নীলিমা জামাটা ডান হাত দিয়ে ধরে ড্রাইভারের কাছ থেকে বাজারের ব্যাগ নিল। ওড়না ছিল না তার পরনে। নীলিমা কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করছে নতুন ড্রাইভারের নজর ভালোনা। সুজোগ পেলেই বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবাকে বলে একে বিদেয় করতে হবে। ঘরে ঢুকে বাজারের ব্যাগ ফ্রিজের পাশে রেখে টিভি দেখায় মন দিল নীলিমা। ব্যাগে কি আছে তা দেখার কোন আগ্রহ নেই তার। টিভিতেও তেমন কিছু দেখছে না,শুধু তাকিয়ে আছে। ছেলেটা এমন কেন। একটু কথা বললে কি হয়– এসব ভাবছে সে। রান্নাঘর থেকে সীমা ছুটে এলো। ব্যাগের সবকিছু ঢেকে দেখলো কি কি আছে। ধনেপাতা আনা হয়নি।
সীমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলল, ধনেপাতা আনেনি দেখেছিস।
নীলিমা টিভির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, হু
কতবার করে বললাম ধনেপাতা আনতে। আনেনি। এই বাড়িতে আমার কথার কোন দাম নেই। কোনদিন ছিলও না। চলে যাবো আমি এ বাড়ি থেকে।
মা,এখন তো বাবা নেই। ঝগড়া করবে কার সাথে?
আমি ঝগড়া করি? তোকে এতো কষ্ট করে বড় করলাম এই ধরণের কথা শোনার জন্য? আমি সত্যিই চলে যাবো।
মা সরিষা দিয়ে সিমের তরকারি করতে পারবা?
হ্যা,না পারার কি আছে।
পারবা না,দেখো। পারলে করে দেখাও।
দুপুরে তুই ওইটা দিয়েই ভাত খাবি শুধু। আর কিছু পাবিনা।
সীমা হাতে করে কিছু তরকারি নিয়ে চলে গেলেন। ধনেপাতা আনতে বলা হয়নি তা তিনি নিজেও জানেন। তবুও কিছু একটার খুদ ধরতে না পেরে তার ভালো লাগছিল না।
নীলিমা টিভি বন্ধ করে দিয়ে তার ঘরে চলে গেলো। আজ শুক্রবার। শুক্রবারের দুপুর যেন অন্যসব দিনের থেকে বেশিক্ষণ থাকে। সেই কতক্ষণ হলো বসে বসে টিভি দেখছে সে,কিন্তু সময় কাটছেই না। এদিকে সুমিতের আসার কোন খবর নেই। ছেলেটার কি কোন বুদ্ধি নেই? এই রোদে কেউ বাইরে থাকে এতোক্ষণ! নীলিমার ঘরের জানালা দিয়ে সুমিতদের বাসার সিঁড়িটা দেখা যায়। কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠলে পায়ের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায় তার ঘর থেকে।
টেবিল গোছাতে গোছাতে নীলিমা কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। প্রায় ছুটে গেল জানালার কাছে। সুমিত মাথা নিচু করে ধিরে ধিরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। তার বড়বড় চুল গুলো কানের পাশ দিয়ে গিয়ে ঘাড়ে এসে নেমেছে। সামনের দিকেও এক ঝাক চুল। নীলিমার মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা করে– এই কাকের বাসা নিয়ে ঘুরেন কেন। কেটে ফেলতে পারেন না? কিন্তু সে এখনো কথা বলার সাহস করে উঠতে পারেনি। ছেলেটাকে সে প্রায় তিন মাস থেকে লক্ষ্য করে আসছে। কারো সাথে তেমন কথা বলেনা। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ও নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটে। নীলিমা একদিন দেখলো সুমিত সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল তখন তার বাবার সাথে দেখা। তার বাবা তাকে কিছু কড়া কথা বলে গেল কিন্তু এতে সুমিতের কোন প্রতিক্রিয়া দেখলো না। সবগুলো কথার পরে সে মাথা নিচু করে জি আচ্ছা বলে কাটিয়ে দিয়েছে। এমন নির্বোধ ছেলে কি করে কাওকে পছন্দ করবে? যার দিন শুরু হয় নিজের পায়ের বুড়ো আঙুল দেখে আর শেষও হয় সেভাবে সে কতোটা নির্বোধ হতে পারে তা নীলিমা ভেবে পায় না। তবুও কোন একটা কারণে নীলিমা ছেলেটাকে বেশ পছন্দ করে।
গেট থেকে বের হতেই নীলিমার সাথে সুমিতের দেখা হয়ে গেল। আজকেও একই ভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। সামনের দিকের চুল গুলো চোখের দিকে এসে জমা হয়েছে। সুমিত পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। নীলিমা অপ্রস্তুত ভাবে বলল, আপনার নাম সুমিত না?
সুমিত গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, জি,সুমিত।
আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।
কি বলুন।
আপনি বোধহয় কবিতা পড়েন অনেক। প্রায় রাতেই আপনার আবৃতি শুনতে পাই। শুনতে শুনতে আমারো কবিতার প্রতি নেশা ধরে গেছে। আপনার কাছে কি কবিতার বই আছে?
হ্যা আছে,কিন্তু…
নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন কেন? আমার দিকে তাকান। আমার কিছু কবিতার বই লাগবে। দিতে পারবেন?
আচ্ছা দিবো।
এখন দিতে পারবেন?
সুমিত ব্যাগ খুলে দুটো বই বের করে নীলমার হাতে দিয়ে কোন কথা না বলে বের হয়ে গেল। তার দিন কাটে বইয়ের ভেতর মুখ গুজে। মাথা নিচু করে সে কবিতার লাইন মনে করতে করতে রাস্তা হাঁটে। এগুলোই তার ব্যস্ততা!
রাতে নীলিমা বইয়ের ভেতর একটা কাগজ রেখে দিল। সে জানেনা এটা পাগলামি নাকি অন্য কিছু,কিন্তু তার ভালোলাগার কথা না বলেও সে ঠিক থাকতে পারছিল না। কয়েকবার কাগজ’টা বইয়ের ভেতর থেকে বের করে ফেলে দেবে ভেবেছে। কিন্তু কিছু করতে পারলোনা। রাতটা তার অস্থিরতায় কাটলো। কি হবে তা ভেবে রাত পার করছে নীলিমা। এইভাবে তার পছন্দের কথা বলা ঠিক হলো নাকি তাও সে ভেবে পাচ্ছেনা। কবিতার বই পড়বে বলে এনেও একটা কবিতাও পড়া হয়নি নীলিমার। বিকেলের দিকে সুমিতের সাথে দেখা হলে বই দুটো দিয়ে দিবে ভেবেছে সে। তার আসল কাজ হয়েছে এটাই যথেষ্ট!
বিকেলের দিকে সুমিতের সাথে নীলিমার দেখা হয়নি। পরের দিন সকালেও তার কোন খোজ পাওয়া গেল না। এদিকে তার বাসায় গিয়ে বই দিয়ে আসার মত সাহস নীলিমার নেই। তার মত ভিতু মেয়ে কাগজে করে কাওকে পছন্দের কথা জানাচ্ছে এটা ভেবে নিজেই অবাক হচ্ছে নীলিমা। সুমিতের সাথে বেশ কিছুদিন দেখা হয়নি। ছয় সাত দিন পর দুপুরের দিকে সুমিতের সাথে ছাদে দেখা হলো। কাপড় শুকাতে এসে কাকের বাসার মালিকের সাথে দেখা হবে তা নীলিমা ভাবতে পারেনি। সুমিত কে দাঁড়াতে বলে নীলিমার প্রায় দৌড়ে গিয়ে বই দুটো নিয়ে এলো। এক ফাঁকে দেখে নিল কাগজ টা দ্বিতীয় পাতায় আছে নাকি।
কোন কথা না বলে চুপচাপ বই দুটো হাতে দিয়ে নীলিমা চলে এলো। ভয়ে তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছিল।
নীলিমা উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। সে এমন ভাবেই লিখেছে যার উত্তর সুমিতকে দিতেই হবে। উত্তর না দিলে সুমিত নিজেও শান্তি পাবেনা।
প্রায় নয়দিন হয়ে গেল সুমিত কোন উত্তর দেয়নি। এর মধ্যে সুমিতের সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু কোন কথা হয়নি দুজনের মাঝে। দশম দিনে সুমিত নিজেই এলো নীলমাদের বাসায়। নীলিমা অবাক হয়ে সুমিতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে মনে মনে ভাবছে নাটক সিনেমার নায়কদের মত সুমিত হয়তো এসে তাকে ফুল দিবে বা জড়িয়ে ধরবে। সুমিত নীলিমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে হাতে থাকা বই দেখিয়ে তা টেবিলের উপর রেখে চলে গেল। নীলিমা প্রায় পাথরের মত হয়ে গেছে। নিশ্বাস ঠিক মত পরছেনা তার। দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো তার। সুমিত চলে যাবার পরও সে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো। টেবিলে রাখা কবিতার বইয়ের দিকে তাকিয়ে ধিরে ধিরে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। বই হাতে নিয়ে ভাবলো সুমিতও বোধহয় তাকে পছন্দ করে। তাই ওর মতই হয়তো বইয়ের ভেতরে নিজের মনের কথা লিখে গেছে। নীলিমা বই খুলে দ্বিতীয় পাতার ছোট্ট একটা কাগজ পেল। সুন্দর হাতের লেখা-
“নীলিমা তুমি আমাকে পছন্দ করো আমি জানি। তুমি করে বলছি রাগ করতে পারো। কিন্তু পছন্দ করাটা পছন্দেই আটকে রাখলে ভালো হয়।
আমার আঙুল কারো সিঁথিতে সিঁদুর পড়িয়ে দেওয়ার জন্য হয়েছে,কিন্তু তুমি ‘কবুল’ শোনার জন্য হয়েছ। তোমার নাম টা অনেক বড় মনে হয় আমার কাছে। আমি একটা ছোট নাম দিলাম তোমাকে– নীলু”
নীলিমার চোখে জল চলে আসলো। তার মা ডাকছে। নীলিমা চোখের জল মুছে বলল, মা নীলিমা বলে ডাকবা না। নীলু বলবা।
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো নীলিমা। অনেক কষ্টে কান্নার শব্দ আড়াল করলো।