কথা

কথা

রাত তিনটার সময় হঠাতই ধড়মড় করে শোয়া থেকে উঠে যায় অমিত। তীব্র শীতেও সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজবা হয়ে গেছে। কোন রকমে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাইরে বের হয় নেটওয়ার্কের আশায়, এক্ষুনি মাকে ফোন করতে হবে। আজকের দিনে এতরাতে ছেলের ফোন দেখে অবাক হয়ে যায় অমিতের মা।

– কি ব্যাপার বাবা, কোন সমস্যা?
– মা, মহুয়া কি বাড়ীতে আছে?
– না তো, আজ সন্ধ্যায় শ্বশুর বাড়ী গেলো দেখলাম। কিন্তু তুই এমন হাপাচ্ছিস কেন? আর এতরাতে ওর কথাই বা জিজ্ঞাস করার মানে কি ?
– মা, দোহাই লাগে তুমি কি একটু ওদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিবে ও ঠিক আছে কিনা, আমি একটা খুব বাজে স্বপ্ন দেখেছি।
– এই গভীর রাতে! পাগল হয়ে গেলি নাকি? স্বপ্ন তো স্বপ্নই, ওর কিছু হয়নি। দুপুরেও দেখলাম মা-মেয়ে উঠানে বসে মাছ কাটছে, আমার সাথে হেসে হেসে গল্প করলো, ওর স্বামী ঢাকায় ওর নামে আরেকটা ফ্ল্যাট নাকি কিনেছে, কি খুশী মেয়েটা। তুই ফোন রাখ তো, সারাদিন অনেক ধকল গেছে আমার।
– তাও একটু যাও না মা প্লিজ।
– পাগলামো করিস না, এই শীতের রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। থাক তুই, সাবধানে আসিস।

ফোন কাটতে যাবে ঠিক এমন সময় হঠাতই মহুয়াদের বাড়ির উঠান থেকে চিৎকার শুনতে পেলো অমিতের মা, মহুয়ার বোন আর মা কাঁদছে, বাড়ির অন্যরাও বের হয়ে এসেছে। মহুয়ার ছোট ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো – কাকী, মহুয়া দি আর নাই। ফোনের ওপাশ থেকে শোরগোলের মাঝেও স্পষ্ট শুনতে পেলো সে কথাটা অমিত। মহুয়ার স্বামী ফোন দিয়েছিল – গলায় ফাঁস দিয়েছে মেয়েটা!

এরকমই এক শীতের রাতে বিয়ে হয়ে যায় মহুয়ার। অমিত তখন মাত্রই ভার্সিটির ১ম বর্ষের ছাত্র, কিছুই করার ছিল না, বিয়েতে কাজের তদারকি করা ছাড়া।

এরপর গুনে গুনে ১২ টি বছর কেটে গেছে, মহুয়া স্বামী, সন্তান নিয়ে পুরোপুরি সংসারী হয়েছে, চেহারায় আভিজাত্যের ভাব এসেছে। অমিত দেশের বাইরে থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসে বড় পদে চাকরী করছে। এতো বছরে কতো ঈদ, পূজা – পার্বনে তারা মুখোমুখি হয়েছে কিন্তু শুকনো একটুকরো হাসি ছাড়া কোন কথা বিনিময় করেনি। অমিত দুয়েকবার চেষ্টা করেছিল, মহুয়া নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। অমিতও মেনে নিয়েছিল মহুয়া সুখী আছে ভেবে।

শুধু ঠিক যেদিন অমিতের আংটি বদল হলো সে রাতে বালিশের পাশে টিস্যুতে মোড়ানো একজোড়া কানের দুল পেয়েছিল। কলেজ যাতায়াতের টাকা বাঁচিয়ে ৬০ টাকা দিয়ে নীল রঙের কানের দুল জোড়া কিনেছিল মহুয়ার জন্মদিনের উপহার হিসেবে।

বিয়ের পর শেষ রাতে লুকিয়ে মহুয়া অমিতের সামনে দাঁড়িয়েছিল, কেঁদেছিল, বলেছিল – আজ তোমায় যে কষ্ট দিচ্ছি, সেই কষ্ট নিজে নিতে পারবো না, দেখো যেদিন তোমার বৌয়ের বরণ হবে সেদিন আমি চিতায় উঠবো।

এইতো একটু পরেই অমিত তার সদ্য বিয়ে করা বৌ নিয়ে বাড়ি যাবে, মা সুন্দর একটা বরণ ডালা নিজে হাতে সাজিয়ে রেখেছেন।

মহুয়া তার কথা রেখেছে, তার চিতার আয়োজন চলছে।

কেউ কেউ কথা রাখে, শত সহস্র বছর পরেও কথা রাখে…

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত