শেষ চিঠি

শেষ চিঠি

চাপা কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় অবনীর৷ মিনিটখানেক চুপ থাকার পর বুঝতে পারলো মায়ের রুম থেকে আসছে কান্নার আওয়াজটা৷

চোখ কচলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায় অবনী৷
আজ অক্টোবর মাসের ২৭তারিখ৷
তারিখটা দেখেই অবনীর মনটা খারাপ হয়ে যায়৷
আজ অবনীর ছোটভাই রাফির জন্মদিন৷

কান্নার আওয়াজটা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে৷
অবনী শোয়া থেকে উঠে বসে৷ অতীতের কথাগুলো ভাবতে গিয়ে চোখের কোণে ছলছল করা জলগুলো গড়িয়ে পরে৷
চোখ মুছে মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায় অবনী৷
অবনীর মা রহিমা বেগম পুরনো একটা কাগজ বুকে লাগিয়ে কেঁদে চলেছেন৷
কাগজটা দেখে অবনীরও কান্না আসে৷
তার ছোটভাই রাফির লিখা শেষচিঠি৷
অবনী যতবার মাকে পড়িয়ে শুনিয়েছে ততবারই গলা ধরে এসেছে৷ বুকের ভেতর তীব্র ব্যাথা অনুভব করে অবনী৷
-মা একটু পড়ে শুনাবি? আমার ছোট্ট খোকার কথাগুলি!
মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে অবনীর৷
গলার পাশে হালকা ব্যাথা অনুভব করে৷
মায়ের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়া শুরু করলো অবনী,

প্রিয় মা,
একপৃথিবী ভালোবাসো আমায় তুমি৷ সেটা আমি খুব জানি৷ সেই ভালোবাসায় যতই পাথরচাপা দাও না কেন! সেই ভালোবাসাটা আমি খুব অনুভব করি৷
কিন্তু তুমি তো জানোই মা৷ তোমার খোকাটা সেই ছোট্ট থেকেই বড্ড অভিমানী৷
বিশ্বাস করো মা৷ আমি রাতে ঘুমোতে পারি না৷ছোটবেলা থেকেই ঘুমোনোর আগে আমার কপালে চুমু খেয়েছো৷ সেই চুমুটা আমি মিস করি মা৷

প্রচন্ড মন খারাপে তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি৷ জ্বর বাঁধালে তোমার হাতে খেয়েছি৷
জানো মা, আমার এখনও যখন জ্বর আসে৷ আমি খুব কাতর হই৷ জোরে জোরে কাতরানোর শব্দ করি৷ যাতে আমার কাতর কন্ঠটা তোমার ভালোবাসা পর্যন্ত পৌছায়৷ খুব আশায় থাকি এই বুঝি তুমি এসে জলপট্টি দিবে আমার কপালে৷ পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিবে তুমি৷
কিন্তু সে আশা আর পূরণ হয় না৷ আমার কাতর কন্ঠস্বরটা তোমার অভিমানের দেয়াল টপকানোর শক্তি পায় না৷
জানো মা! সেদিন তোমার শাড়িটা কিভাবে ছিড়েছে?
সেটা আমি ছিড়েছিলাম মা৷ সেই ছেড়া অংশটুকু দিয়ে আমার কপালে নিজেই জলপট্টি দিয়েছিলাম৷
ছেড়া শাড়ির টুকরোটাতে তোমার স্পর্শের ছোয়া পেয়েছিলাম অামি৷
তুমি যেদিন বিরিয়ানী রান্না করতে বাসায়৷
সেদিন আমি বড্ড আশা নিয়ে রুমে চুপটি মেরে বসে থাকতাম৷
এই বুঝি তুমি ডেকে বলবে “খোকা! আয় বিরিয়ানী খাবি৷”
সেই আশাটাও আর পূরন হয় না মা৷
টং দোকান থেকে ২০টাকার বিরিয়ানী এনে তোমার রান্না করা বিরিয়ানীর স্বাদ মেটায় আমি৷
তোমার যখন মাথায় যন্ত্রণা করে৷ আমার খুব ইচ্ছে করে তোমার মাথা টিপে দিই৷
কিন্তু পারি না মা৷ কী করে পারবো বলো?
তুমিতো বলেই দিয়েছো তোমাকে যাতে না ছুই আমি৷
তুমি যখন বলো,
তোর বাবাকে তো খেয়েছিস৷ এখনও আমাকেও খাবি নাকি?
আমার বুকটা তখন ফেটে যায়৷ আমি গলাটা বন্ধ হয়ে আসে৷ আমি হাউমাউ করে কাঁদতে পারি না৷
কিন্তু মা তুমিইতো আমাদের শিখিয়েছিলে “জন্ম-মৃত্যু আর বিয়ে এই তিনটা জিনিস সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত”
কিন্তু সেই কথাটা তুমিই দিব্যি ভুলে গেলে৷

আমি যখন রেজাল্টের জন্য টেনশন করতাম৷ তখন কিন্তু তোমরাই বলতে “একটা সার্টিফিকেট মানেই জীবন নয়”
কিন্তু সেই দূর্বল সার্টিফিকেট এর জন্য তোমরা আমাকে পর করে দিলে৷

পাশের বাসার মেয়েটা আমার চেয়ে অনেক ভালো করেছে!মেয়েটার মা মুখ বাকিয়ে বলেছে “আপনার ছেলেতো খুব দূর্বল পাশ করেছে” সেটাই আমার জন্য কাল হলো৷

কিন্তু তোমরাই বলেছিলে,
পাছে লোকের কথায় কান দিতে নেই৷
দেখো! সেই কথাটাও তোমরা ভুলে গেলে৷
তুমিতো জানোই মা! তোমার খোকা চা ও বানাতে পারি না৷
সেই খোকাটা কিভাবে ভাত রান্না করবে?
পোঁড়া ভাত আর ডিমভাজি খেয়ে যতটা না আমার মন পুড়েছে৷
তার চেয়ে বেশি পুড়িয়েছে তোমার আর আমার বোনটার আচরণগুলো৷
আমি জানি, বাবা বেঁচে থাকলে বুকে জড়িয়ে নিতেন৷ যে রাতে বাবা রাগ দেখিয়েছিলো আমার সাথে৷
সেই রাতটা আমি ঘুমোইনি৷
বড্ড আশায় ছিলাম৷, বাবা এসে বলবে,
আয় খোকা বুকে আয়৷
কিন্তু বাবাটাতো আর জেগে উঠলোনা৷

যে আপুটা আমাকে কলিজা ভাবতো৷ সেই আপুটা তার জন্মদিনে আমাকে রুমবন্ধ করে রাখে৷ যাতে কারো সামনে পরতে না হয়৷

আপুটা যখন বন্ধু-বান্ধব আর তাদের ছোটভাইদের নিয়ে পিকনিক করে৷
সেই পিকনিকে আমার জায়গা হয় না৷
আমি টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম৷ অনেকদিন পর ভালো খাবার খাবো বলে৷
কিন্তু আপুর মোটা করে বন্ধুটা বলল, আমি পিকনিক এ যোগ দিলে নাকি আপু খাবে না৷
আপুর বান্ধবী পিংকি আপুর ছোট ভাইকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম৷
বেতন ছিল একবেলা খাওয়া৷
আমার জন্য ঐ বেতনটাই অনেক কিছু৷ আমি যে পোঁড়াভাত আর পোঁড়া ডিমবাজি ছাড়া কিছুই খেতে পারিনা৷
কয়েকদিন পর তারাও না করে দিলো৷
আমার একবেলা খাওয়া বেতনটা নাকি আপুর গায়ে লাগছিল৷
কেন গায়ে লাগবে মা?
তুমিই বলোতো?
আমি কি চুরি করছি?
শ্রম দিয়ে বেতন নিচ্ছি৷
আমার এসব সহ্য হচ্ছে না মা৷
আত্মহত্যা মহাপাপ বলে৷ নয়তো চলে যেতাম সবাইকে ছেড়ে৷
আচ্ছা মা, তোমরা শরবতে গুলিয়ে বিষ খাইয়ে দিতে পারো না?
আমি শান্তি পেতাম মা৷
তোমার হাতের সবকিছু যে আমার কাছে অমৃত৷
অনেককিছু বলে ফেলেছি মা৷
তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই৷
ভালো থেকো তোমরা৷
আমার মৃত্যুদন্ড হলে খুশি হতাম, কিন্তু মা আমারটা তিলে তিলে মরার দন্ড৷
এই দন্ড আমি নিতে পারছি না৷
বিদায় মা, আপু ভালো থেকো তোমরা৷
শেষটুকু পড়েই মায়ের কোলে মুখ লুকোয় অবনী৷ রহিমা বেগম থমকে যায়৷
কলিংবেলটা বেজে উঠে৷
মা, মেয়ের মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠে৷
এই বুঝি খোকা ফিরে এল৷

দরজা খুলেই হতাশ হয়৷ ধুপির দোকানের ছেলেটা এসেছে৷ আয়রন করতে দেয়া কাপড়গুলো পুরনো পেপার মুড়িয়ে এনেছে৷

অবনী কাপড়গুলো হাতে নিতেই পুরনো পেপারের ছবিটাতে চোখ পরে৷
যার হেডলাইনে লিখা “বাইক এক্সিডেন্টে দুই কিশোর নিহত৷ এক কোণে রয়েছে দু’জনের ছোট্ট দু’টো ছবি৷ একটাতে তার ভাই সেটা চিনতে এতটুকুও কষ্ট হয় না অবনীর৷

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত