সেই শীতে

সেই শীতে

‘বাজান, একখান কতা কই’?
রিফাত আনমনে কুয়াশায় ঢাকা মোড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো তখনই রিক্সাওয়ালা চাচা কথাটি বললো । শুনে রিফাত নম্র ভাবে বললো,
‘বলেন চাচা কি বলবেন’?

‘বাজান, আইজকা তো সেই আকারের শীত পড়তাছে আর আমি শুদুমাত্র একখান পাতলা গেঞ্জি গায় দিয়া বাড়ি থেইকা সক্কালে বাইর হইছিলাম। ঠাণ্ডায় এহন আর কুলাইতে পারতেছি না বাজান। আবার ঘরে চাইল, ডাইল কিচ্চু নাই সেইগুলা না কিনলে আইজ রাইতে বাত পামু না। তার উপর তুমি তিন ঘণ্টা ধইরা রিক্সায় বইসা আছো আর আমি শহরে শুদু ঘুরতাছি। কই যাবা আর কই নামবা কিছুই তো কইতাছো না বাজান’!
রিক্সাওয়ালা চাচার কথায় মুচকি হাসলো রিফাত। তারপর বললো,
‘আপনি কি বাসায় ফিরবেন’?
‘হ বাপজান বাড়ি ফিরমু’।
‘আমাকেও আপনার বাসায় নিয়েই চলেন’।

রিফাতের কথায় অনেকটাই অবাক হলো রিক্সাওয়ালা। তাইতো তিনি রিক্সা চালাতে চালাতেই পিছনে তাকিয়ে একবার রিফাতকে দেখে নিলেন। তারপর বললেন,
‘আমার বাসায় যাইবা’?
‘আপনি যদি নিয়ে যেতে চান তো যাবো’।
‘বড়লোকের পোলা তোমরা আমাগো বাড়ি যাইয়া বইতে পারবা না’।
কথাটি বলেই শব্দ করে হেসে দিলো রিক্সাওয়ালা চাচা।
রিফাত বললো,
‘সমস্যা নেই আপনি আমাকে নিয়ে যান’।
‘আইচ্ছা ঠিক আছে’।

রিক্সাওয়ালা রিক্সা ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়া শুরু করলো। রিফাত শুধু একমনে সামনের কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কুয়াশা দেখতে অনেক ভালোই লাগছে। হাত বিশেক সামনে কুয়াশার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আবার সেখানে গেলেই আরও সামনের বিশ হাত পরে আবার দেখা যাচ্ছে না। মজাই লাগছে রিফাতের কাছে। যদিও এই বয়সে এসব মজা লাগার কথা না, তবুও।

আজ সকাল থেকেই নিম্নচাপ পড়েছে। সেই সাথে ঘন কুয়াশা তো আছেই। রিফাত সকাল এগারোটার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছিলো। তারপর থেকেই এই চাচার রিক্সায় করে পুরো শহর ঘুরছে। অবশ্য কোন কারণ নেই এমন করে পুরো শহর ঘোরার। আবার একটা কারণ আছেও বলা যায়। কারণ টা হলো আজ কয়েকটা দিন ধরেই ওর মনটা ভীষণ ভাবে খারাপ। কারণ মাস খানেক আগেই ওর বাবা মারা গেছেন। আর ওর মা মারা গেছেন প্রায় পনেরো বছর তো হলোই।

রিফাতের মা জাহানারা বেগম মারা যাওয়ার পর থেকেই ওর বাবা রিজভী আহমেদ ধুমপান করার মাত্রা বাড়িয়ে দেন। আবার কোনো এক কারণে তিনি সব সময় চিন্তিত ও থাকতেন। বসয় বাড়ার সাথে সাথেই তার ক্যানসার ধরা পড়ে। আর আল্লাহ যাকে তুলে নেন তার তো যেতেই হবে। সেই নিয়মেই রিফাতের বাবাও চলে যান। রিফাতের চাকরিবাকরি নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা নেই। বাবার একটা চার তলা ফ্ল্যাট বাড়ি আর শহরে তিনটা দোকান আছে। এসবের ভাড়া দিয়ে দিব্যি ওর জীবন কেটে যাবে। তবে ইদানিং একটু বেশিই একা লাগে রিফাতের। তাই আজ মনটা সতেজ করতে সকালে বেড়িয়েছিলো।
রিফাতের ঘোর কাটলো রিক্সা থামানোর হাল্কা ধাক্কায়। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ও এখন একটা নদীর পাড়ের বস্তীর ভেতর এসে পৌঁছেছে।
রিক্সাওয়ালা চাচা রিফাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘এমন জায়গা তুমার পছন্দ হইবো না বাবা’।
‘সমস্যা নেই চাচা, আপনি চলুন’।
‘আহো আমার লগে’।
রিফাত চাচাকে অনুসরণ করতে করতে একটা পলিথিনের চালা দেওয়া ছোট্ট ঝুপড়ির মতো ঘরে ঢুকলো। ওরা ঘরে ঢুকতেই চার কি পাঁচ বছর বয়সী একটা ছোট্ট মেয়ে এসে বললো,
‘আব্বা আমার শুয়েটার আনো নাই’?
মেয়েটার এমন কথা কানে যেতেই পাশ থেকে তার মা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
‘শুয়েটার কি গাছে থাহে! খাওনের পয়সা নাই আবার শুয়েটার’।
বউ আর মেয়ের এমন কথা শুনে রিক্সাওয়ালা মুচকি হেসে রিফাতকে বললো,
‘তুমি বাজান এসবে কিছু মনে নিও না’।
অন্য কেউ আসছে ঘরে বুঝতেই রিক্সাওয়ালা লোকটির বউ বললো,
‘তোমার লগে ওইডা কেডা’!
‘এই ডা? এইডা আমার পেছেন্জার। শখ কইরা কইলো আমার ঘরে নাকি আইবো তাই আনলাম’।
‘ও, বালা করছো। তা চাইল-ডাইল আনছো নি’?
‘এইরে একদম ভুইল্লা গেছি’।
‘তা তো ভুলবাই। ঘরে যে খাওন নাই তা কি নজরে আহে’?
একটু কড়া ভাবেই কথাটি বললো।
এসব শুনে রিফাত বললো,
‘চাচা, কিছু না মনে করলে আমি রান্না করার সবকিছু কিনে আনি’?
রিফাতের কথায় একটু লজ্জাবোধ করেই চাচা বললো,
‘না বাজান তা অয় না’।
‘হয় চাচা সব হয়। আর চাচি একটা কথা বলি’?
‘কি কইবা বাজান কও’?
‘আমি আজ রাতে আপনাদের সাথে খেতে চাই, কি খাওয়াবেন না’?
‘গরিবের ঘরে খাইবা যা দিবার পারি তাই খাইয়ো’।
‘সমস্যা নেই চাচি আমি বাজার করে আনছি এখনই ‘।

বলেই রিফাত চাচার হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে। তারপর রিক্সা করে আবার বাজারে আসে। বাজার থেকে পাঁচ কেজি চাউল, ডাউল, তেল, বিভিন্ন মসলা সহ কয়েক কেজি মাংস আর মাছ কেনে রিফাত।
রিফাতের এমন পাগলামি দেখে রিক্সাওয়ালা চাচা শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

ফেরার পথে রিফাত চাচার নাম, চাচির নাম আর বাচ্চাদের নামও জেনে নেয়। চাচার নাম হলো সাদেক। উনার বউয়ের নাম হিরা আর বাচ্চা দুইটার নাম মধ্যে বড়টার নাম শিলা আর ছোট টার নাম শেলি। বিভিন্ন কথা বলতে বলতেই আবার বস্তিতে ফেরে ওরা।
এত বাজার দেখেই তো চাচি রিফাতকে বললেন,
‘এত খাওন কেন আনলা বাজান’!
‘এসব কিছুই না চাচি’।

‘এত টাকা খরচ করার কোন দরকার আছিলো’!
‘আরে বাদ দিন তো। আপনি বরং ভালো করে রান্না করে আনুন আমার বড্ড খিদে পেয়েছে ‘।
চাচি কিছু বললেন না। তবে হারিকেনের মৃদু আলোতে রিফাত স্পষ্ট চাচির চোখে অশ্রু দেখতে পেলো।
তিনি সব কিছু নিয়ে বাইরে রান্না করতে গেলেন। রিফাতকে দেখে সাদেক চাচার সাত কি আট বছর আর চার কি পাঁচ বছর বয়সী দু’টো মেয়েই কৌতূহলী হয়ে পাশে এসে বসলো। প্রচণ্ড শীত পড়ছে। রিফাত অবাক হয়ে দেখলো এতো শীতেও ওরা শুধু একটা পাতলা কাপড়ের জামা পড়ে আছে। পড়নেও হাফপ্যান্ট। রিফাত বললো,
‘চাচা, ওদের তো শীতে অনেক কষ্ট হচ্ছে তবুও পোশাক কিনে দেন নি কেন’?
সাদেক বললো,

‘কেমনে কিন্না দিমু বাজান! যে টেহা কামাই করি তার বেশিরভাগই মহজনরে দিয়া দিতে হয়। তার উপরে দেনাও আছে। সব কিছু দিয়া আমার হাতে খাওনের মতো টেহাই তো থাহে না। সেইহানে চাইলেও আমি ওগো পোশাক কিন্না দিবার পারি না। ওগো তো আমি দুইবেলা ঠিক মত ভাতই দিবার পারি না সেইহানে পোশাকের কতা নাই কইলাম’।
রিফাত তাকিয়ে দেখলো চাচার চোখে জল স্পষ্ট।

পুরুষ মানুষ কাঁদে না। তবুও যখন সহ্যের বাইরে চলে যায় তখন তাদের চোখেও জল আসে।
রিফাত বললো,

‘চাচা, আমাকে একটু এখন রিক্সায় করে শহরের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন’?
‘কেন পারমু না বাজান চলো ‘।

রিফাত সাদেক চাচার সাথে আবার শহরের দিকে চলে এলো। তারপর চাচাকে রাস্তায় দাঁড়াতে বলে রিফাত মার্কেটের ভিতরে চলে গেলো। ঘণ্টা খানেক পর হাতে অনেকগুলো ব্যাগ নিয়ে বাইরে এলো ও। রিফাতকে দেখেই সাদেক চাচা বললো,

‘এইসব কি বাজান’?
‘কিছু না চাচা আপনি চলেন’।
‘এহন কই যামু’?
‘কোথায় আবার আপনার বাড়িতে’।
‘আইচ্ছা’।

রিক্সা চলছে। আর মিটমিট করেই হাসছে রিফাত। চাচা বুঝতে পারে নি কিছু।
চাচার কথা শুনে তখন বুকটা কেমন যেন হু হু করছিলো ওর। কত কষ্টের জীবন! এত শীতেও বস্ত্রহীন থাকা যায়!
রিফাত ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মাংসের ঘ্রাণ পেলো। সাথে সাথেই যেনো ওর খিদেও বেড়ে গেলো। রিফাত দেখলো চাচি থালাতে ভাত বাড়ছেন। রিফাত ওর দুইপাশে পিচ্চি দুই টা আর সাথে চাচাকে নিয়ে খেতে বসলো।

খাওয়া শুরু করতেই রিফাত দেখলো বাচ্চা দুইটা গপগপিয়ে খাচ্ছে। দেখতে খুব ভালোই লাগছে। চাচি শুধু তৃপ্তির দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাচ্চাদের খাওয়ার দিকে । রিফাতও অনেকদিন পর পেট পুরে খেলো। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে চাচিকে বললো,

‘চাচি একটু এদিকে আসেন তো’।
চাচি আসতেই বললো,

‘শিলা আর শেলি তোমরাও আমার কাছে আসো’।
পিচ্চি দু’টোও রিফাতের কাছে এলো। রিফাত দেখলো চাচা আর চাচি কৌতূহলী হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রিফাত ব্যাগ থেকে শেলি আর শিলার জন্য দু’টো সুন্দর সোয়েটার বের করে দু’জনের হাতে দিয়ে বললো,
‘কি পছন্দ হয়’?

‘এইডা আমাগো’! দুই বোন একসাথে বললো।
‘হ্যা আপু তোমাদেরই’। বলেই রিফাত দু’জনকে নিজের হাতে সোয়েটার পড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘চাচি দেখেন দেখেন দু’জনকেই সুন্দর লাগছে তাই না’?

রিফাত কোনো উত্তর পেলো না। ব্যাগ থেকে আবার দুই বোনের জন্য শীতের পায়জামা বের করে দিলো। তারপর ব্যাগ থেকে চাচা আর চাচির জন্য কেনা সোয়েটার বের করে দু’জনের হাতে দিয়ে বললো,

‘এখনই গায়ে দিন’।
রিফাত দেখলো চাচা-চাচি দু’জনেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো সোয়েটার গায়ে দিলো। রিফাত কম্বলের ব্যাগটাও চাচির হাতে দিয়ে বললো,

‘অনেক শীত পড়ে চাচি। আমি চাই আপনারা সবাই একটু কষ্ট করে হলেও এই কম্বলের ভিতরে রাত কাটাবেন। আর বোনদের কষ্ট হয় এই শীতে। ওদের ও পোশাক পড়িয়ে রাখবেন। চাচা এই হাড় কাঁপানো শীতে একটা জামা পড়েই রিক্সা চালায়। বাতাস লাগে অনেক। কষ্ট ও হয়। তাকেও পোশাক ছাড়া বের হতে দিবেন না। বুঝলেন তো’?
রিফাতের কথা শেষ হতে না হতেই সাদেক চাচা আচমকাই রিফাতকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিয়ে বললো,
‘বাজান, তুমি কি মানুষ! আমাগো লাইগা এই এত কিছু কেন করলা’!

রিফাত কিছুই বলতে পারলো না। ওর ও কান্না পাচ্ছে। তবে মন টা হালকা হালকা লাগছে ওর। বাবা মরার পর থেকে কেমন যেন বিষন্ন হয়ে থাকতো।

পিচ্চি দুই বোনকে আদর করে চাচির থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরতে চায় রিফাত। তবে চাচা সাদেক তাকে কিছুতেই একা যেতে দেবে না। তার কথা এই নতুন সোয়েটার পড়ে আগে তাকে বাসায় রেখে আসবে না হলে এই সোয়েটার পড়বেই না। রিফাত চাচার এই বাচ্চামি আবদার হাসি মুখেই মেনে নেয়।

রিক্সা চলছে কুয়াশার চাদর চিঁড়ে। রাস্তায় তেমন গাড়িও নেই। সোডিয়াম লাইনের ক্ষীণ আলোয় কুয়াশা অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। রিফাত মুগ্ধ হয়ে সেসব দেখছে আর ভাবছে,

এই শীতে সাদেক মিয়ার মত গরীবদের জন্য তাকে কিছু একটা করতেই হবে। বাবাও গরীবদেরকে ভালোবাসতেন। সাহায্য করতেন। আজ তিনি নেই। তবে আমি! বাবার কষ্ট ভুলতে তার মহান কাজটাই না হয় করবো। কাজের মাঝেই সবার ভালোবাসা আর বাবার স্মৃতি খুঁজবো। রিফাত ভাবছে তো ভাবছেই।
আর রিক্সা টা একটু একটু করে কুয়াশার মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত