তার কাছ থেকে চলে আসার পর আমার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছিলো। সারাদিন আমি শুধু রোদে রোদে ঘুরে বেড়াই। আর বন্ধুদের কাছে, পরিচিত, আধাপরিচিত লোকজনের কাছ গিয়ে গিয়ে চাকরি খুঁজি। এক পর্যায়ে তারা আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে, ফোন ধরে না, ফোন কেটে দেয়, কিংবা কেউ ভুলে ফোন ধরলেও হুঁহাঁ করে কেটে দেয়।
একবার চাকরি ছেড়ে দিলে আরেকটা চাকরি পাওয়া ভয়ানক কঠিন, তা আমার মতো অনেকেই জানেন। স্ক্রিপ্টরাইটার হিশেবে এক জায়গায় ভালোই শুরু করেছিলাম। একদিন ছাদে ওঠে পানির ট্যাংকির সঙ্গে হেলান দিয়ে গাঞ্জা টানছিলাম, আর বসের বউ ফোনে কথা বলতে বলতে ছাদে ওঠে এলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম ভালো আছে কিনা। আর আমার চাকরি চলে গেলো। এর আগে অবশ্য আমি নিজেই নয়টা চাকরি ছেড়েছি। তারমধ্যে একটা চাকরি ছেড়েছি ছয়দিনের মাথায়।
যাই হোক, এখন ফা ফা করে ঘুরে বেড়াই, আমার বুকের ভিতর বিচ্ছিরি টাইপের যন্ত্রণা হতে থাকে, যেনো বা কেউ হৃৎপিণ্ডের বোঁটায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে কুড়িতলার ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আর আমি দ্রুত পতিত হচ্ছি, মাটির দিকে ধাবমান আমার মনে হচ্ছে কুড়িতলা হয়ে যাছে ক্রমে ষাটসত্তরআশিতলা, আকাশের দেবতা খামচে ধরে আছে আমার হৃৎপিণ্ড।
একদিন নিজের ওপর রাগ করে কাঁধের ঝোলা থেকে বের করে আমার ভাত খাওয়ার সানকিটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললাম। তারপর মোবাইল ফোনটা পানবিড়ির দোকানে ছয়শো চল্লিশ টাকায় বিক্রি করে দিলাম। ছয়শো চল্লিশ টাকা বামহাতের মুঠোতে চেপে ধরে যখন একটা পার্কের পাশে দাঁড়িয়ে আছি তখন দেখি একটা ছেলে গরুদুধের বড়সরো বোতলহাতে একটা বাসায় ঢুকছে। আমার সহসা কিয়েসলোভস্কির সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেলো, যে কিনা পাড়ার এক বয়স্ক সুন্দরী মহিলার প্রেমে পড়ে দুধঅলা হয়ে গেলো। আমি কন্যারাশির জাতক, আমার নিজেকে মারমেইড মনে হলো। ভাবলাম, একটা টিয়্যুশন জুটিয়ে নিই। ভাবলাম, বাঙলাবাজারে গিয়ে আবার প্রুফরিডারের কাজ খুঁজি। ভাবলাম, বেশ্যার দালালি করি, ভাবলাম, ফুল বিক্রি করি।
একবার ভাবলাম, লেখক হয়ে যাই, গল্প লিখি, কিন্তু গল্প লিখে কী হবে? এখনতো গল্প চলে না, এখন গল্পের নামে লোকজন নাটক লেখেÑসংলাপে ঠাসা; তারা জানে না যে সংলাপবহুল গল্প সবচে’ দুর্বল গল্প। তারপর ভাবলাম, গ্রামে চলে যাই। আমার গ্রামের কথা মনে পড়তে থাকে।
আমার গ্রামের নাম কাচপুর। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে। তার সঙ্গে বসবাসের আগে আমি থাকতাম কাকার বাড়িতে, কাচপুরে। কাচপুরে একদিন কাচপোকার মড়ক লেগেছিলো কিনা সেইকথা জানার আগে জেনেছিলাম আমার তিনবছর বয়সে আমার বাবা-মা দুজনেই শীতলক্ষ্যার বুকে অজানিত কারণে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তারপর আমাদের বাড়িঘর ছোটোকাকা দেখভালের সঙ্গে আমাকেও দেখভালের দায়িত্ব নিলেন। আমি রাতভর রাজহাঁসের কনাকনাকনা, কনাকনাকনা… ডাক শুনি, দরজা-জানলা খুলে কাচারি ঘরে ঘুমাই।
এইভাবে কেটে যাচ্ছিলো আমার শাদাকালো একফালি জীবন। কিন্তু হঠাৎ আমার আঠারোবছর বয়সের শুরুতে একদিন মাঝরাতে আমার জীবন রঙিন হয়ে ওঠলো। ছোটোকাকা কাকির সঙ্গে আমার সেইরকম একটা যৌনস¤পর্ক আবিস্কার করলো। এবং আমাকে বাপান্ত করে ঘর থেকে বের করে দিলো। আর সেইদিন কাকিও আমার অ›ধকার ঘরের এককোণায় দাঁড়িয়ে নতমুখে নীরবে সায় দিলো। অথচ কাকা বলার আগে এই সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। আমি অবাক হলাম না। রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথামৃত, আমার তেরোটা কবিতার খাতা আর রাজশেখর বসুর চলন্তিকা আমার ঝোলাব্যাগে নিয়ে নদী পার হয়ে শহরতলীর দিকে চলে গেলাম গভীর রাতে।
তারপর বেশকবছর ঘুরেটুরে ছেড়ে-ছুঁড়ে কিংবা বিতাড়িত হয়ে পার্কের পাশে দাঁড়িয়ে দুধের বোতল হাতে ছেলেটিকে দেখে আমার প্রবল তৃষ্ণা হলো, প্রবল তৃষ্ণা।
আমি একটি চায়ের দোকানে বসে একটা দুধবেশি চায়ের কথা বলে একটা টুলের ওপর বসলাম। যখনই ভাবলাম, একটা ভ্রাম্যমাণ কেকের দোকান দিয়ে বসবো তখন দোকানির মাথার ওপর কাঠের শেল্ফে উপবিষ্ট একটি টেলিভিশনের স্ক্রিনের গায়ে আমার চোখ আটকে গেলো। আবার দুধ!
ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে একটা টিভি চ্যানেলে। গোয়ালারা তাদের গরুদের একদিনে দোয়া সমস্ত দুধ একটা দিঘিতে ঢেলে দিয়েছে। এইটা তাদের প্রতিবাদ, কারণ শহরের দুধ-কো¤পানিগুলি তাদের কাছে কম দামে দুধ কিনে চড়া দামে বিক্রি করে। আমি খবরে আরো মনোযোগী হলাম—যখন দেখলাম ঘটনা আমাদের গ্রামের। গ্রামের নাম কাচপুর। দিঘিটা খবরে দেখাচ্ছে। দিঘির দুধশাদা জল দেখতে দেখতে আমার তৃষ্ণাসকল ফুরিয়ে গেলো। আমি তড়িঘড়ি করে একটা বাসে উঠে পড়লাম।
যখন গ্রামে পৌঁছলাম, গিয়ে দাঁড়ালাম দিঘিটির পাড়ে—আমার ছায়া দীর্ঘ হয়ে দিঘির মাঝ বরাবর চলে গেছে, সূর্যের দীর্ঘ আলতা-রং আলো এসে পড়েছে শাদা দিঘির বুকে, তখন মনে হলো এই বুঝি দুধে আলতা-রং। আর ছায়ার নিচে এমন ধবলরং জীবনানন্দের কবিতায়ও পাওয়া যাবে না। আমার মনে হলো, এই বুঝি রূপকথার দুধের দিঘি। এই দিঘিতেই শাদাপরীর হিরণ্ময় স্নান অথবা দিঘির অতলে লুকোনো সিন্দুকে বন্দী ভ্রমরের বুকের ভিতর আছে রাজকুমারের প্রাণ।
আহা রাজকুমার! নিজেকে রাজকুমার ভাবতেই ভয় হলো। আমার ঘোর কেটে গেলো। এবং তারপরেই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। একপ্রকার শয়তানি বুদ্ধিও বলা যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, রাজহাঁস জল থেকে দুধ আলাদা করতে পারে।
সূর্য প্রায় নিভে গেছে, সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমার মনে আছে, ছোটোকাকার রাজহাঁসের খামারটা দিঘির অদূরেই, এতোক্ষণে সব হাঁস আরাইলে ঢুকে গেছে।
আমি চুপিচাপ গিয়ে কাকার খামারে আগুন দিলাম। আগুনের শিখা লেলিহান হওয়ার আগেই কাকা দৌড়ে এসে আরাইলঘরের বেড়া কেটে দিলো। আর ঝাঁকে ঝাঁকে রাজহাঁস কনাকনাকনা, কনাকনাকনা… ডেকে ডেকে বের হয়ে গেলো। দেখলাম, তারা ঝাপিয়ে পড়ছে দুধভর্তি দিঘির জলে। আমি সতেরো মিনিট ধরে আরো অন্য অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখলাম, রামকৃষ্ণ পরমহংসই সত্য।
তারপর দুধরহিত দিঘির জলে হাঁসেরা একযোগে ডুব দিলো। আর ভেসে উঠলো না। তবে চিকচিক করে লাফ দিয়ে ডুব দিতে লাগলো অজস্র মাছ। বলা বাহুল্য, এই দিঘিতে অজ্ঞাত কোনো কারণে পূর্বে কখনো কোনো মাছ জন্মাতো না।
কাকা সহসা এসে আমাকে বুকে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো, ‘বাবুরে আমার হাঁসগুলান মাছ হইয়া গেলো রে…