প্রায়শ্চিত্ত

প্রায়শ্চিত্ত

মা শুনছো! দু’বছর ধরে পরা কালো প্যান্টটা ছিড়ে গিয়েছে গতকাল৷”
-তাতে কি হয়েছে রে বাপ? তোর তো আরো দু’একটা প্যান্ট আছে৷ ওগুলো না হয় পরে যাবি স্কুলে৷
-মা তুমি বুঝো না কেন? ঐসব জিন্সের প্যান্ট কি স্কুলে এ্যালাউ করবে? করবে না তো৷
-তাইলে কী তুই স্কুলে যাবি না বাপ?

-যেতে তো হবেই মা৷ আমি তো ক্লাসের ফাস্ট বয়৷ কিন্তু জানো মা? আমাদের প্রথম ঘন্টার স্যারটা বড্ড রাগী৷ প্যান্ট পরে না গেলেই পিটিয়ে পিট লাল করে ফেলবে৷ সে ক্লাসের ফাষ্ট হই আর লাষ্ট হই৷ মাইরের ব্যাপারে ছাড় দেন না৷”

-সামনের ঘরটাতে খাটে শুয়ে মা-ছেলের কথা শুনছেন রহমান সাহেব৷
রহমান সাহেব একসময়ের স্কুল কাঁপানো মাষ্টার ছিলেন৷ বিগত কয়েক বছর ধরে তিনি অসুস্থ৷ প্যারালাইজের রোগী৷ কাজ করতে অক্ষম৷ সারাক্ষন শুয়ে অথবা কারো সাহায্যে বসে দিন কাটে৷
রহমান সাহেব আর জাহানারা বেগমের ঘরে একটা মাত্র সন্তান৷ ছেলেটা এবার ১০ম শ্রেণীতে উঠলো৷
লেখাপড়ায় বড্ড ভালো৷ বাবার নাম রেখেছে৷ চেহারাটাও বড্ড অমায়িক৷ সব মিলিয়ে বাধ্য ছেলে৷
ঘরে অভাব থাকা সত্তেও মন খারাপ করে চলে না কখনো৷ আল্লাহর উপর ভরসা করে সবসময়৷
রহমান সাহেবের স্ত্রী জাহানারা বেগম৷ খুউব পরিশ্রমী আর ধৈর্য্যশীল একজন মহিলা৷ এত কষ্ট আর অভাবের পরও কখনো কষ্ট দিয়ে কথা বলেনি রহমান সাহেবকে৷
জাহানারা বেগম অল্পস্বল্প লেখাপড়া জানেন৷ ছোট বাচ্চাদের পড়াতে পারেন৷
মানুষের বাড়িতে ছোট বাচ্চাদের পড়ানোর সাথে সাথে রান্নার কাজগুলোও করে থাকেন৷
যা আয় হয় এতেই সংসার চলে দুঃখে কষ্টে৷

মায়ের কাছে কথার জবাব না পেয়ে মুখ মলিন করে ঘর থেকে বেড়িয়ে পরে রহমান সাহেবের ছেলে৷
ছেলেটার জন্যও কষ্ট হয় রহমান সাহেবের৷ তেমন কিছুই চায় না মায়ের কাছে৷

জাহানারা বেগম মন খারাপ করে রহমান সাহেবের শিয়রে এসে বসেন৷ রহমান সাহেব টুপ করে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলেন৷ নয়তো চোখের জলগুলো লুকোতে পারবেন না যে৷ ধরা পরে যেতে হবে৷ তার চোখের জলে হয়তো জাহানারা বেগমও ভেঙে পরবেন৷
কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে উঠে পরে জাহানারা বেগম৷

মাথার উপরে সাই সাই করে ঘোরা সিলিংটার দিকে তাকিয়ে অতীতে ফিরে যান রহমান সাহেব৷

রহমান সাহেব তখন সদ্য স্কুলে চাকরি নিয়েছেন৷ ফুরফুরে মেজাজের রাগী একজন মানুষ৷ তরুণ বয়সের তেজ ছিল গায়ে৷
ছাত্রদের দোষ পেলেই পিটিয়ে ছাতু বানাতেন৷
ছাত্রদের স্কুল ড্রেসের প্রতি ছিলেন ভীষন সিরিয়াস৷
প্রথম কয়েকমাসের মধ্যেই স্কুলের ভয়ংকর শিক্ষকদের মাঝে একজন হয়ে উঠলেন রহমান সাহেব৷

নতুন বছরে রহমান সাহেবকে ৯ম শ্রেণীর শ্রেণী শিক্ষক বানানো হলো৷
ছাত্ররা ভয়ে জবুতবু হয়ে থাকতেন রহমান সাহেব ক্লাসে গেলেই৷ কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় সব ছেলেকেই পিটিয়েছেন রহমান সাহেব৷

কাউকে পড়ার জন্য পিটিয়েছন৷ আবার কাউকে পিটিয়েছেন ড্রেস এর জন্য৷
কিন্তু ক্লাসের ফাষ্ট বয়কে পিটানোর সুযোগ পাননি রহমান সাহেব৷
ছেলেটা সবকিছুতেই দুর্দান্ত ছিল৷ পড়ালেখায় ভালো, আচার-আচরণ সবকিছুতেই দারুন৷
তারপরও রহমান সাহেবের কেন যেন সহ্য হতো না ছেলেটাকে৷
পুরনো সাদা শার্ট আর রং জ্বলসানো কালো প্যান্ট পরে স্কুলে আসতো ছেলেটা৷ চুলগুলো ছোট করে কাটা৷
রহমান সাহেব একদিন জিজ্ঞেস করেছিল,
-তুই এভাবে চুল কাটিস কেন?
ছেলেটা হাসিমুখে জবাব দেয়,
-স্যার এভাবে কাটলে বাকি কয়েকমাস চুলে হাত দিতে হবে না আর৷ দিব্যি চলে যাবে৷
রহমান সাহেব জবাবে কিছু বলেন না৷ আস্তে করে বসতে বলেন৷
অবাক হন, এত অভাবের মাঝেও ছেলেটা কি অমায়িকভাবে হেসে সাধারন ভাবে কথাটা বলে ফেলল৷

একদিন সকালে রহমান সাহেব খেয়াল করলেন ছেলেটা প্রথম বেন্ঞ্চে নেই৷ একটু এদিক ওদিক তাকালেন৷
মাঝখানের একটা বেন্ঞ্চে চোখ গেল রহমান সাহেবের৷
নিয়মিত প্রথম বেন্ঞ্চে বসা ছেলেটাকে মাঝখানে দেখে রহমান সাহেবের একটু খটকা লাগলো৷
কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলেন ছেলেটা আজ অন্য রঙের প্যান্ট পরে এসেছে৷
রহমান সাহেব উৎফুল্ল বোধ করেন একটু৷
তারপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
-ভিন্ন রঙের প্যান্ট পরা সবাই বেরিয়ে আসো৷
কিছুক্ষণ পর গুটিগুটি পায়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে ছেলেটা৷
চেহারাটা মলিন হয়ে আছে৷ মুখে ভয়ের চাপ৷
ততদিনে অন্য সবাই কালো রঙের প্যান্ট কিনে নিয়েছে৷ আজ শুধু ছেলেটাই ব্যাতিক্রম৷
রহমান সাহেব ছেলেটাকে সামনে এনে দাঁড় করালেন৷ মোটা বেত দেখেই ছেলেটা একটু চমকে উঠলো৷
রহমান সাহেব চেয়ার থেকে উঠতেই ছেলেটা বলল,

-স্যার! কালকে প্যান্টটা ছিড়ে গিয়েছে৷ আব্বাকে বলেছি৷ মাসের মাঝখানে তাই কিনে দিতে পারেনি৷ মাসের শেষে কিনে দিবে বলেছে৷

ছেলেটার কথা শুনেও শুনলেন না রহমান সাহেব৷
দু’পাটি দাঁত বের করে হেসে বললেন,
-সবার জন্য সমান শাস্তি৷ রুলস ইজ রুলস৷ তুই ফাষ্ট বয় হয়ে রুল ভঙ্গ করবি বল?’
রহমান সাহেবের কথার জবাবে টু শব্দ করেনি ছেলেটা৷
চুপচাপ হজম করেছিল ছেলেটা৷
এরপরের কয়েকদিনেও ছেলেটা মার হজম করেছে৷ শুধু টুপটুপ করে চোখের জল ফেলেছিলো৷
আরেকদিন সকালে জীর্ণসীর্ণ চেহারা নিয়ে আবারও বেতের সামনে দাঁড়ায় ছেলেটা৷ মুখের হাসিটা উবে গিয়েছে ততদিনে৷

হাস্যোজ্জল মুখটা বড্ড মলিন৷
রহমান সাহেব হাতের বেতটা আর চালানোর শক্তি পেলেন না৷ হাত দু’টো কাঁপছিলো৷ বেতটা হাত থেকে পরে গেল৷
ছেলেটা বেতটা মাটি থেকে তুলে রহমান সাহেবের হাতে দিয়ে মুখে মলিন হাসি ঝুলিয়ে বলল,

-স্যার মারবেন না আমাকে? রুলস ভঙ্গ করছেন কেন স্যার? আপনি শিক্ষক হয়ে রুলস ভঙ্গ করবেন না!
ভারি কন্ঠে বলল ছেলেটা৷
তারপর আস্তে করে প্যান্টটা পায়ের দিক থেকে তুলে দিলো ছেলেটা৷
সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারে না রহমান সাহেব৷
বেতের বারিতে তেতলে গিয়েছিল ছেলেটার পা দু’টো!
রহমান সাহেব হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷
চুপচাপ হেঁটে যখন রহমান সাহেব বেরিয়ে যাচ্ছিলেন৷
ছেলেটা পেছন থেকে ডাক দেয় রহমান সাহেবকে৷
রহমান সাহেব পেছন ফিরে তাকান৷
ছেলেটা স্মিত হেসে বলেছিল “জানেনতো স্যার! মনুষত্ব্যের কাছে নিয়ম তুচ্ছ”

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত