ত্যাগ

ত্যাগ

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সবাই যে যার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ সেরে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিতে শুরু করেছে। গ্রামে যে সকল অট্টালিকাগুলো আছে সেগুলো বাদে সব বাড়িতে একে একে লণ্ঠন জ্বলে উঠতে লাগলো। করিম মিয়া চেয়ারম্যান সাহেবের সবজি বাগানের কাজ আজকের মতন শেষ করে কাঁচা রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলেন। রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য সুপারি গাছ। করিম মিয়ার কেন জানি সন্ধ্যা বেলা এই সকল গাছের নিচে যেতে ভয় করে, তাই তিনি মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়া শুরু করলেন।

করিম মিয়া পেশায় একজন কৃষক। যদিওবা নিজের জমিজমা নেই। তাই গ্রামের বড়লোক সাহেবদের ক্ষেতে কাজ করে, যা আয় রোজগার করেন তা দিয়ে তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের পেট চলে। তিনি, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে এই পাঁচজনকে নিয়েই তার অভাবে জর্জরিত সুখের নীড়। এছাড়া তার স্ত্রী মুরগি ও হাঁস পুষে থাকেন যেগুলোর ডিম বিক্রি করে তাদের সংসারের চাহিদা কিছুটা মেটানো যায়। আর এভাবেই চলছে তাদের অতি সাধারণ গ্রাম্য জীবনযাপন।

করিম মিয়া নিজের বাড়ির উঠোনে পা দিতেই বাড়ির ভিতর থেকে তার স্ত্রীর কথার স্বরের সাথে একটি পুরুষের কন্ঠও শুনতে পেলেন। তাদের কথার ধরণ শুনেই আন্দাজ করতে পারলেন তিনি তারা কোন বিষয় নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয়েছে। করিম মিয়া ঘাবড়ে গিয়ে প্রায় দৌড়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলেন। বাড়ির ভিতর ঢুকে তার মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, মতিউর রহমান সাহেব।

মতিউর রহমান এই গ্রামের সবথেকে বিত্তশালী লোক। গ্রামের স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ নির্মাণ থেকে শুরু করে গ্রামের একমাত্র বাজার ও গ্রামের আওতাভুক্ত সকল ব্যবসাবাণিজ্য তার অধীনেই পরিচালিত হয়। গ্রামের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বাকি সবাই তাকে বেশ সম্মান দেখিয়ে চলে। মতিউর রহমান বছরের অর্ধেক এই গ্রামে কাটান আর বাকি অর্ধেক ঢাকা শহরে। সেখানে তার স্ত্রী, তাদের একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন।

মতিউর রহমানকে নিজের বাড়িতে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন করিম মিয়া। আম্বিয়া বেগম স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন,
– ওই যে আইয়া পরছে, আলেয়ার বাপ। সাহেব, আপনি উনার লগে কথা কন। আমি জাইগা।বলেই আম্বিয়া পাশের ঘরে চলে গেলেন। পাশের ঘর থেকে করিম মিয়ার সন্তান আলেয়া, আয়েশা ও আজাদের জোরে জোরে পড়াশোনা করার শব্দ স্পষ্ট ভেসে আসছে।
– দেখো, করিম মিয়া। আমি একটা বিশেষ দরকারে তোমার বাড়ি এসেছিলাম। মতিউর সাহেব নিজেই কথা শুরু করলেন।
মতিউর সাহেবকে কথা বলতে দেখে হকচকিয়ে উঠলেন করিম মিয়া। এতক্ষণে তার হুঁশ ফিরলো। তিনি তড়িঘড়ি করে ঘরের এককোণে রাখা বেতের মোড়াটা মতিউর সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলেন।
– সাহেব, আগে বইলা লন।
-না, আমার কোমড়ে সমস্যা আছে। মোড়াতে বসলে আবার উঠার সময় কষ্ট হবে। তুমি আমার বসার ব্যাপারে চিন্তা বাদ দিয়ে আসল কথা মন দিয়ে শুনো। তোমার বউকে অনেকক্ষণ বুঝিয়েও লাভ হয়নি। মেয়ে জাতিই এমন।বুঝে কম, বলে বেশি। মতিউর সাহেবের কন্ঠ একদম স্বাভাবিক।
– ওর কথা বাদ দেন, সাহেব। আপনি আমারে কন। কি করবার পারি আমি আপনার লাইগা? করিম মিয়া নিজেও জানে না, মতিউর সাহেব আসলে কি চান।
– তোমার গরুটার দাম বাজারে কত হবে? মতিউর সাহেব সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন।
– আমার গরু? সাহেব, আমার কোন গরু নাই। ওইটা আমার পোলা আজাদের গরু। করিম মিয়া এবার অল্প চিন্তিত হয়ে পরলো।
– ওই যাই হোক। আমার ওই গরুটা লাগবে। কত টাকায় বেচতে চাও? মতিউর সাহেবের দৃষ্টি তীব্রভাবে করিম মিয়াকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
– সাহেব, এই কাজ আমি করবার পারিনা। ওই গরু আমার পোলার জান। ওর সবথেইকা প্রিয় জিনিস। আমি আপনারে আরো ভালে গরু খুঁইজা দিমু নে। করিম মিয়ার কন্ঠে আকুতি।
– তোমার কি মনে হয় আমার গরুর অভাব পরেছে, করিম মিয়া? গত কুরবানি ঈদে ছয় লাখ টাকায় তিনটা গরু কুরবানি দিয়েছে। এবারো তাই ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু আমার ছেলে কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে ফিরেছে। আর আজ সকালে গ্রাম ঘুরে দেখার সময় তোমার বাড়ির সামনের ওই মাঠে তোমার ছেলেকে ওই গরুর সাথে খেলতে দেখেছে। আর তারপর বাড়ি ফিরে, ওর একটাই কথা, ওই গরু ওর চাই ই চাই। ওই গরু ছাড়া সে কুরবানি দিবে না, জেদ চেপে বসে আছে ও। আর আমার একমাত্র ছেলে বলে,ওর সব আবদার আমি পূরণ করি। তাই এটাও করবো বলে ছেলেকে কথা দিয়ে ফেলেছি। মতিউর সাহেব থামলেন।
– সাহেব, মাফ কইরা দেন। এই কাম আমি করবার পারুম না। আমার পোলা শোকে মইরা যাইবো। করিম মিয়ার চোখে জল।
– শুনো করিম মিয়া, আমি আর কোন কথা শুনবোও না, নিজেও বলবো না। আমি দশ হাজার টাকা এখন দিয়ে যাচ্ছি। কাল সকালে তোমার ছেলে বুঝিয়ে-শুনিয়ে, আমার বাড়িতে গরুটা দিয়ে যেও আর বাকি টাকা নিয়ে এসো। আমি এখন চললাম।

মতিউর সাহেব আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না। একটা টাকার বান্ডিল পকেট থেকে বের করে মোড়ার উপর ছুঁড়ে মেরে হনহন করে হেঁটে করিম মিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। করিম মিয়া আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি ধীরেধীরে মাটির দিয়ে বানানো মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে লাগলেন। তার বুকের সকল ব্যাথা আর্তনাদ হয়ে গলা দিয়ে সজোরে বের হয়ে আসতে চাইছে। পাশের ঘর থেকে এখনো তার ছেলেমেয়েদের পড়ার শব্দ বাতাসে ভেসে ভেসে পুরো উঠোনে মিলিয়ে যাচ্ছে।

করিম মিয়া মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো।

মতিউর রহমান এবার তার ছেলেকে বললেন,
– বাবা দেখো, তোমার জন্য তোমার পছন্দের গরুটা নিয়ে এসেছি। এবার খুশি তো তুমি?
– বাবা, বাবা! আমার গরু? সত্যি? আমি ওকে ছুঁতে পারবো? মতিউর সাহেবের ছেলে উল্লাসে লাফিয়ে উঠলো।
– হ্যাঁ, তুমি ওকে ছুঁতেও পারবে আর কুরবানিও দিতে পারবে। তবে আগে ওকে একবার গোসল করিয়ে আনতে বলি।
– বাবা, জলদি বলো। কি মজা! কি মজা! আমার গরুর মাংস খাবো! বলতে বলতে মতিউর সাহেবের ছেলে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলো।
– সাহেব, আমি যাইগা। মতিউর সাহবকে সালাম দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো করিম মিয়া। তার চোখে পানি টলমল করছে।
– আরে, করিম মিয়া! তোমার বাকি টাকা নিবে না?
– সাহেব, আরেকদিন নিমু নে।ওখন যাইগা।আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো করিম মিয়া। তার মনে ভয় কাজ করছে, আজাদ বাড়ি ফিরে মায়াকে না দেখে না জানি কি কান্ড করে ফেলে।
আজাদ স্কুল থেকে তার বড় বোনদের সাথে বেলা তিনটার দিকে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকে কোনমতে স্কুল ব্যাগটা রেখেই গরুর ঘরের দিকে দৌড় দিলো ও। এটা ওর নিত্যদিনের নিয়মমাফিক কাজ। স্কুল থেকে এসেই হাতমুখ না ধুয়ে, গোসল না সেরে, খাওয়াদাওয়া না করেই আগে মায়ার কাছ থেকে একবার ঘুরে আসা। আজাদ গোয়ালঘরের দিকে হাঁটা শুরু করতেই উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা আম্বিয়া বেগমের বুক ধকধকানি দিয়ে উঠলো। তার স্বামীও বাড়ি ফিরেনি এখনো, তাহলে আজাদ এখন হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে উঠলে কে সামলাবে তাকে?

আজাদ গোয়ালঘরে ঢুকে মায়াকে না পেয়ে একটু অবাক হলেও, পরে ভাবলো হয়তো ওর বাবা মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গেছেন। তাই সে বের হয়ে এসে, উঠোনে রাখা বালতির পানি দিয়ে হাতমুখ ধুতে শুরু করলো। আম্বিয়া বেগম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি তার ছেলেমেয়ের জন্য ভাত আনতে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। আজাদ হাতমুখ ধুয়ে এসে মাদুরে ভাত খেতে বসে গেলো।

আম্বিয়া বেগম ভাত-তরকারি হাতে করে এনে মাদুরে রাখতে রাখতে বললেন-
– বাপ শুন, আমরা গরীব মানুষ। আমগো আহ্লাদ বলতে কিছু থাকন ঠিক না। তাই এইসব মাইনা নিয়া জীবনে চলা শিখ, বুঝলি?
– আম্মা, এইসব কি কইতাছো তুমি? আজাদ অবাক।
– না কিচ্ছু না, তুই খাতো, ব্যাটা।
আজাদ খুব তৃপ্তিসহকারে যখন পালংশাক দিয়ে ও কাঁচামরিচ দিয়ে ভাত মাখিয়ে প্রথম নলাটা মুখে পুরে নিলো, ঠিক তখন ওর বাপ বাড়ির উঠোনে পা দিলেন। আজাদ ওর বাবাকে দেখে, তার আশেপাশে নিজের মায়াকে খুঁজলো।
আম্বিয়া বেগমের হাত-পা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে এলো। তিনি স্বামীর চোখে পানি দেখতে পেলেন।
-আব্বা,আমার মায়া কই? মাঠ থেইকা আনো নাই?

করিম মিয়া কিছু না বলে ধীরপায়ে ছেলের দিকে এগিয়ে এলেন। আজাদের দুই বোনও নিজেদের বাবার এমন আচরণে ভয় পেয়ে গেলো। ওরা সকলেই ভাতের থালা ফেলে, বাবার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। আম্বিয়া বেগম আয়েশার পাশ থেকে উঠে এসে আজাদের একপাশে বসে, ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। আজাদ তার বাবা-মায়ের এই অদ্ভুত আচরণের কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। করিম মিয়া নিজের ছেলে কাছে এসে মাদুরের উপর হাত পা ছড়িয়ে নিঃস্ব সর্বহারা মানুষের মতন বসে বুক চাঁপড়ে হঠাৎ কান্না শুরু করেন। আজাদ এবার বড্ড ভয় পেয়ে গেলো।সে উঠে দাঁড়িয়ে তার বাপের কোলে বসে, তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

-আব্বা,তুমি কাইন্দো না। কি হইছে খুইলা কয়। তুমি কাইন্দো না আব্বা। আজাদও বাপের কান্না দেখে কাঁদতে শুরু করলো।
-বাপরে! ও বাপ! আমি তোর মায়ারে কুরবান কইরা আইলাম রে বাপ! আমরা গরীব বইলা আইজ, আমাগো জিনিসের প্রতি বড়লোক মাইনষের চোখ পড়ে। বাপ! ও বাপ! আমাকে তুই মাফ কইরা দে। ওগো কথা না হুনলে, আমাগো এই গেরামে থাকা মুশকিল কইরা দিবো ওরা! আমার কোন পথ আছিলো না রে বাপ! করিম মিয়া হাহাকার করে কেঁদেই যাচ্ছেন।

আজাদ শোকে দুঃখে পাথর হয়ে গেলো। ওর চোখে আর একফোঁটা জল নেই,মুখে কোন শব্দ নেই। সে বাবার বুকে একটা মৃত লাশের মতন লেপ্টে পড়ে রইলো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত