কাল রাত সাতটা থেকে একা একা প্লাটফর্মে বসে আছি। উদ্দেশ্য আটটার সময়ে যে ট্রেন আসবে তার সামনে ঝাপ দিয়ে, এজীবনের নিস্পত্তি ঘটাবো। আজকাল মরতে গেলেও টাকা লাগে। মরার জন্য বিষ, দড়ি, কিংবা ঘুমের ঔষধ কেউই আমাকে ফ্রীতে দিবেনা, টাকা লাগবে। তাই ফ্রীতে মরার এর থেকে নির্ভরযোগ্য চিন্তা তক্ষনাৎ আমার মাথায় আসেনি।
মাত্র তিনদিন আগে আঠারো বৎসরের কোটা পূর্ন করেছি। আঠারো বছর বয়স নিয়ে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটা কবিতা আছে….
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উকি।।
এতদিন পরীক্ষায় পাশ করার জন্য কবিতা পড়তাম। শখ করে একটা কবিতাও কখনো পড়ে দেখিনি। অথচ এই কবিতাটাই গতকাল আমার জীবনে সত্যি হয়ে যাচ্ছিলো।
মানুষ আত্মহত্যা করে কেন? চাকরি হীনতায়, পরীক্ষার রেসাল্ট আশানুরূপ না হওয়ায়, ফ্যামিলির কড়া শাসনে নাকি প্রেমে ব্যার্থতায়? বাস্তবে মানুষ আত্মহত্যা করে, তার হৃদয়ে জমে থাকা তীব্র হতাশায়?
হ্যাঁ। এই হতাশা থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ আত্মহত্যা করে। যেখানে থাকবে জাহান্নামের তীব্র যন্ত্রনা। তবে কোনো হতাশা থাকবে না। আমার এই আঠারো বছর বয়সে আমি ঠিক কী হতাশায় ভুগছি সেটা আপাতত আপনাদের বলতে চাচ্ছিনা।
প্ল্যাটফর্মে বসে মাথায় মধ্যে দুইটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আত্মহত্যা করবো? নাকি লক্ষী ছেলের মতো বাড়ি ফিরে যাবো?
মন আর জেদ বলছে, তুই লাফ দে। তুই পারবি, তোকে পারতেই হবে। তুই যদি এখানথেকে পালিয়ে যাস, তবে সমাজ তোকে কাপুরুষ বলবে। তুই এতো ভাবিসনা চোখ বন্ধ করে লাফ দে।
আর বিবেক বলছে, রাতের এই প্লার্টফর্মের দিকে চেয়ে দেখ, এখানে কত ভূমিহীন, বস্ত্রহীন, বিকৃত মস্তিকের মানুষ আরাম করে ঘুমাচ্ছে। চেয়ে দেখ, দুই হাত না থাকা পঙ্গু ভিখারিটাকে অন্য ভিখারিটা কত মমতায় বাসি পাউরুটি খাইয়ে দিচ্ছে। এরা যদি এত কষ্ট করে বাচতে পারে, তবে তুই কেন পারবিনা? তোর তো সব আছে।
আমার অচেতন মন বলছে, সাপোর্ট দেওয়ার মতো কেউ আছে? যেমন মা কিংবা বাবা। যারা একবেলা কষ্টে থাকলে অন্তত মাথায় হাত দিয়ে সান্তনাটুকু দিবে।
বিবেক বলছে, তাহলে আর তোর, নতুন করে মরে লাভ নেই। তোরতো মৃত্যু হয়েই গেছে। তোর অন্তরআত্মা অনেক আগেই এই সভ্য সমাজের কাছে মারা গেছে। এখন শুধুশুধু শরীরটাকে কষ্ট দিয়ে কী করবি?
কারো জন্য নাহলেও, তোকে তোর নিজের জন্য অন্তত বাচতে হবে।
একজন স্বাভাবিক মানুষের গড়আয়ুর হিসেবে আরো বিয়াঁল্লিশ বছর তোকে বাচতে হবে।
এই আধুনিক যুগের সভ্য সমাজে মরাই সহজ, বেচে থাকাই কঠিন। এই কঠিন কাজটাই তোকে করতে হবে।
তোকে অন্যকে বেচে থাকার অনুপ্রেরনা দিতে হবে। চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। যা ঘরে ফিরে যা। গিয়ে দেখ কেউ না কেউ ঠিকই তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। আর এইসব আবোলতাবোল চিন্তা বাদ দিয়ে ভালো চিন্তা কর। জীবনটাকে রাঙিয়ে ফেল। কষ্ট থাকবেই, তাই বলে আত্মহত্যা করতে হবে, এর কোনো মানে নেই। মনের কথা ধরিস না, বাড়ি ফিরে যা।
আমি আর প্লাটফর্মে থাকিনি। কাপুরুষ হয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছি।