আজাদ সাহেব স্পষ্ট অনুভব করলেন তার হাত-পা কাঁপছে, থরথর করে কাঁপছে। এই প্রচন্ড ঠান্ডায়ও তার কপাল বেয়ে ঘাম বেরিয়ে পড়ছে। কখনো কি তিনি ভেবেছিলেন এভাবে তার সাথে আবার দেখা হয়ে যাবে?
রেলষ্টেশনে শব্দ করে ছুটে চলা ট্রেনগুলোর সেই তীক্ষ্ণ শব্দ কেমন যেন মলিন হয়ে আসছে। তার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে, অনেক বেশি ঝাপসা। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তিনি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছেন, তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে নীল শাড়ি পরা কেউ একজন- সেই বাইশটি বছর আগের কোন এক দিন।
মেয়েটির নাম ছিল নীলাদ্রি। তার সাথে প্রথম পরিচয় ভার্সিটিতে ভর্তির সময়। ভিন্ন দুই বিভাগে ছিলেন দুজন- তিনি রসায়ন, মেয়েটি আইন। মফস্বল থেকে উঠে আসা এক ছেলের কাছে রাজধানী তখন যেন এক স্বর্গ। সেই স্বর্গ দেখে দেখেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। সেখানেই কোন এক অদ্ভুত বিকেলে তার সাথে দেখা হয়ে যায় আজাদ সাহেবের। খুব সাধারণ এক বিকেলে অতিমাত্রায় সাধারণ এক মেয়ের দিকে ঠিক নজর পড়ার কারণ তার আজও জানা নেই। বেঁটে, স্থূল সেই মেয়ের মাঝে তিনি কি যেন এক খুঁজে পান। ঠোঁটের কোণায় ছোট্ট একটা তিল, হাসিতে কেমন যেন বাচ্চামো। সেই বাচ্চামোতে তিনি অবাক হন। কিছু একটা খুঁজে পান, রহস্যের বেড়াজালে আটকা পড়েন অনবরত।
সে সময় শহরটা এতটা খোলামেলা হয় নি। মেয়ে-ছেলে একসাথে ঘুরে বেড়ানো, কোথাও বসে আড্ডাবাজি করা কেমন যেন বেহায়াপনা হিসেবে দেখা হত। নীলাদ্রি ছিলেন অন্যরকম। তিনি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, মাঠে বসে ছেলেদের সাথে আড্ডাও দিতেন, রাত করে ক্যাম্পাস ছাড়া তার জন্যে ছিল নিয়মিত কাজ। কারো বারণ,কানাঘুষা,ফিসফিসানী শোনার তার সময় নেই। আজাদ সাহেব মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখতেন। তার প্রাণবন্দ চাঞ্চল্যে মুগ্ধ হতেন। মনের মাঝে বলার মত অনেক কিছুই জমা পড়তে লাগলো। তিনি অপেক্ষায় থাকতেন। নীলাদ্রি নামের মেয়েটির সাথে একটি বার কথা বলার অপেক্ষায় তিনি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতেন।
সেই অপেক্ষা একদিন শেষ হলো। সেদিন আকাশে মেঘ ছিল না। তেতে ওঠা রোদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সবাই। তেমনই এক দিনে, ক্যান্টিনে দেখা হয়ে গেলো মেয়েটির সাথে। ধপ করে ঠিক তার সামনে বসে পড়লেন নীলাদ্রি। পরনে তার সাদা শাড়ি, খোলা চুলগুলো মানিয়েছেও বেশ। ঘটনার আকস্মিকতায় আজাদ সাহেব সেদিন হতবাক হয়েছিলেন। অনেকটা সময় বড় বড় চোখে চেয়েছিলেন তার দিকে। অবাক হয়ে খেয়াল করলেন নীলাদ্রি তাকে অনেক আগে থেকেই চিনেন। নিজেকে যে ক্ষুদ্র জগতে আটকে ফেলেছিলেন তা নিমিষেই ছিন্ন করে দিলেন।
ধীরে ধীরে বন্ধুত্বটা গাঢ় হল। সাইকেলে করে তাদের ছুটে চলা দেখে পুরো শহরটাই যেন অবাক হয়ে যেত।কারো মনে ক্ষীণ সন্দেহ, এরা পাগল নয় তো। এ চলার পথে মাঝেমধ্যে তারা হাপিয়ে উঠতো। তখন থেমে যেত কোন নির্জন মাঠের ধারে। ক্লান্ত চোখে ডুবন্ত লাল সূর্যটা পরখ করতেন নীলাদ্রি। আজাদ তখন তার কাঁধের কাছে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলোর মাঝে হারিয়ে গেছেন।
ধীরে ধীরে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। কখন যে পেরিয়ে গেলো তা আর বোঝা হয় নি আজাদ সাহেবের। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তারা যে অনেকটাই পরিণত হয়ে ঊঠেছে তা কে জানতো?
সেদিনটাও অনেক সাধারণ ছিল। এতটাই সাধারণ যে মনে রাখার কোন কারণই হয় না। তবুও সেদিনটি আজাদ সাহেব আজও মনে রেখেছেন। মনে আছে কাপাকাপা হাতে নীলের তুলে দেয়া কার্ডটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার সময় তার চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছিল, বুক ফেটে যাচ্ছিল অজানা কোন অনুভূতিতে। কিন্তু তিনি পারেন নি। পারেন নি শুধু এটুকু বলতে, “নীলাদ্রি আমি তোমায় ভালোবাসি।” নিস্তব্ধতার মাঝেই নীলাদ্রিকে বিদেয় দিয়েছিলেন। কাজের মাঝে ডুব দিয়েছিলেন এতটা বছর। তবুও সূক্ষ বেদনাটি তিনি ভুলতে পারেন নি। হয়তো পারবেনও না।
আজ সে বেদনা আবারও টের পেলেন স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তার একাকিত্বে আবব্ধ করে ফেলা জীবনের প্রধান কারণ এই মেয়েটি। একাকিত্বের মাঝেই তার অস্তিত্ব, ভালোবাসা- সবটুকু।
“ভুলেই তো গেলে-”
কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন আজাদ সাহেব। নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে একটা মলিন হাসি দেন তিনি। কোন উত্তর করেন না। তাদের মাঝে কিছুটা সময় আবার নিস্তব্ধতা ফিরে আসে।
“সবাই কেমন আছে?” নীলাদ্রি প্রশ্ন করে।
“কোন সবাই?”
অবাক হয় নীলাদ্রি। “পরিবারের সবাই-”
হেসে ওঠেন আজাদ সাহেব। “বিয়েই তো করি নি।”
কেমন যেন কেঁপে ওঠে নীলাদ্রি। “কেন!”
আজাদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। নীলাদ্রির থেকে চোখ ফিরিয়ে নেন। দূর থেকে একটা ট্রেন এগিয়ে আসছে। তিনি উঠে দাঁড়ান। কোন কথা না বলে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেন। পেছনে পড়ে থাকেন মেয়েটি, অবাক চোখে তিনি আজাদ সাহেবের হেঁটে চলা দেখতে থাকেন। যেতে যেতে আজাদ সাহেব কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মৌনতার মাঝে তিনি যে সত্যগুলো বুঝিয়েছেন তা কি মেয়েটি বুঝে উঠেছে? আজাদ সাহেব জানেন না, জানতেও চান না। তবুও মনের মাঝে কি যেন একটা খচখচ করে। এর নামই কি ভালোবাসা?