ভুল

ভুল

বেলকনির গ্রীল ধরে বিকেলের নরম রোদের দিকে তাকিয়ে পূরোনো কিছু স্মৃতি আজ খুব মনে পড়ছে আমার। নিজেকে বড্ড একা একা লাগছে।

কখন যে দুই চোখে নোনতা জল চলে এসেছে বুঝতেই পারলাম না। আসলে মানুষ যখন কষ্টের কিছু স্মৃতি নিয়ে ভাবে তখন সেটা আবেগের বশবর্তি হয়ে কান্না হয়ে ঝরে পড়ে।

– কি ভাবছো ফাহিম?
পিছনে তাকিয়ে আফরিনকে দেখলাম। এই মেয়েটা আমাকে নতুন ভাবে বাচতে শিখিয়েছে।
– কিছু না।
– কাঁদছো তুমি আবার?
– কই না তো? (চোখটা মুছে)

দেখলাম আফরিনও কেঁদে দিছে। খুব কাছের মানুষ যারা তারাই শুধু কাছের মানুষদের কান্না দেখে কেঁদে ফেলে।
– প্লিজ কেঁদো না। (বুকে টেনে নিয়ে)
– অর্পা কে খুব মিস করছো তাই না। (আফরিন)
– হুমম।

রুমে চলে আসলাম। রুমে শুয়ে আছি আর আফরিন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর আমি অর্পার কথা ভাবছি।
কারণ অর্পার এর আজ মৃত্যু বার্ষিকী। তাহলে ঘটনাটা খুলেই বলি।

***

আমি আর অর্পা একে অপরকে অনেক ভালোবাসতাম। দুইজন একই ভার্সিটিতে পড়ার ফলে পরিচয়। এরপর থেকে দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসলাম। আমরা ছিলাম সবচাইতে সুইট কাপল। কারণ আমাদের মাঝে বড় কোনো ঝগড়ায় হতো না কোনোদিন। যদিও হত তবে সেটা ২ ঘন্টার মধ্যেই আবার ঠিক হয়ে যেতো।

এভাবেই কেটে যায় দুই বছর, আমাদের রিলেশনের বয়সটাও বেড়ে যেতে থাকে। একদিন সকাল থেকে অর্পাকে কল দিই কিন্তু সে আর ধরে না। যতবার দিই ততবারই সে কেটে দেয়। আমি তার এই আচরনে কেমন যেনো বহুগুনে কষ্ট পেতে থাকি। ঠিক বিকেলের সময় জান্নাত ফোন ধরে।

– বাবু তোমার কি হয়েছে আমার ফোন কেনো ধরছো না? (আমি)
– আমাকে আর কোনোদিন ফোন দিবি না তুই।
– মানে? কি বলছো এসব?
– যা বলেছি তাই। ফোন দিতে মানা করেছি মানে দিবি না।
– কিন্তু কারণটা তো বলো? আমি কি করেছি সেটা বলো?
– কিছুই না। আমার ইচ্ছে তাই। আর যদি ফোন দিস তোর খবর আছে।

হুট করেই অর্পা ফোন কেটে দেয়। কিছু বলার সুযোগও দিলো না। কিন্তু সে কেনো আমার সাথে এমন করলো?
খুব রাগ হল, কোনো কারণ ছাড়াই সে আমার সাথে এমনটা কেনো করলো? তবে কি জান্নাত অন্য কোনো কারো সাথে রিলেশন এ আছে? অনেক কিছুই ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কোনো ঠিক করতে পারলাম না। তবে অর্পার উপর খুব রাগ হতে লাগলো। যার কারণে আমি আর তখন ফোন দেইনি। কিন্তু রাতে ফোন দিয়ে দেখি অর্পার ফোন অফ।

সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। নিজেকে চেয়েছিলাম শেষ করে দিই। কিন্তু পারিনি এটা ভেবেই, যে চলে যাবার সে যাবেই… তার জন্য কেনো আমি আমার মুল্যবান জীবনটা শেষ করতে যাবো? হয়ত সে সুখী থাকবে কারো কাছে, কিন্তু অন্যকে ঠকানোর ফলে কোনোদিন না কোনোদিন শাস্তি পাবেই।

আমি আর কোনো কল দেইনি। রাগের জন্য কোনো খোঁজও নেইনি। একদিন রুমে শুয়ে ছিলাম। দারোয়াআন এসে বলে-

– ছোট স্যার…
– হুমম।
– আপনার জন্য একটা চিঠি আছে।
– চিঠি? কে দিয়েছে?
– চিনিনা আমি, তবে একটা মেয়ে। সে বললো আপনাকে দিয়ে দিতে এই চিঠিটা।
– ওহহ দেন…

চিঠিটার খাম খুলে ভাজ করা একটি কাগজ দেখলাম। সেই ভাজের উপরে যে নামটা দেখলাম সেটা দেখে কেমন যেনো করে উঠলো বুকের মধ্যে। নামটা ছিলো অর্পার। কিছু না ভেবেই চিঠিটা খুললাম। পড়তে শুরু করলাম-

“প্রিয় ফাহিম,

কেমন আছো তুমি? জানি ভালো নেই। আমিও ভালো নেই। বুঝেছি ফাহিম, তুমি আমার উপর খুব রেগে আছো। কিন্তু কি করবো বলো? রাগাটাই যে স্বাভাবিক।

জানো, আমিও সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। যেদিন তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। সেদিন তুমি যতটানা কষ্ট পেয়েছিলে আমিও ঠিক সেরকম কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি যে নিরুপায় ছিলাম। আমার এই জীবনে তোমাকে যে জড়াতে চাইনি। কারন আমার যে ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে ফাহিম।

তোমার সাথে লাষ্ট যখন কথা হয়েছিলো তার ১ সপ্তাহ আগেই ধরা পড়ে। তোমাকে সেটা কখনই বুঝতে দেয়নি।
সরি তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য। তুমি যখন চিঠিটা পড়বে তখন আমি আর থাকবো না।

তুমি ভালো থেকো ফাহিম। খুব ভালোবাসি তোমাকে।

ইতি,
তোমার অর্পা।”

চিঠিটা পড়ার পর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়েছিলো সেদিন। খুব কান্না করেছিলাম আমি। নিজেকে ঠিক তখনি মনে হয়েছি শেষ করে দিই। কিন্তু মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে পারিনি। বুঝে নিছিলাম সুইসাইড সব কিছুর শেষ হয় না।

তবে সেদিন থেকে পাগল প্রায় হয়ে গেছিলাম আমি। সঙ্গী ছিল আমার অন্ধকার ঘর, সিগারেট আর নিরাবতা।

তবে সেটা আর বেশিদিন থাকতে পারিনি। আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে আফরিনকে বিয়ে করতে হল। তবে মেয়েটা অনেক ভালো। আফরিনকে সব কিছুই খুলে বলেছিলাম। সেদিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারি অর্পা মারা যায় ঝগড়া হওয়ার ৫ দিন পরেই। আর আমি ভূল বুঝে তার খোজ নেয়নি কখনও।

আফরিনকে বলার পর সেদিনও মেয়েটি কেঁদেছিলো। হয়ত আপনজনের কষ্টে কেঁদেছিলো। তারপর থেকে আফরিন মেয়েটি আমাকে অনেক ভালোবাসে আর কেয়ার করে। তার ভালোবাসায় আমি নতুন করে বেঁচে আছি। তবে অর্পাকে অনেক মিস করি।

– ফাহিম? (আফরিনের ডাকে বাস্তবে ফিরলাম)
– হুমম..
– চলো আজ আমিও যাবো।
– কোথায়?
– অর্পার কবর জিয়ারত করতে।
– সত্যিই যাবা?
– হুমমম

আজ আফরিনকে নিয়ে যাচ্ছি অর্পার কবরের কাছে। প্রতি তিন বছর ধরে আমি একাই আসি জিয়ারত করতে।
আজ আফরিনকে সাথে নিছি। নিজেকে কেমন সুখী মনে হচ্ছে। তবে শুন্যতা রয়েই যাবে একটা সারাজীবন..

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত