বাবা যখন মারা গেলো তখন আমার বয়স আট কী নয় বছর,আর মা ছোট ভাইটা কে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। মা যখন মরেছিলো তখন ওতোটা বুঝি নি। কিন্তু বাবা মরাতে বেশ বেদনার্ত হয়ে পড়েছিলাম। একে তো বয়স কম আর দু’য়ে অভিভাবকের অনুপস্থিতি। লেখা পড়ার করার ইচ্ছা থাকলেও সেটা আর হয়ে উঠে নি। ছোট চাচা ঘরে থাকলাম বছর তিনেক। সেখানেও সমস্যা, ছোট চাচী একেবারেই দেখতে পেতো না আমাদের দুই ভাইকে। চাচী তো একদিন বলেই দিলো,
পরের আপদ পালতে পারবো নাহ্। নিজের পেটে ভাত নেই তার উপর এসে জুটেছে যত্তসব। বিদায় করে দেও, নয় তো আমিই চলে যাচ্ছি।
কি আর করার হাজার হলেও চাচা তো আর আমাদের জন্য চাচীর অবাধ্য হতে পারে নাহ্। তাই পাঠিয়ে দিলো চাচার এক বন্ধুর বাড়িতে। তবে বিনে পয়সায় নয়, মাসের শেষে দুই ভাইয়ের খরচ চালাতো চাচীর অজান্তে। মাস ছয় এমন করে চললো। কিন্তু কিভাবে জানি না চাচা ধরা পরে গেলো। আর টাকা পাঠালো না সেই মাসে। তখন আমার বয়স সবে বারো কী চৌদ্দ হবে।
ভাইটার বয়স সাত। চাচা টাকা পাঠাতো না বলে বাসার সব কাজ কর্ম আমাকেই করতে হতো। ওদের কথা কাজের ছেলেটাকে তো টাকা দিতেই হতো সেই টাকায় না হয় তোমরাই থাকো। বয়স যদিও কম কিন্তু বেশ বুঝতে শিখেছি।
বাসার হালকা পাতলা কাজ করি ভারী কাজ কখনো করতে বলে নি। আর বলেও তো লাভ হতো না আমি কী আর পারতাম? ভাইটার হঠাৎ হঠাৎ করে হাড়কাপুনি দিয়ে জ্বর আসতো। জল পট্টি আর কবিরাজের দাওয়ায় তেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য ছিলো নাহ্। একদিন রাতে আবার জ্বর আসলো। ভাই টা আর জ্বর কাটিয়ে উঠলো নাহ্, রেখে আসলাম বাঁশবাগানে।
যখন বয়স একটু বাড়লো তখন সেই পরিবারেরও বোঝা হয়ে গেলাম। সারাদিন কাজ করেও যেন মন পেলাম নাহ্। বাধ্য হয়ে বাড়িটা ছাড়তে হলো।
জীবন যখন ছন্নছাড়া বাঁধনহারা তখনি জীবনে আসলো অধরা নামের একটা মেয়ে। প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময় দাড়িয়ে থাকতো পথ আগলে। মাঝে মাঝে কথা বলতাম আবার কখনো পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম। তখন আমার বয়স বিশ। টগবগে যুবক, রক্তে তখন তেজে ভরা। মন চাইতো যা করতামও তাই।ধরা ছোয়া ছিলো না কোন কিছুতেই। কিন্তু ধরা পরে গেলাম অধরার মায়ার জালে। ভেবেছিলাম পালিয়ে নিয়ে যাবো, অনেক দুরে যেখানে কেউ আমাদের পথ আগলে দাড়াবে না বাধা হয়ে দাড়াবে নাহ্ আমাদের ভালোবাসার মাঝে। কিন্তু নিয়তির খেলা বড়ই নির্মম সেটা জানা ছিলো নাহ্। অদৃশ্য থেকে কেউ আমাদের নিয়ে খেলছে তার নিখুদ মাথা।
মেয়েটার বয়সই বা কত হবে??? এই আটারো ঊনিশ আর এই বয়সেই গায়ে লেপে গেলো একটা কলঙ্ক। পাড়ার ছেলেরা নাকি তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম ধর্ষন আর পরে খুন করেছে। কথাটা পুলিশের কাছ থেকে শুনেছিলাম। পৃথিবীটা বড়ই নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো। চারিদিকে হাহাকার আর স্বপ্ন খুনের রক্ত।
নেশার প্রতি ঝুকে পড়লাম। দিন রাত মাতাল হয়ে পড়ে থাকতাম। যে বাড়িতে গিয়ে নেশা করতাম সেই বাড়ির একটা মেয়ে আলোর পথ দেখালো। জানি না সেটা ভালোবাসা ছিলো নাকি আমার জন্য মোহ। তবুও বেশ আপন করেই নিয়েছিলাম। বিয়েটা হয়ে গেলো এক বড়লোকের সাথে।আমার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হতো বটে কিন্তু শুধু ওর মুখ থেকে আশার বাণী ছাড়া আর কিছুই জুটতো নাহ্। কথায় কথায় একদিন বলেই ফেললো,
দেখো নীল আমি আমার স্বামীকে নিয়ে খুব ভালো আছি। যদিও বয়সটা একটু বেশি কিন্তু খুব ভালোবাসে আমাকে, অনেকটাই আগলে রাখে।আমি তাকে ছেড়ে আসতে পারবো নাহ্।
তখন বুঝলাম এতোদিনের মাহুয়ার দেওয়া আশা গুলো আজ নিরাশাতে পরিনত হওয়ার সময় এসেছে। সেইদিন ওকে আর আটকাই নি। আটকানোর প্রয়োজনই বা কী ছিলো? খুব ছোট বেলা বাবা একবার বলেছিলো,,,
শোন নীল কখনো কোন কিছুর জন্য অাফসোস করবি নাহ্, যা পাওয়ার সেটা তুই পাবিই যতই বাধা আসুক। কিন্তু সেটা শুধু সময়ের ব্যবধান।
বাবার কথাটা খুব বেশি মনে পড়তে লাগলো। বাবার কথা মনে যে পড়তো না সেটা নয় কিন্তু সেইদিন একটু বেশিই মনে পড়লো। একফোটা চোখের লবনাক্ত তরল পানীয় পড়েছিলো গাল বেয়ে। সেটা বাবার জন্য নাকি মাহুয়াকে হারাবার যন্তনায় তা বলতে পারি নাহ্। উত্তরটা খোজার চেষ্টাও করি নি। সে যার জন্যই পড়ুক পড়েছে তো নাকি?
দিনে দিনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একটা ব্যবসা দাড় করালাম। বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিলো। একটা ঘর তুললাম। তারপর মুনু চাচার ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে এসে উঠলাম। চাচা অবশ্য একটু আপত্তি করেছিলো কিন্তু পরে আর জোর করেনি।অসময়ে আমার পাশে দাড়ানোর লোকের অভাব ছিলো নাহ্ কিন্তু নিস্বার্থ ভাবে দাড়ানোর লোকের বড্ড অভাবই ছিলো। মুনু চাচাও তাদের দলের। প্রতিদিনের বাজার সদাই করে নিয়ে গেলে মুখে হাসি ফুটতো অন্যথায় নয়। ভালোবাসা যে পাই নি তা নয়, ভালোবাসা পেয়েছি কেউ আমার টাকাকে আবার কেউ আমাকে নিজের স্বার্থে আপন করে নিয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ আমার আত্মীয় হয়ে উঠছে কিন্তু সবই যেন ক্ষণিকের তাসের ঘরের মত।
মনে পড়ে একদিনের কথা,,
খুব জ্বর এসেছিলো একবার, ডাক্তার বলেছিলো টাইফয়েড। একাধারে পনোরো দিন বিছানায়। মুনু চাচা একদিন তো মুখের উপরই বলে দিলো,,,
বাবা ঘরে তো চাল ডাল নেই তোমাকে যে আজ কী খেতে দিই।
পাশের ঘর থেকে পোলাওয়ের গন্ধটা বেশ কড়া ভাবে নাকে এসে লাগছিলো। চাচার কথায় স্মিত হেসে বললাম,,,
সমস্যা নেই চাচা এক গ্লাস পানি দিতে পারবেন?? তাছাড়া শরীরটা আজ বেশ ভালোই মনে হচ্ছে কাজে যেতে পারবো।
চাচা পানি এনে দিলো সেই পানি খেয়েই গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে কাজে গেলাম। বোঝাতে পারবো না সে কী ব্যথা আর দূর্বল শরীরের অবস্থা।
দিনের শেষে চাল আর কিছু তরকারি আনলাম। রাতের খাবারে জুটলো সেই সকালের বাসি পোলাও। আমার প্লেটে দিতে দিতে চাচী বললো,,,
আমাদের বাড়ীতে চুলো জ্বলে নি দেখে,দুপুরে সিমাদের বাড়ি থেকে দিয়ে গেছে।
কোন কথা না বলেই খেয়ে নিলাম।
তারপর আর বিছানায় থাকা হয় নি অসুস্থ শরীর নিয়েই কাজে যেতে হয়েছে। এই বিষয়েও চাচী বলেছে,,,,
বেশি দিন ঘরে বসে থাকলে শরীর আরও খারাপ হয়ে যাবে। তাই এই দিক ঐদিক ঘুরে আসা ভালো।
কথাটার অর্থ বুঝতে এতোটুকুও কষ্ট হয় নি আমার।
উত্তরে কিছু বলি নি মাথা নিচু করেই ছিলাম।
গরমে আর মশার উপদ্রবে রাতে ভালো ঘুম হতো নাহ্। রাতের আকাশটা দেখতাম খুব করে। মাঝে মাঝে তারাদের উদ্দেশ্য নিজের লেখা কবিতা ছুড়ে দিয়ে বলতাম,,, ওগো আমার নাম না জানা বন্ধু,,, আসবে কী আমার ঘরে তোমার গায়ের আলোকিত করতে?? নাকি তুমিও আমার কাছে আসবে স্বার্থেরর টানে??
সময়ের বিপরীতে চলতে চলতে হঠাৎই একদিন সময়টাকে নিজের মনে হলো। একদিকে নিজের ব্যবসাকে দাড় করনো অন্য দিকে নীলুর আগমন। নাহ্ এবার আর কোন বিরহ নেই প্রেমে, আছে সুখ আছে শান্তি। এ যেন এক স্বপ্নের মত। নীলুকে পেয়ে মনে হলো এটা আরও আগে পেলে কী খুব ক্ষতি হতো??? আবার মনে পরে বাবার সেই কথা,
শোন নীল কখনো কোন কিছুর জন্য অাফসোস করবি নাহ্, যা পাওয়ার সেটা তুই পাবিই যতই বাধা আসুক। কিন্তু সেটা শুধু সময়ের ব্যবধান।