সময় অসময়

সময় অসময়

হাত থেকে পড়ে এই মাত্র গ্লাস টা ভেংগে গেলো। আসলে পড়ে নি আমি ই ভেংগেছি। নিজের উপর অসম্ভব রাগ এই গ্লাস এর উপর দেখিয়েছি। আসলেই পোড়া কপাল আমার।

আশে পাশে আনাচে কানাচে এত মেয়ে থাকতে আমি কিনা প্রেমে পড়েছি ঘরের ভেতর। খোদ নিজের ঘরের ভেতর। ভাবা যায়!!!

আর প্রেমে পড়েছি যার তার সাথে সেই ছোট্ট বেলায় ঝগড়া বাঁধিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। কে জানতো মেয়ে মানুষ দেখতে না পারা এই আমি এই ভাবে একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাবো!!

মেয়েটি আর কেউ নয়। আমার ছোট খালার মেয়ে। আমার ছোট খালা ভয়ংকর মহিলা। ডাক সাইটে সে ডাকু রাণী নামে পরিচিত। সবাই ভয় পায় ওনাকে।

তার ঘরে কিনা জন্ম হয়েছে ইরার। যেমন নরম স্বভাবের তেমনি মায়াবতী।

ইরা আমাদের বাসায় থেকে কলেজে পড়তে এসেছিলো।

ছোট বেলায় হাজার ঝগড়া করলে ও ইরা কে মনে মনে আমার বেশ লাগতো। এই কথা ঘুণাক্ষরে ও আমি কাও কে বলতে পারি নি। কারণ সবাই জানে মেয়ে মানুষ থেকে আমি একশ হাত দূরে থাকি।

সেই ইরা আমাদের বাসায়। কিন্তু এই মেয়ে যে আমাদের বাসায় থাকতো তা সহজে ধরা যেত না।

কারণ সে সারাক্ষণ তার টেবিলে বই পড়া নিয়ে ই ব্যস্ত থাকতো। আমার সামনে ইরা খুব কম ই পড়ত।

শুধু আমি টের পেতাম ইরা রাতে কখন ঘুমায়?

রাত জেগে পড়ার স্বভাব ওর। মাঝে মাঝে ও ডাইনিং এ আসত পানি খেতে বা ফ্রিজ থেকে কোনো খাবার নিতে।

তখন আমি ও সুযোগ বুঝে কোনো কিছুর দরকার দেখিয়ে ওর সামনে দিয়ে কিচেনে ঢুকতাম।

রাতে প্রায় ই আমি নুডুলস বা রঙ চা বানিয়ে খেতাম। খেতে যেমনি হোক না কেনো আমার খুব ইচ্ছে করতো ইরা কে ডাকি।

দুজন মিলে বসে বসে খাই। কিন্তু ইরার সাথে ত আমি কথা ই বলি না। সেই ছোট্ট বেলা থেকে।

বাসায় কেউ কিছু মনে ও করে না। সবাই জানে আমি মেয়েদের সংগ খুব একটা পছন্দ করি না।

ইরা থাকতো মিলির সাথে। মিলি আমার ছোট বোন। মিলির সাথে কথা বলার সুযোগে যে আমি ইরা কে দেখতে যাবো সেই কপাল ও আমার ছিলো না।

কারণ মিলির সাথে ও যে আমার ঝগড়া লেগে ই থাকতো। বড় ভাই হিসেবে মিলি কে আমি শাসন করি এই নিয়ে আমাদের মধ্যে লেগে ই থাকতো সব সময়।
.
উফ! মিলির সাথে সম্পর্ক টা ভালো করা উচিৎ এমনি মনে হত তখন। কিন্তু এখন ভালো করলে মিলি টা যে সন্দেহ করে বসবে এ নিয়ে ও ভয় পেতাম। ও একটা মিচকা শয়তান কিভাবে যেনো সব ধরে ফেলতো।

ইরা আসার সাথে সাথে তখন একটা পরিবর্তন আমি ধরতে পারি। আমার পরিবারের সবাই প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক সাথে বসে চা খেত যা আগে কোনো দিন হয় নি। ইরা নিজ হাতে চা বানাতো।

শুধু আমি সেই চা খেতাম না। ভাব ধরে থাকতাম সব সময়। যেনো এসব চা টা খেলে স্বাস্থ্যর বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।

কিন্তু সত্যি কথাটা তো আমি মুখিয়ে থাকতাম ইরার হাতের এক কাপ চা এর জন্যে। কিন্তু আমার মনে হত আমি চা খেতে চাইলেই সবাই বুঝি বুঝে ফেলবে আমি ইরার প্রেমে পড়ে গেছি!!! কি সব আজগুবি চিন্তা ছিলো আমার!

ছোট বেলা থেকে ই আমি নারী জাতি থেকে একশ হাত দূরে থাকি কথা সত্য। কিন্তু এ ও সত্য ছোট বেলা থেকেই ইরা আমার মনে বসত গেড়ে আছে।

আমাদের ড্রইং রুমে টিভি। ইরা খুব কম টিভি দেখতো। আমি ভাবতাম ওর একটু টিভি দেখার অভ্যাস থাকলে কি হত? আমার রুম থেকে আমি ওকে সরাসরি দেখতে পেতাম!

ওর অবসর সময়ে ও খালি গল্পের বই পড়তো। আমি অবাক হয়ে তখন আবিষ্কার করি আমাদের বাসায় ও ছোট খাট একটা লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছে শুধু তাই ই নয় আমার ছোট বোন, মা এমনকি আমার খাড়ুস বাবা টা ও সময় পেলে বই এর পাতা মেলে ধরতো। আমার খুব ইচ্ছে হতো ইরার শেষ পড়া বই টা মেলে ধরে ওর ঘ্রাণ নিতে।

কিন্তু আমার ভাব রক্ষার্থে আমি কিছুই করতাম না।

মনে মনে পুড়তে থাকতাম।

মাঝে মাঝে জোরে জোরে গান চালাতাম। চাইতাম ইরা শুনুক। ও হয়তবা শুনতো ও। কিন্তু বুঝতো ত না এই সব গানের প্রতিটি লাইন আমার মনের ভেতর কার কথা ছিলো।

এরই মাঝে একদিন পড়ার সময় গল্পের বই পড়া নিয়ে মিলি কে আচ্ছা করে বকে দিলাম শুধু তাই নয় ওর হাত থেকে বই টা নিয়ে ছিঁড়ে ও ফেললাম। পরে বুঝতে পেরেছিলাম এটা ইরার বই।

ইরা খুব কষ্ট পেয়েছিলো। আমি কান পেতে শুনেছিলাম ইরা খুব বকেছে আমাকে। আমার ইচ্ছে করছিলো ইরা কে সারা পৃথিবীর সব বই এর সামনে দাঁড় করিয়ে বলি

, ” ইরা এই তোমার বই এর সাম্রাজ্য। আর তুমি এই রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। ”

আমি জানি ইরা আমাকে পছন্দ করে না। কারণ সবাই জানে আমি খুব রাফ টাইপের। মেয়েদের খুব একটা পছন্দ করি না। ইরা ও তাই জানে।

কিন্তু আমি ইরা কে কত টা পছন্দ করি তা হয়ত তাকে আমি বলতে পারবো না।

এরই মাঝে মিলি কিভাবে যেনো টের পেয়ে গেলো আমি ইরার প্রতি দুর্বল। সে এক অদ্ভুত কান্ড করলো। সে ইরা আর আমার মাঝে কমিউনিকেশন এর ব্যবস্থা করে দিতে চাইলো কত বার।

ইরা র ও সায় ছিলো খানিকটা কিন্তু নিজের ঠাঁট বজায় রাখতে আমি এসব আজেবাজে সময় নষ্ট বলে সরে এলাম।

কিন্তু নিজের মনে অসম্ভব যন্ত্রণা হতে লাগলো।

সময় তো আর বসে থাকে না। ইরার ও আমাদের বাসায় থেকে পড়ার সময় ফুরোলো। ইরা যেদিন চলে গেলো আমি ছাদে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদলাম কিন্তু নিচে এসে মিলি কে বললাম,” ঘর টাতে এবার শান্তিমত ঘোরাফেরা করা যাবে। ”

মিলি কেমন অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকালো।

মাঝে অনেক গুলো বছর কাটলো। চাকরি বাকরি করছি আমি। ইরা র সাথে দেখা হয় ঈদে বা কোনো বিয়েতে পরিবারের সবাই এক হলে।

সেই এক নজর দেখা ই। কথা আর হয় না।

ওই এক নজর দেখলেই আমার মন টা আবার ওলোট পালট হয়ে যায়। কিন্তু আমি পাষাণ এর মত নিশ্চল থাকি।

বাসায় আমার বিয়ের কথা বার্তা শুরু হয়েছে। আমি বরাবর ই না না করছি।
.
এমন সময় শুনলাম মা আর ছোট খালা মিলে ঠিক করেছে আমার আর ইরার বিয়ে দিবে।

এই কথা কানে যাওয়া মাত্র আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এত আনন্দ এই জীবনে আমি পাই নি। দুই পরিবার এর মধ্যে ই হালকা পাতলা কথা হচ্ছে।

এরই মাঝে খানিক আগে মিলি এসে বললো,

” নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা বোধ হয় একে ই বলে।”

আমি বুঝতে পারলাম না মিলি কি বলছে।

“কি আবোল তাবোল বলছিস বল তো?”

” বলছি তোমার কথা। নিজের দোষে আজ তোমার এই দিন দেখতে হচ্ছে!”

” কি দিন? কি বলছিস?”

” ইরা আপু কে তুমি ভালোবাসো এই কথাটা আগে বললে আর এই দিন কি দেখতে হয়?”

” উফ কি বলছিস ভালো করে বল। না বলে ক্ষতি কি করেছি বিয়ের কথা ত চলছে।”

” ইরা আপু তোমাকে বিয়ে করবে না।”

আমার চোখ কপালে উঠলো,

” বিয়ে করবে না মানে কি?”

” ইরা আপু একটা ছেলেকে পছন্দ করে।।ভার্সিটি তে তারা এক সাথে ই পড়ে। তাই সে সাফ মানা করে দিয়েছে সে তোমাকে বিয়ে করবে না।”

মিলিকে আর কিছুই বলতে পারলাম না আমি।

বুক টা খাঁ খাঁ করছে ।

চোখ ভেংগে কান্না পাচ্ছে আমার।

ভাংগা গ্লাস টার কাচে হাত কেটে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু কোনো ব্যথা হচ্ছে না। ব্যথা হচ্ছে আমার মনে।

সেদিন যদি ইরা কে নিজের মনের কথা টা বলতে পারতাম হয়ত আজ ইরা আমার ই হত।

শুধুই আমার আর কারো নয়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত