সূর্যের প্রখর রৌদ্রে ধুলো উড়িয়ে আনমনে রাস্তায় হেটেই যাচ্ছি। কখন যে রাস্তার মধ্যখানে চলে এসেছিলাম বুঝতেই পারিনি। নিতান্তই ভালো চালক ছিলেন। নয়তো এতক্ষণে হয়তো অনেক দূর চলে যেতাম। ভালোই হতো ! এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে না থাকাটাই শ্রেয়। একটা মানুষ ঠিক কতটুকু চাপ সহ্য করতে পারে ? আজ আমি জীবন যুদ্ধের এক ক্লান্ত সৈনিক। অবসরের পথ খুঁজে খুঁজে আরও ক্লান্ত। তবুও খুঁজে পাইনা।
এরকম চিন্তা করতে করতে হঠাৎ ফোনটা কেঁপে উঠলো। ওপাশ থেকে,
“সজীব, তুই কোথায়?”
“এইতো রাস্তায় হেটে হেটে বাড়ি আসছি।”
“তারাতারি আস বাবা। সারাদিন না খেয়ে আছিস।”
“আচ্ছা মা, চিন্তা করোনা। আসছি।”
সেই সকালে বের হয়েছিলাম না খেয়েই। শুক্রবারে একটা ছাত্র পড়ানোর জন্য তিন কিলোমিটার হেটে আসা যাওয়া করতে হয়। পকেটের ১০ টাকা বাচানোর জন্য জুতো ক্ষয় করে রৌদ্রের প্রখর তাপ সহ্য করাতে অভ্যস্ত হয়েছি অনেক আগেই। মনে হচ্ছে ঘামের দ্বারাই গোসলটা সেরে নেওয়া যাবে। বৃক্ষরোপণের মর্মটা ভালোই বুঝতেছি। কয়েকদিন আগেও রাস্তায় পাশে অনেক বৃক্ষ ছিলো। যার জন্য অনেকটা ছায়া পাওয়া যেত। কিন্তু বৃক্ষগুলো নিধন করা কি এতোই জরুরি ছিলো ! এর উপকারিতা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ।
আসলে আমরা মানুষ এক ভিন্নধর্মী আজব প্রাণী! সবকিছুতেই উল্টো বুঝার অভ্যাস আমাদের। এই উল্টো বুঝার জন্য প্রতিনিয়ত অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ভুলবোঝাবুঝিতে আমরা মানুষ অভ্যস্ত। তাইতো “মানুষ মাত্রই ভুল”। আর এটাই চিরন্তন সত্য।
এই রৌদ্রতাপে আর হাটা সম্ভব হয়। সকালে কিছু না খেয়েই বেরিয়ে পরেছিলাম। এখন প্রায় আড়াইটা বাজে। ক্ষুধার্ত শরীর আর রৌদ্রতাপে খুবই ক্লান্ত। সামনে একটি বৃক্ষ দেখা যাচ্ছে। সেখানে কিছুক্ষণ বসে ক্লান্তি দূর করা যাবে। তবে হেটে আজ আর যাওয়া সম্ভব নয়। কোনো রিকশা এদিকে আসার আগ পর্যন্ত এখানেই বসে থাকবো।
বৃক্ষের নিচে বসে বসে ভাবি, মধ্যবিত্ত হয়ে কেন জন্মালাম। এর চেয়ে নিম্নবিত্ত হওয়া অনেক শ্রেয়। মধ্যবিত্তরা না পারে উচ্চবিত্তের মতো করে মাথা উচুঁ করে বাচতে আবার না পারে নিম্নবিত্তের মতো মাথা নিচু করে অন্যের কাছে হাত পাততে। মধ্যবিত্তদের জীবনটাই ঝুলন্ত!
বাবা অসুস্থ হওয়ার পর সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন আমার উপর। টিউশনির দ্বারা কি পাঁচ সদস্যের একটি পরিবার চালানো সম্ভব? তবুও তো চালাতে হবে! তার উপর সামনে পরীক্ষা! চাপটা একটু বেশিই হয়ে গেল। হতাশা আর মানষিক চাপ জীবনটাই নষ্ট করে দিচ্ছে। কেউ একজন বলেছেন, “হতাশাগ্রস্থ মানুষের বেচেঁ থাকার অধিকার নেই!”
উল্টোপাল্টা আজগুবি চিন্তা করার সময় হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হলো একটা রিকশা এদিকেই আসছে। রিকশার চালক পিচ্চি। আরে এ তো রাজু। বাজারে বিকেলে প্রতিদিন ঘুরাঘুরি করে। অনেক ভালো গান গায়, যার জন্য সবাই তাকে আদর করে। কিন্তু সে পড়াশোনা ছেড়ে রিকশা চালাচ্ছে কেন? আমার দিকেই আসছে।
“রাজু! তুই আবার কখন থেকে রিকশা চালাতে শুরু করেছিস?”
“আইজকা থাইক্কা, কই যাইবেন?”
“সামনেই গ্রামের রাস্তা পর্যন্ত। যাবি?”
“উঠেন ভাই”
“তোর আব্বা কোথায় ?”
“মেলা দিন ধইরা অসুখ। ঘরে খাওনের কিচ্ছু নাই। এখন থাইক্কা আমিই রিকশা চালাইমু।”
“তোর না সামনে সমাপনী পরীক্ষা?”
“হ! রাইত্তে পড়ুম। আর দিনে রিকশা চালাইমু। আমি না চালাইলে কে খাওয়াইবো আমাগো পাঁচ জনরে!”
“চলে এসেছি। ভালো করে পড়িস। তোর আত্মবিশ্বাস আমার চেয়েও বেশী। তোকে স্যালুট করতে ইচ্ছা করছে!”
“কি যে বলেন ভাই!”
“সত্যিই, তোর মতো ছেলে পাওয়া যে কোনো পিতার কাছে ভাগ্যের ব্যাপার!”
“দোয়া কইরেন, আমাগো লাগি। আব্বা যেন ভালো হইয়া যান।”
“অবশ্যই। আচ্ছা এখন আসি।”
তারপর ভাড়া দিয়ে চলে আসলাম আমার রাস্তায়। বাড়ি পৌছাতে আরও কিছুক্ষণ হাটতে হবে। ইচ্ছা ছিলো ওকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করার কিন্তু সামর্থ্য নাই।
আমাদের দেশে কখনোই শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়। যেখানেই একটা শিশু পরিবারের একমাত্র উপার্জন কর্তা! সেখানে কিভাবে সম্ভব। আমি নিজেও শিশুশ্রমিক ছিলাম! বাবার সাথে খুব স্কুল জীবন থেকেই ব্যবসার কাজে লেগে যাই। বাবা প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন। তাই আমাকেই দোকান সামলাতে হতো ১৩ বছর বয়স থেকেই!
স্কুলে যখন শিক্ষক ও সহপাঠী জিজ্ঞেস করতো কেন আসি না নিয়মিত,, কত বাহানা দেখাতাম! আমি কতবড় মিথ্যাবাদী, এখন ভাবলেই হাসি পায়। কলেজে উঠার পর থেকে ব্যবসা বন্ধ করে টিউশনি করে পরিবার চালাই। কিন্তু আত্মবিশ্বাস তলানিতে! পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্র আজ আমার চোখ খুলে দিলো! পিচ্চিটার আত্মবিশ্বাস দেখে নিজের উপর নিজেই লজ্জিত। সে যদি পারে আমি কেন পারবো না!
সূর্যের প্রখর তাপ এখনও আছে। তবে ছেলেটার থেকে যে তাপ আহরণ করেছি, তার তুলনায় খুবই নগন্য। যে বলেছে,”হতাশাগ্রস্থ মানুষের বাঁচার অধিকার নাই!” সে অনেক বড় মিথ্যুক!
তার “অনুপ্রেরণা নেওয়া উচিত এরকম হাজারো রাজুর থেকে!”