাক্তার কিছু ঔষধ লিখে দিয়ে আবার বললেন,
‘এখন থেকেই নিজের ভালো করে যত্ন নিবেন কেমন’?
ঔষধ কিনে গাড়িতে করে বাসায় যাচ্ছি। মিলি একদম চুপচাপ৷ জানি কি নিয়ে ও ভাবছে। ও এখনও বিশ্বাসই করতে পারছে না যে ওর পেটে বাবু! আমি শুধু ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসছি।
ওকে বাসায় রেখেই আমি অফিসে চলে গেলাম। আর মিলি ঔষধ রেখে মায়ের ঘরে গেলো।
মা’কে গিয়ে মিলি বললো,
‘আম্মা, আপনাকে একটা কথা বলি’?
‘বলো মা আর ডাক্তার কি বললো? শরীর ভালো তো ‘?
‘সেটা পরে বলছি আগে আমি যা বলি তার উত্তর দেন’।
‘বলো কি বলবে’।
‘আম্মা, আপনার ছেলের কি ছোটবেলায় বড় কোন একসিডেন্ট হয়েছিলো’?
‘কেন মা কি হয়েছে ‘?
‘আপনি আগে বলেন তো’।
‘বড় একসিডেন্ট হয়েছিলো না তবে সাইকেলের সাথে ধাক্কা লেগে মাথা কেটে গেছিলো। কেন মা কি হয়েছে ‘?
‘আচ্ছা মা ওর একসিডেন্ট এর কারণে কি ও আর বাবা হতে পারবে না এমন কিছু হয়েছিলো’?
‘হা হা হা, কি যে বলো না তুমি মা এসব কেন হবে। এমন কিছুই হয় নি শুধু কপালে দুইটা সেলাই দেয়া হয়েছিলো’।
‘তার মানে আপনার ছেলে আমাকে মিথ্যে বলেছে’!
‘কি হয়েছে মা’?
‘কিছু হয় নি মা আগে আপনার ছেলে আসুক তারপর দেখবেন ওর কি হালটা আমি করি’। বলেই মিলি নিজের ঘরে গিয়ে রাগে লাল হয়ে বসে পড়লো। রাগ আর খুশিতে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আর মনে মনে বলছে,
আমাকে এতদিন মিথ্যে বলে কষ্ট দেয়ার ফল আমি দেখাবো।
রাত সাতটা বাজে। অফিস থেকে ফিরে কলিংবেল বাজালাম। দরজা খুললো মিলি। তাকিয়ে দেখি একদম চুপচাপ। আমি রুমে এলাম আর আমার পিছেপিছে মিলিও এলো। আমি ওয়াশরুমে ঢুকলাম তাকিয়ে দেখি ও দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রেশ হয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললাম,
‘কিছু বলবে’?

কথাটা বলতে না বলতেই এক ঝাপটায় মিলি আমার বুকে এসে আছড়ে পড়ে কিল ঘুষি মারতে মারতে বললো,
‘ইতর, বাঁদড়, শেয়াল, ভাল্লুক এভাবে আমাকে মিথ্যে বলে কষ্ট দিলে’!
আমি না বোঝার ভান করে বললাম,
‘আমি আবার কি করলাম’?
‘কি করলে না! আমাকে এভাবে কষ্ট দিলে? আমাকে মিথ্যে বলে কি লাভ হলো হ্যাঁ’?
‘আরে বাবা কি করলাম আমি’?
মিলি আর কোনো কথা বললো না। খামচি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে রইলো। একটু পরই বুকটা

ভেজাভেজা লাগলো। মিলির মুখটা তুলে দেখি ওর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় জল পড়ছে। নাহ, অনেক কষ্ট দেয়া হয়ে গেছে আর না। মিলি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কেন এমন করলে তুমি? কেন এতদিন কষ্ট দিলে বলো’?
‘এই কষ্ট টা না দিলে কি আজকের এই খুশির দিন টা দেখতে পেতাম বলো’?
‘তাই বলে কেউ এভাবে মিথ্যা বলে? এভাবে মজা করে! আমি যদি ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতাম তো’!
‘আমি জানতাম আমার পাগলি বউটা আমাকে খুব ভালোবাসে। সে আমাকে ছেড়ে যাবেই না’।
‘আচ্ছা তুমি এটা বলে কেন মজা নিলে? ব্যাপারটা কত্ত সাংঘাতিক ভেবেছো’!
‘সব ভেবেই করেছিলাম। আসলে আমার ইচ্ছে ছিলো বিয়ের রাতে এটা বলার। মেয়েটা যদি সত্যি ভালো হয় মানে তোমার মত তো সে থাকবে আর ভালো না হলে চলে যাবে। তুমি থেকে গেছো। আর আমার জানা মতে এমন অবস্থায় যে থাকে সেই মানুষ টাকে কখনও হারাতে নেই। আমি কখনোই তোমাকে হারাতে চাই না ‘।
‘তুমি না, তুমি আসলেই খুব পঁচা খুব খুব। বলেই মিলি সজোরে আমার বুকে আবারও কিল ঘুষি মারতে শুরু করলো। আমি কোনো রকমে ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম,
এত কষ্ট করে মেরো না আর না হলে আরেকজন কষ্ট পাবে’।
‘আরেকজন মানে’!
‘আরেকজন মানে কে বুঝো না’?

‘কে’?
আমি ওর পেটে হাত রেখে ওর চোখের দিকে তাকালাম। মিলি খুব সহজেই আমার চোখের ভাষা বুঝে নিলো। তারপর লজ্জায় বুকে মাথা রেখে বললো,
‘আর কখনও কষ্ট দেবে’? এমন করে মজা করবে আর’?
‘উঁহু, আর কখনও না’।
‘মনে থাকবে তো’?
‘থাকবে গো, থাকবে’।
‘যদি কখনও কষ্ট দাও না তো সেদিনই তোমাকে ডিভোর্স দেবো হু’।
মিলির কপালে চুমু দিয়ে বললাম,
‘তোমার স্বপ্ন, তোমার ছোট্ট একটা সংসারের ইচ্ছে ছিলো না’? তুমি বলেছিলে দুইটা পিচ্চি বাচ্চা থাকবে। একটা হতে চলেছে আরও একটা না নিয়েই ডিভোর্স দেবে’?
কথাটা বলে মিটমিট করে হাসতে না হাসতেই মিলিও ফিক করে হেসে দিলো।
মায়াবতী টা হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। আর সেই হাসির মাঝে নিজেকে সহস্র বার হারাচ্ছি আমি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত