অণু

অণু

অণুর মুখে ভয়ের ছাপ আমি ষ্পষ্ট টের পাচ্ছি৷
অণুর পাশের সিটে তার স্বামী৷ শক্তপোক্ত চেহারা৷মুখে নমনীয়তার ছিটেফোটাও দেখা যাচ্ছে না৷
অণুর কোলের বাচ্চা মেয়েটা চুপটি করে ঘুমোচ্ছে৷ বেশ মিষ্টি চেহারার৷ অণুর মেয়ে নিশ্চই৷ অণুর মেয়ে! আমার বুকটা হাহাকার করে উঠে৷

সেদিন যদি অণু এমনটা না করতো৷ আজ হয়তো আমাদেরই একটা মেয়ে থাকতো৷
অণূ আমাকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে৷ তার চাইতে ভয় পাচ্ছে বেশি৷
অণুর চোখ দূ’টো নীরবে বলে চলেছে, আমার সংসারটা ভেঙো না শ্রাবণ৷

ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড রকমের সংকোচবোধ এ ভুগতাম আমি৷

স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠে গেলেও সেই সংকোচের দেয়াল আর ভাঙা হয়নি আমার৷
স্কুলে যেমন আমার তেমন বন্ধু ছিল না৷ কলেজে উঠেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল৷
যেতাম আর আসতাম৷

অন্যদিকে অণু ছিল দূরন্ত একটা মেয়ে৷ পড়ালেখাতেও ভীষণ পারদর্শী৷
ততদিনে মন জয় করে ফেলেছে সবার৷ স্যার থেকে ছাত্র আর কলেজের বড়ভাই টাইপের ছেলেগুলোরও৷

অন্যদিকে আমি ছিলাম মুখচোরাদের একজন৷ রাত জেগে বইয়ের পড়া গিলে কলেজ যেতাম৷
কিন্তু চুপচাপ আর একগুয়ে হওয়ার কারনে, স্যারদেরও একটু নাক সিটকানো ভাব ছিল৷

 

সবার মতো আমিও মুগ্ধ ছিলাম অণু নামের মেয়েটির প্রতি৷ কোনোদিন মুখ ফুটে বলা হয়নি৷ শুধু মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে চোখ দু’টো দিয়ে এক পলক দেখেছি৷

ইচ্ছে করতো সারাদিন তাকিয়ে থাকি এই মায়াবতী মেয়েটার দিকে৷ কিন্তু সে ইচ্ছে আর পূরণ হয়না৷ সংকোচের দেয়ালটা ভাঙার সাহস পাই না আমি৷

প্রথম বর্ষের ফলাফলের দিন যখন আমার নামটা অণুর পরই ছিল৷ সেদিন সবাই চমকে গিয়েছিল৷
অণূ বরাবরের মতই প্রথম হলো৷ আমি দ্বিতীয়৷ রাহাত স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, অনেক বড় হ তুই৷

সেদিন অণুর প্রথম হওয়ার চাইতে আমার দ্বিতীয় হওয়াটাই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছিল সবার৷
সবার অগোচরে থমথমে মুখ নিয়ে অণুর ক্লাস ত্যাগ করাটা ঠিকই আমার চোখে পড়ে৷
আনন্দের বদলে হালকা ভয় ঝেঁকে বসে আমার ভেতরে৷

তারপরের ক্লাসে অণু যখন আমার বেঞ্চের পাশে এসে বলে,
-চেপে বস৷
আমি কতক্ষণ হা করে তাকিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই৷
অণুর চিমটিতে ভ্রম ভাঙে৷
সেই পাশাপাশি বসেছিলাম৷ তারপরের দিনগুলো কেটেছে একে অপরের পাশে থেকে৷

অণু প্রায়ই বলতো,
আমাকে তুই করে বলবি বুঝেছিস? তুমিতে আমার পোষাবেনা৷
তুমি করে বলতে বলতে একদিন হয়তো প্রেম প্রস্তাব দিয়ে বসবি৷
তোরা ছেলেদের বিশ্বাস নেই বুঝলি৷

রৌদ্রজ্জল এক সকালে থমথমে মুখ নিয়ে আমার হাত ধরে টানতে টানতে মাঠের কোণে নিয়ে যায় অণু৷
“শ্রাবু আমাকে নিয়ে পালাতে পারবি?”
লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে উঠে অণু৷
আমার ভেতরটা খুশিতে নেচে উঠে৷
অণুর কথার প্রতুত্যরে কি বলব আমি ভেবে পাই না৷
আমার মুখ ফুটে কিছু বেরোনোর আগেই অণূ আবার বলে, কিছু জিজ্ঞেস করবি না৷ বাবা পাত্র খুঁজছে৷
তোকে হয়তো বলা হয়নি৷ আমি একজনকে খুব ভালোবাসি৷

অণুর শেষ বাক্যটা আমার ভেতরে গিয়ে লাগে৷ আমার খুশির বেলুনটা হুট করে চুপষে যায়৷
বুকের শূন্যস্থানটাতে খুশির বদলে বিষণ্ণতার অন্ধকারে মিলিয়ে পড়ে৷
উত্তরের অপেক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে অণু৷
আমি সায় দিই৷
অণুর মাঝেই সুখ খুঁজে নিতে চেয়েছিলাম সেদিন৷
অণু হয়তো কোনো এক গৌধূলি বিকেলে তার প্রিয়তম’র কাঁধে মাথা রেখে আমাকে স্মরণ করবে৷
খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, অণু বড্ড ভালোবাসি তোকে৷
কিন্তু শেষে এসে ট্রাজিক হিরো হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না আমার৷

পরেরদিনই অণুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম৷ বাস জার্নির শেষের সময়টুকু আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল অণু৷

সেদিন সংকোচের দেয়াল ভেঙে অণুর অগোচরে তার মায়াবী মুখটা ছুয়ে দিয়েছিলাম৷
পরের টুকু না হয় দীর্ঘশ্বাস হয়েই থাকুক৷
কিন্তু উপরে একজন যিনি আছে৷ সে হয়তো আমাকে দেখে মুচকি হেসেছিল৷

তারপরের সারাটা সকাল কেটেছিল অণুর প্রিয় মানুষের অপেক্ষায়৷
বুক ভরা বেদনা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমি৷ যে বেদনার শেষ পর্বটা হবে, অণুর প্রিয় মানুষের হাতে অণুকে তুলে দেয়া৷

শেষ বিকেলের সূর্যের মতো অণুর প্রিয় মানুষটা আসার অাশাটা যখন দূর আকাশে মিলিয়ে গেল৷
তখন অণুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাই আমি৷
আমাকে অবাক করে অণু মুচকি হাসে৷ আমার নাকটা হালকা টিপে বলে,
হাদারাম একটা৷ এতদিন আমার সাথে থেকেও বুঝলিনা আমায়৷

তুই যে আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস সেটা আমি খুব ভালোই বুঝি৷
তোর কি সেই সাহস আছে?
তাই আমাকেই ব্যবস্থা নিতে হলো৷”

শেষ বিকেলের রক্তরাঙা আকাশের নিচে সব সংকোচ একপাশে সরিয়ে অণুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম শক্ত করে৷
নিয়তির কথা ভেবে মুচকি হাসলাম৷
নিয়তিও হয়তো মুচকি হেসে বলেছিল,
“শেষ হয়নি খোকা”

অণুকে বানানো চায়ে চুমুক দিয়ে যখন নতুন একটা সকালের আশায় স্বপ্ন বুনে ঘুমিয়েছিলাম সেই রাতে৷
রাতের অাঁধার কাটিয়ে সকাল এসেছিল ঠিকই৷ সাথে নিয়ে এসেছিল নিয়তির নির্মমতা৷
অণুর কাষ্ঠমুখো বাবা যখন তার দলবল নিয়ে হাজির হয়েছিল৷ অণুকে আমি শক্ত করে আটকে রেখেছিলাম৷
আমার সাহস দেখে নিজেই অবাক হয়েছিলাম৷
আশায় ছিলাম অণু আর আমার সাহস মিলিয়ে আমার ভালোবাসারই জয় হবে৷
সে আশার মুখে গুড়ে বালি চিটিয়ে যখন অণু যখন তার বাবার হাত ধরে বাড়ির পথ ধরলো!
আমি সেদিন কিছুই বলতে পারিনি৷
হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম৷
আমার হাতে হাতখড়া লাগাতে ব্যস্ত পুলিশটা ফিসফিস করে বলেছিল “নিয়তি বড়ই আজব”

মুখে কারো হাতের পরশ লাগতেই চোখ দু’টো মেলি৷ চমকাইনি একটুও৷ হাত দু’টো আমার বড্ড পরিচিত৷
বাসটা প্রায় খালি ততক্ষণে৷ সবাই নেমে পড়েছে৷ অণুর স্বামীকেও দেখা যাচ্ছেনা৷
আমি গভীরভাবে অণূর দিকে তাকালাম৷
আমার চুলে বিলি কাটে অণূ৷ দু’চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে৷
“অণু! একটা চুমু খাবো তোর কপালে?”
অণু কপাল বাড়িয়ে দেয়৷
চুমু দিতে গিয়েও দিলাম না৷
কিছু ইচ্ছে অপূরণ থাকুক৷ সব মিটে গেলে জীবন হয় না৷

অণুর স্বামীর তাড়া দেয় বাস থেকে নামার জন্য৷ আমি বসেই থাকি আগের জায়গায়৷ বাসের দরজায় গিয়ে শেষবারের মতো আমার দিকে ফিরে তাকায় আমার অণু! না আমার না৷ সে কখনোই আমার ছিল না৷

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত