ছানাবড়া হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের বেশে বাসায় ঘোরাফেরা করেন। কথাও বলেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত করে। ঘর জুড়ে কবিতার বই। আমাকে দেখে লম্বা দাঁড়িতে হাত বুলালেন কিছুক্ষণ, চশমা খুলে একবার আপাদমস্তক দেখলেন আবার চশমা চোখে দিয়ে আপাদমস্তক চেক করে নিলেন। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমার অবস্থা প্রায় শেষ!
‘ দাঁড়াইয়া রহিছো কেন? বসিয়া পড়ো’ গম্ভীর গলায় বললেন। আমার গলা শুকিয়ে গেছে। প্রেম করা যত সহজ, প্রেমিকার বাবার সামনে দাঁড়ানো ততটাই কঠিন। ধুর আমি কি এসব আবল তাবোল বকছি, প্রেম করাই বা সহজ ছিলো কবে?
আমি সোফায় বসে দুই হাতে নাক গুঁজে দিলাম।
‘খাচ্চর!’
‘জি?’
‘কি করো?’
‘বেকার’
‘আমার মেয়েকে ভালো লাগে?’
‘জি’
‘রবীন্দ্রনাথ ভালো লাগে?’
‘অসম্ভব ভালো লাগে’।
‘নজরুল?’
‘অত্যাধিক! উনার একটা গান আমার বেশ লাগে, গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ… আনিকাকে নিয়ে রাঙামাটি যাওয়ার সময় এই গানটা গাইবো, একটা সেলফি ভিডিও করে আপনাকে পাঠিয়ে দিবো’।
‘খামোশ! ওটা রবী’র গান। নজরুলের না। আজকালকার ছেলে, রবীন্দ্র নজরুলের মধ্যে তালগোল পাকায়’।
‘একদম না আংকেল। আমি নজরুল ভক্ত, তাই যেকোনো গান নজরুলের সুরে গাইতে পছন্দ করি। যেমন গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ আমি গাইবো খুব বিদ্রোহী কন্ঠে, কিউট নাহ?’
‘কবিতা পড়ো?’
‘পড়ি মানে? রোজ লিখি! আনিকা তো আমার কবিতার প্রেমে পড়েছিলো’।
আনিকার বাবা আরেকবার আমার গালের দিকে তাকালেন। ‘পাঁচটা কবিতা লিখে কালকের মধ্যে হাজির হও, কবিতা পছন্দ হলে তুমি পাশ’। সালাম দিয়ে বিদায় নিতেই আনিকা দরজায় আঁটকে দিলো।
রেগে লাল হয়ে বললো, ‘ কবিতার ক পড়ছো জীবনে? আমাকে পটাইসো তো প্লে স্টোর থেকে একশ একটি রোমান্টিক মেসেজ” ডাউনলোড দিয়ে। ভাবছো আমি কিছু বুঝিনা? এখন কি করবা?’
আনিকাকে আশ্বস্ত করলাম, ‘ তোমাকে পটাতে পারলে তোমার বাপকে পটাতে পারবোনা কেন?’ বাবাকে বাপ বলায় ও রেগে গেছে, আনিকা রাগলে আশপাশে ভঙুর কিছু রাখা যাবেনা। দ্রুত ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাতে কথা হবে বলে বিদায় নিলাম।
পরদিনের উত্তপ্ত দুপুর। কবি কবি বেশ ধরে সাদা পাঞ্জাবি পরে আনিকার বাবার সামনে হাজির। ‘ কবিতা নয়’ নামে আমার লেখা কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনাচ্ছি ভদ্রলোককে।
“আমার এই কবিতা, নয় শুধু কবিতা
এখানে রহিয়াছে বাঁধা, প্রিয়তমার ছবিটা।
কবিতার শেষে, রাজকুমারীর বেশে
প্রিয়তমা এসে, নিলো মোরো;
ভালোবাসার দেশে!”
“সাব্বাশ! সাব্বাশ! কি ছন্দ! চেনা গন্ধ! তবুও আমি অন্ধ! তোমার কবিতায়, তোমার ভাবনায়” – এই সেরেছে! মারাত্মক সাহিত্যানুরাগী কারো সাথে কবিতা নিয়ে নকলবাজি করে ধরা খেলাম নাকি? ভয়ে বুক কাঁপছে। এ বাড়ি থেকে পালানোর উপায় থাকলেও আনিকাকে মুখ দেখাবো কি করে?
ভদ্রলোকের হাসি বেশ রহস্যেঘেরা। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আনিকাকে ডেকে পাঠালেন গম্ভীর গলায়।
‘ এই ছোকরার সাথে কয়দিনের পরিচয়?’
‘ বাবা এইতো তিন বছর’, আনিকার নিজেরও গলা শুকিয়ে গেছে।
‘ আমার একমাত্র মেয়ে তুমি। সবসময় তোমার ভালোটাই চাই’
বুঝে গেছি কপালে আনিকা নেই। একটু দূরে যেয়ে ফেসবুক থেকে আনিকার সাথে রিলেশানশীপ স্ট্যাটাস মুছে দিতে যাবো ঠিক তখনই আনিকার বাবা বললেন, ‘ হা হা হা! আমার মেয়ে সঠিক মানুষকেই বেছে নিয়েছে। আমার মেয়ে তো!’
আমার মনে তখন বিয়ের সানাইয়ের সুর বেজে উঠলো। ঠিক যেভাবে নাটক, সিনেমায় প্রেম সফল হলে একটা সানাই বাজে, সেভাবে। কি আনন্দ!
বেশ আনন্দে আমার ও আনিকার বিয়ে সম্পন্ন হলো। আমরা একে অপরকে পেয়ে খুশি। বাসর রাতে এত ব্যস্ততা দেখাতে নেই। কিন্তু আনিকার ব্যস্ততা আছে। সেদিন থেকেই কান জ্বালিয়ে ফেলা প্রশ্ন, ‘ বলোনা বলোনা, তুমি এই কবিতা কিভাবে লিখলে?’ আজ সেই মহেন্দ্রক্ষণ! আমি উত্তর দিবো।
‘ তুমি কিন্তু আজ বলবাই কিভাবে কবিতা লিখেছো’
‘ আরে ধুর, আমি জীবনে কবিতা পড়িইনাই, আবার লেখা?’
‘ তাহলে কোত্থেকে মেরে দিয়েছো? এই বস্তাপঁচা কবিতাটিই বা বাবা কিভাবে পছন্দ করলো?’
‘ তুমি বউ। তোমার কাছে মিথ্যা বলবোনা’
‘ তুমি সাসপেন্স কেন বাড়াচ্ছো?’
‘ কপি করেছি’
‘ কারো ফেসবুক থেকে?’
‘ নাহ! আজ থেকে আঠাশ বছর আগে লেখা এক কবি’র কবিতার বই থেকে’
‘ এত্ত জনপ্রিয় কবিতা? কয়বার ছাপা হয়েছে কে জানে!’
‘ নাহ! এই বই মোটে একশ টা ছাপা হয়েছে। কেউই কিনেনি। আমিই আঠাশ বছর পর এর একমাত্র ক্রেতা’
‘ এজন্যেই এত্ত বস্তাপঁচা’
‘ ভালো কবিতা মেরে দিলে তো তোমার বাবা বুঝে যেতো’।
‘ তা অবশ্য ঠিক। তখন বিয়েটাও হতোনা’।
‘ এই কবিতার বইয়ের একটা মজার ব্যাপার কি জানো?’
‘কি?’
‘ একশ কপির মধ্যে নিরানব্বই কপিই কবি নিজে কিনে নিয়েছিলো, তৎকালীন প্রেমিকাকে পটানোর জন্য। তাঁদের পরে বিয়েও হয়! তো আমি শুধু একটা কবিতাই না হয় চুরি করলাম’।
পাঁচটি কবিতা লিখে আনিকার বাবাকে দেখানোর সময় একটি চিরকুট ও দিয়েছিলাম। ‘ আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আপনি যদি আজ থেকে ২৮ বছর আগে নিজের কবিতার বই নিজেই কিনে নিয়ে প্রেমিকার সামনে জনপ্রিয় কবি না হতেন, আজ পৃথিবীতে আনিকা নামে কাউকেই আমি দেখতাম না। এই ব্যাপারগুলো জেনেছি নীলক্ষেতে কম বিক্রিত বইয়ের খোঁজ করতে গিয়ে, অর্থাৎ যে বই কেউ পড়েনা। লেখকের নাম দেখে সন্দেহ জাগে, ছবি দেখে নিশ্চিত হয়েছিলাম। একটাই বই রেখেছেন ভালো কথা, তাও বন্ধুর দোকানেই কেন রাখতে গেলেন? আচ্ছা রাখলেনইবা না হয়, সেই বন্ধুর সাথে কয়েকবছর আগে কেন ঝামেলা করলেন? ঝামেলা না করলে বই বিক্রি করতে যেয়ে সে এত্তগুলো কথা আমাকে বলতো না। এখন যদি এত বছর আগের কাহিনী আনিকার মা জানেন, কি অবস্থা হবে ভাবতে পারেন?’
ব্যাস। বউকে বাঘের মতো ভয় পাওয়া আনিকার বাবা পটে গেলেন মুহূর্তেই। কন্যা দান করে দিলেন আমার কাছে। কন্যা এখন কবি’র নিজের বই নিজে কেনার গল্প শুনেই হাসিতে কাটাকুটি হচ্ছে। আনিকা জানেনা, কবিতার বইটা তার বাবারই লেখা একমাত্র ফ্লপ কবিতার বই!
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প