“একটা ম্যাজিক করে দাও তো দেখি।”
লোকটা কেলে হাঁড়ির মধ্যে একটা বাখারির টুকরো দিয়ে ভাত নাড়ছিল। মিনির গলার আওয়াজে মুখ তুলে চেয়ে সাদা দাঁতে হাসে, বলে, “কি ম্যাজিক দিদি?” টিয়া মিনির আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসে। এ গাঁয়ে নতুন সে, আজ প্রথম ম্যাজিকওয়ালার নাম শুনেছে। তার কাজেই আজ আসা এখানে। মিনি জোর করে এনেছে – ম্যাজিকওয়ালা নাকি তার বন্ধু।
পাশে উবু হয়ে বসা মিনি তখন বলে চলেছে, “আমার এই বন্ধুটা গো। অংককে কি ভয় পায়। গত বার টেনেটুনে পাশ করে গেছিল। এবার তো এক্কেবারে ফেল!”
লোকটি গোলগোল চোখ করে টিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রতিধ্বনি তোলে – “এক্কেবারে ফেল?” লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে টিয়ার। কিন্তু লোকটা বলে, “আমি ইতিহাসে ফেল করতাম। বাবরের বাবার নাম বিদ্যাসাগর লিখে একবার এইসা মার খেয়েছিলুম!” মিনি মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলে, “এ:, খুব বোকা ছিলে তো তুমি! বিদ্যাসাগর কারোর বাবা হতে যাবেন কেন? আর বাবরের বাবার নাম তো, বাবরের বাবার নাম – যাকগে, সে ছাড়ান দাও। একটা অংকে পাশ করার ম্যাজিক করে দাও তো।
ভাত টিপে দেখতে দেখতে মাথা নাড়ে লোকটা। বলে, “ও ম্যাজিক খুব কঠিন দিদি। সব চেয়ে কঠিন।”
বন্ধুর সামনে অপদস্থ হওয়ার আশংকায় রেগে যায় মিনি। বলে, “সব চেয়ে কঠিন কি করে হয়? তুমি তো সেদিন বললে, মরা জিনিস বাঁচিয়ে তোলার ম্যাজিকটা সব চেয়ে কঠিন। সেই যে যেদিন পায়রাটা নিয়ে এলাম তোমার কাছে?”
ভাতের হাঁড়ি ধরে নামাতে নামাতে লোকটা ফিরে চায়। কেমন দু:খ দু:খ মুখে হেসে বলে, “মরা মানুষ বাঁচানোর ম্যাজিক জানলে কি আমি এখানে এরকম চালচুলোহীন পড়ে থাকতাম দিদি? আমার আমিনা, ছোট্ট ইমরানকে ফিরিয়ে আনতাম না, ঘর করতাম না সুখে?”
মিনি আর টিয়া ভেবলে যায়। মরে যাওয়ার ব্যাপারটা ধোঁয়াশা তাদের কাছে – কেন মরে যায়, কোথায় চলে যায় মানুষ, তারা জানে না। জানে না আমিনা কে, ইমরান কে, জানে না ম্যাজিকওয়ালার ঘর কোথায়। পুকুরের পাশের এই দরমার কুঁড়েতে নাওয়াখাওয়া আর ঘুমের সময়টুকু ছাড়া তাকে পাওয়া যায় না। মিনি জ্ঞান হয়ে ইস্তক এরকমই দেখেছে। বড়দের মধ্যে কেউ কেউ রহিমমাস্টার ডাকতেন ম্যাজিকওয়ালাকে, কিন্তু সে নাম হারিয়ে গেছে কবে কোথায়। তারা ছোটরা ডাকে ম্যাজিকওয়ালা। জাদু টুপি, রঙিন রুমাল, জীর্ণ তাসের পাতার ম্যাজিকওয়ালা।
লোকটার চোখ এড়ায় না মেয়ে দুটোর ভেবলে যাওয়া। ভাতের মাড় গালতে গালতে সে বলে, “আমি একটা ম্যাজিক করতে পারি দিদি।
চুপসে যাওয়া মিনি একটু উৎসাহ ফিরে পায়। বলে, “বলো কি ম্যাজিক?”
ভাতের হাঁড়ি পাশে নামিয়ে রেখে গামছায় হাত মুছতে মুছতে লোকটা বলে, “আমি অংক শিখিয়ে পারি দিদি তোমায়। শিখবে?”
২
টিয়া অংক শিখেছিল ম্যাজিকওয়ালার কাছে। গঞ্জের অফিস থেকে ফিরে বাবা সন্ধেবেলায় তার পড়া নিয়ে বসতেন। তিনি পর্যন্ত অবাক হয়ে যেতেন টিয়ার উন্নতি দেখে। কিন্তু গোল বাঁধত ক্লাসে। অংকের দিদিমণির মেজাজ আর বকাকে যমের মত ভয় করত টিয়া, আর ভয়েই ভুল করত। ভুল করলে বকা খেত, সেই ভয়ে আরো ভুল। একটা ভুলভুলাইয়ায় আটকে পড়ত সে বারবার। চোখ মুছতে মুছতে একদিন তাই বলে ফেলেছিল ম্যাজিকওয়ালাকে – “আমি স্কুলে গেলেই সব অংক ভুল করে ফেলি ম্যাজিকওয়ালা। তোমার কাছে, বাড়িতে সব অংক পারি, কিন্তু সীমা দিদিমণিকে দেখলেই আমার সব ভুল হয়ে যায়। খুব ভয় করে গো।”
ঝলমলে হেসে ম্যাজিকওয়ালা এক আঙুল তুলে বলেছিল, “আরে এইটা তো সহজ! ভয় কাটানোর ম্যাজিকটা সব চেয়ে সহজ। দাঁড়াও।”
টিয়ার হাতে একটা ছোট্ট কাগজের পুরিয়া দিয়েছিল ম্যাজিকওয়ালা। বলেছিল, “এ পুরিয়া কক্ষনো খুলবে না দিদি। তোমার বাড়িতে এ জিনিস থাকলে যেখানে যতই ভয় পাও, তোমার অংক – অংক কেন, ইতিহাসও – কক্ষনো ভুল হবে না।” ইতিহাসের নাম শুনে মিনিও নিয়েছিল একটা। বাবর আকবর কে কার বাবা সব তার গুলিয়ে যেত কিনা। সত্যি আর অত ভুল হত না তারপর থেকে। এক সময়ে অংককে ভালবাসতেও শিখে গিয়েছিল টিয়া। সেই পুরিয়ার ভরসায় অংকে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল কলেজে।
আজ বুজাইয়ের পরীক্ষার সকালে সেই পুরিয়া ছেলেকে ছুঁইয়ে দেয় টিয়া। বলে, “কিচ্ছু ভুল হবে না দেখিস। যতই ভয় পাস।” বুজাই ঢোঁক গিলে বলে, “হবে না মা?” টিয়া দৃঢ় মাথা নাড়ায়, “না হবে না। আমার হয়নি কখনো। এটা ম্যাজিক।”
লাফাতে লাফাতে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে যায় বুজাই। টিয়ার হাতের মুঠোয় ধরা থাকে ম্যাজিকওয়ালার পুরিয়া। খুললে দেখা যাবে, তার মধ্যে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একটা নাম – “টিয়া।” তার নিচে নতুন সংযোজন, টিয়ার হস্তাক্ষরে – “বুজাই।” নিজের ওপর বিশ্বাসটাই আসলে সব চেয়ে বড় ম্যাজিক।