সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গেনা সহজে। রোজকার অভ্যেস মতো শরীর বুঝে গেছে এই সময়টা তার কোন কাজ নেই। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে এপাশ থেকে ওপাশ ফিরতে যাবো, এমন সময় মোবাইলের alarm টা বেজে উঠলো। বিরক্ত মুখে চোখটা সামান্য খুলে দেখলাম সাড়ে পাঁচটা। এত তাড়াতাড়ি কি করে সকাল হলো সে ভাবনায় না গিয়ে ছোট্ট করে snooze করে দিলাম alarm টা। এরকম বার তিনেকের চেষ্টায় অবশেষে উঠতেই হলো। প্রায় প্রত্যেক উইকেন্ডে বাড়ি যাই। কলকাতায় থাকি চাকরি সূত্রে। বিয়ে হয়নি এখনও। তাই একটা মেসে থাকি কয়েকজন বন্ধুর সাথে। তারাও প্রায় সবাই আমারই মতো সপ্তাহের শেষে বাড়ি চলে যায়। তবে তফাৎ শুধু একটাই, তারা সব ভোর হবার আগেই বেরিয়ে যায়। কেউ থাকে মেদিনীপুর, কেউ বাঁকুড়া। কি করে ওরা এত ভোরে উঠে বেরিয়ে যায়, সে আমার কাছে ভারি আশ্চর্যের! তা যাই হোক, বাড়ি ফেরার পথে আমার প্রথম বাধা এই ঘুম। সারা রাত জেগে থাকতে বললে আমার কোন সমস্যা হয়না কিন্তু এত সকালে ওঠা খুবই কষ্টকর। তবু বাড়ির টান আর বাড়ির খাবারের হাতছানি অস্বীকার করা যায় না। মেসে বিশেষ কেউ থাকে না বলে, উইকেন্ডে রান্নার মাসি হালকা করে ডুব দিয়ে দেয়। ফলত পেটের জোগাড় করতেই নাজেহাল অবস্থা হয়। তারপর আবার সোমবার থেকে গাধার মতো খাটনি। তাই এই আত্মত্যাগ টুকু স্বীকার করে উঠে পড়লাম। আর তখনই বুঝলাম আমার ছোট্ট ছোট্ট দশ মিনিটের snooze গুলো এবার আমার জন্য মহাকাল হয়ে উঠবে। কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে দৌড় লাগলাম স্টেশনের দিকে।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। ট্রেন আসতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি আর টিকিটের লাইন দেখে মনে হচ্ছে যেন সারা কলকাতা বাড়ি ফিরছে। চায়ের দোকানটাও কাছাকাছি নেই যে দু চুমুক চা খাবো। সকালে উঠলে আবার বড্ড খিদে পায়। একটা বাচ্চা ছেলে লাইনে দাঁড়ানো সবার কাছে গিয়ে হাত পাতছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলছে, “রুটি খাবো।” পিছনে আরেকটু ছোট বাচ্চা মেয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে চলেছে। ছেলেটার বোন হবে হয়তো। পেট বড়ই হোক আর ছোটই হোক, খিদের জ্বালাটা সবারই এক। তবে যাঁরা টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছেন তাঁরাই জানেন, পেটের থেকে টিকিটের গুরুত্ব বেশি। তীব্র উৎকণ্ঠায় কেউ কেউ টিকিট কাউন্টার লক্ষ্য করে চিৎকার করছেন, “দাদা হাত টা একটু চালান। এরকম করলে তো কালকে টিকিট পাবো।” আমিও চিৎকার করলাম, “ও দাদা কি হচ্ছে কি! তাড়াতাড়ি করুন। ট্রেনটা তো বেরিয়ে যাবে।” বাচ্চা দুটো দেখলাম আমাকে টপকে এগিয়ে গেল। ওরাও জানে রাগী লোককে ঘাঁটাতে নেই। অবশেষে যখন টিকিট হাতে পেলাম, তখন ট্রেনটা স্টেশনে ঢুকে গেছে। ভাগ্যিস সব ট্রেন সময়ে আসে না। ওরাও বোধ হয় আমার মতো alarm snooze করে।
উসেইন বোল্টের মতো দৌড় লাগলাম আর অভ্যস্ত কেতায় ট্রেনের রড ধরে যখন উঠে পড়লাম তখন নিজেকে বীর যোদ্ধা ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছিল না, বিশ্বাস করুন। ভিড় খুব বেশি না থাকলেও ট্রেনের দরজা আমাদের দেশে সবসময়ই জনবহুল। সেই জনবহুল দরজার মুখে দাঁড়ানো এক পেশিবহুল যুবকের জিম করা বাইসেপে ধাক্কা লেগে আমার চশমাটা ভেঙ্গে গেল একটা “মচ” শব্দ করে। ঠিক তখনই এক হকার ভাই চেঁচিয়ে উঠলেন, “সাবুর পাঁপড় খান, মচ মচ করে খান।” মাথায় যেন আমার রক্ত উঠে গেল। ইচ্ছে করছিল ওই হকার আর এই যুবক দুজনকেই ট্রেন থেকে ফেলে দিই। বডি বিল্ডার যুবকের কিন্তু কোন হেলদোল নেই। একটা “sorry” বললেও মনটা কিছুটা শান্ত হতে পারতো। কিন্তু সে তখন বায়ুসেবনে মত্ত। বিরক্তিতে ভরে গেল মন। বললাম, “এই যে দাদা, এমন দাঁড়িয়েছেন যে মানুষ উঠতে পারবে না। দেখুন আমার চশমা ভেঙ্গে গেল।” সেই যুবক কটমট করে তাকালো। দেখলাম তার ট্রাইসেপ টাও ফুলে উঠেছে। পাশের বাকি লোকজন বললেন, “আপনি যেভাবে ট্রেনে উঠলেন, তাতে পরে গিয়ে আপনার হাড়গোর ভাঙ্গেনি, এই অনেক। চশমার ওপর দিয়ে গেছে।” আমি আর কি বলবো বুঝতে পারলাম না। বাহুবল, লোকবল সবই বিরূদ্ধে, তাই ভিতরটা জ্বলে গেলেও কিছুই করার ছিল না। একটা বসার জায়গা খুঁজতে লাগলাম। অর্ধেক ঘুম থেকে উঠে আসা চোখ, টিকিটের লাইনে অপেক্ষা করা উদ্বিগ্ন মন, খিদেয় জ্বলতে থাকা পেট, সাত সকালে দৌড়ঝাঁপ করা পা আর একটা ভাঙ্গা চশমা নিয়ে একজন মানুষ আর কিই বা করতে পারতো!
এদিক ওদিক খুঁজে একটা জায়গা পেলাম বসার। ট্রেনের ভিতরে ফুটবল খেলার জায়গা আর দরজায় দাঁড়িয়ে লোকজন। ওদিকটায় দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। মনে মনে গালি দিলাম অজস্র। তাতেও রাগ কমছে না। একটা ঝালমুড়ি উঠলেও অন্তত পেটের জ্বালাটা কিছু কমতো। কোনদিন দরকারের সময় এদের পাওয়া যায় না। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে “মচ মচ করে খান..।” শুনলেই গা টা রি রি করে উঠছে। যতই খিদে পাক, ওই মচ মচ করে আমি কিছুতেই এখন পাঁপড় খেতে পারবো না। চশমাটা হাতে নিয়ে দেখছি আর মনটা কষ্টে ভরে যাচ্ছে। মাত্র সাত আট মাস হয়েছে চশমাটা করিয়েছিলাম। বাড়ি গিয়ে দোকানে নিয়ে যেতে হবে। আবার কিছু পয়সার ধাক্কা। একটা ফ্ল্যাট কিনতে হবে, বিয়ে করতে হবে, কত কত টাকার দরকার। আর এসব ফালতু কারণে খরচা হলে কার মন ঠিক থাকে! মন খারাপ থাকলে যত রাজ্যের খারাপ চিন্তাগুলো ভিড় করে। আমার জীবনের সমস্ত বঞ্চনা, হতাশা, ব্যর্থতা, না পাওয়া ইত্যাদি নানারকম কথা একটা একটা করে মনে আসতে লাগলো। তার উপর এইমাত্র ঘটে যাওয়া লাঞ্ছনা যা আবার মুখ বুঁজে সহ্য করতে হলো। এসবই ভাবনায় একেবারে মুষড়ে পড়েছিলাম তখনই একটা সুর ভেসে এলো কানে। কেউ গান গাইছে।
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে/আমি বাইবো না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে”
ভাঙ্গা গলা কিন্তু তীব্র দরদ কণ্ঠস্বরে। কেমন যেন আকর্ষণ বোধ করতে লাগলাম। মনে হলো হতাশা, বিরক্তিতে ভোগা এক বাঙালীর কাছে আর কিছু না থাকলেও রবি ঠাকুর আছেন। কন্ঠস্বর ধীরে ধীরে আমার কাছে এগিয়ে আসছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। মানুষটা চোখে দেখতে পান না। বাকি ইন্দ্রিয় আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করে চলেছেন তাঁর পারিপার্শ্বিক আর নিজের জীবনকে। টিকিটের লাইনে দাঁড়ানো সেই ছোট্ট ছেলেটার কথা মনে পড়লো। জীবনের দুই বিপরীত প্রান্তে দাঁড়ানো দুটো মানুষ- একজনের জীবন সবেমাত্র শুরু হয়েছে আর একজন প্রায় শেষ পর্যায়ে। দুজনের সামনেই কি সাংঘাতিক সংগ্রাম, বেঁচে থাকার। বৃদ্ধ তাঁর কাঁপা কাঁপা শীর্ণ হাত এগিয়ে দিচ্ছেন প্রত্যেকের দিকে। কখনো দু একটা টাকা হাতে আসছে, মাথায় ঠেকিয়ে রেখে দিচ্ছেন। কখনো সাময়িক অপেক্ষার পর এগিয়ে চলেছেন অন্যজনের দিকে। না, তিনি থামছেন না, তাঁর গানও থামছে না। ট্রেনের পাঁচরকম কোলাহলের মধ্যেও সেই সুর ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়। মনটা ভারি শান্ত হয়ে আসছে আমার। হঠাৎ করেই কিভাবে যেন সব দুঃখ সরে যেতে লাগলো। আমি কি মনে করে দশ টা টাকা গুটিয়ে বৃদ্ধের হাতে দিলাম। অন্য সময় কখনো এক দুটো টাকা দিয়েছি কাউকে সবার সামনে। তাতেই বুকের ভিতরটা কেমন ফুলে উঠেছে। যেন বিরাট কিছু করেছি এমন ভাব নিয়ে গম্ভীর মুখে খবরের কাগজ কিংবা মোবাইলে মন দিয়েছি। জানি না কেন আজ খুব লজ্জা করছিল। মনে হচ্ছিল কেও যেন না দেখে। দেখলে যে একে ভিক্ষা ভাববে! এ যে ভিক্ষা হতে পারে না। ওই বৃদ্ধ আমাকে যে বিরাট সম্পদ দান করেছেন, তা যে কেউ দেখেনি!
বৃদ্ধ টাকাটা নিজের হাতের স্পর্শে অনুভব করলেন। আনুমানিক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে কিছু হয়তো বলতে চাইলেন। মুখটা তাঁর কৃতজ্ঞ এক হাসিতে ভরে উঠল। ভীষণ সহজ, সরল, নির্মল সেই হাসি। একটা হাসিতে যে এত আবেগ থাকতে পারে, এত আশীর্বাদ থাকতে পারে তা আগে জানতে পারিনি এভাবে। তিনি চলেছেন এক কামরা থেকে আরেকটায়। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। কি সুন্দর সূর্য উঠেছে। ঝলমল করছে পুকুরের জল। হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার চুল। প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে হৃদপিণ্ড। আমার আর খিদে পাচ্ছে না। চশমা ছাড়া দূরের ওই গাছগুলো অস্পষ্ট দেখালেও, আকাশটা খুব খুব স্পষ্ট আমার কাছে। আমি তাকিয়ে রইলাম আকাশের দিকে। গন্তব্য এসে গেলে নামতে তো হবেই। যাত্রা টুকু শুভ হোক।