যারা গল্পটা পাঠ করছেন তাদের জন্য বলে রাখা ভালো, যা লিখছি তা গল্প না বাস্তব, আবার সেরকম বাস্তবও না যা ভালো গল্প হয়ে উঠে। ভালো গল্প খালি ভালো বাস্তব ঘটনার উপরে নির্ভর করে না, নির্ভর করে লেখকের ভাষা দক্ষতা ও নির্মাণ শৈলীর উপর। এই একুশ শতকে এসে আসলে ছোট গল্পের ভুমিকা কতটুকু তাও আলোচনার ব্যাপার। তার ভেতরে আমার মত লেখক যার নাম কেউ শুনে নাই তার লেখা কেন পাঠক পড়বে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তাও গল্পটা লিখি তা গল্প হয়ে উঠবে কিনা জানি না, আগামী দিনের কোনও পাঠক গল্পটা যদি একবারের জন্যেও পড়ে তা হলেও গল্পটা লেখা আজকের জন্য দোষের কিছু হবে না।
শিরোনামেই আপনারা জেনে গিয়েছেন বেঞ্জামিন দুলালের মৃত্যু ঘটেছে। গল্পে তাকে বাঁচানোর কোনও ইচ্ছে আমার নেই। বস্তুত জীবিত অবস্থাতেও একই এলাকায় বসবাস হলেও উনার সাথে আমার বিশেষ আলাপ ছিল না। চোখে চোখে পড়তে পারে, হয়তো একই টুলে বসে চা খেয়েছি, হয়তো কখনো ফ্লেক্সিলোড করতে গিয়ে উনি আমার পেছনেই অপেক্ষায় ছিল খেয়াল করা হয় নি। বেঞ্জামিন দুলালের আকষ্মিক মৃত্যুর খবর আমার যাপিত জীবনে তেমন প্রভাব ফেলে নাই। সকালে হাটতে বের না হলে জানতাম না তার খবর। অনেকদিন পর সকালে হাটতে বের হয়ে ছিলাম। সকালে জগিং এখন এতই অনিয়মিত যে শেষ কবে সকালে বের হয়েছি তা নিজেও জানি না। তাও হাঁটতাম না যদি ঘুম থেকে এত সকালে না উঠতাম। সকালে খালি উঠলেই হবে না, দেখতে হবে তা যথেষ্ট সকাল কিনা, নয়তো এই শহরে বাড়ীওয়ালারা চাবি রেখে দেয় নিজের দখলে। উনাকে বিরক্ত করার কোনও কারন নাই। আর উনি আমাকে সমীহও করেন না, পাঞ্জাবী পড়া অবসস্থায় অফিসে যেতে দেখে তিনি আমাকে হয়তো ইসলামিক এক্সট্রিমিস্টমনাও ভাবতে পারেন। কারো ভাবাভাবিতে আমার কোনো নিয়ন্ত্রন নাই। তার ভেতরে নতুন যে কেয়ারটেকার ছিল সেও জানি কেমন, যার অর্ধেক কথাই আমি বুঝি না। এরকম হয় যখন রিকশাচালক কথা বলে ভীড় রাস্তায় তখন ঠিকঠাক শোনা যায় না কথা। তখন শুধু করতে হয় হুম হুম, না না, জী জী। বের হয়ে আমার চন্দ্রিমা উদ্যানে যেতে ইচ্ছে করলো না। যদিও চন্দ্রিমাতে গেলে ভালো লাগে। সকাল সকাল এত মানুষকে দেখাও আনন্দের। এত ভদ্রমহিলা, এত ভদ্রলোকের সমাবেশে সারাদিনে আর কোথাও হয় না। আমার ভেতর যে স্যুডো নিহালিষ্ট ভাব আছে সেই কারনেই হয়তো যাওয়া হলো না। গেলাম শ্যামলীর দিকে। যাবার পথেই নতুন এক রেস্টুরেন্ট দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ধাক্কা খেলাম বৈরাগী বাবুর সাথে। উনি আর চার পাচ জন নিয়ে হাঁটছেন। আমি ভাবছিলাম উনার যা বয়স তাতে সকালে বের হতেই পারেন। কিন্তু অন্যসব জাজমেন্টের মত আমার এটাও ভুল। উনি বের হয়েছেন কফিন কিনতে ও এম্বুলেন্স ঠিক করতে। কফিন কেনার প্রশ্ন আসলেই স্বাভাবিক মানুষ প্রশ্ন করে কার মৃত্যু হলো, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। জানালেন উনি মারা গিয়েছেন বেঞ্জামিন দুলাল। আমার চেনার সুবিধার্থে জানালেন শম্ভুর ভাই।
শম্ভুকে আমি চিনি। গোপালগঞ্জে বাড়ী। আমার এক পরিচিত মানুষের বন্ধু। একই জায়গায় চা খেতাম। তারপর তিনি উধাও অনেকদিন, কেউ তার খোজ জানে না। খোজ-খবর না জানলেও মানুষকে নিয়ে অনেক অজানা কথা জানা যায়। যেমন আমি জেনেছি শম্ভু এক এক্সিডেন্টে একটা অন্ডকোষ নাই। শম্ভুর কথা ভাবলেই আমার এই কথাটাই মনে পড়ে কেন, তার কারন আমি আজও জানি না। মানুষের ব্যাসিক খাইস্টামি বোধ হয় এইসবই। যাই হোক দুলালের মৃত্যু সংবাদ আমাকে শম্ভু পর্যন্ত ভাবালো। আমাকে স্যামুয়েল জিজ্ঞাসা আগারগাঁও যাবেন কিনা? চলেন। আমি ফেলতে পারলাম না, যেহেতু লাশ নাই সাথে তাই কাজ করাই যায়। গেলাম লেগুনায়। অতো সকালে দোকানপাঠ সব বন্ধ, কিছু কেবল খুলছে। মন খারাপের ভান করতে হলো। গোপনে মোবাইলে ফেসবুকটাও দেখছি। আজ কাল আমার এভারেজ লাইক পাওয়াও কমে গিয়েছি। ব্যাপারটা নিয়ে কেন ভাবছিনা, ভাবা উচিত। শেষে মনকে আশ্বাস দিলাম সময় পেলে ভাববো।
স্যামুয়েল বৈরাগী আমাকে জানাচ্ছিলো হয়তো উনার ধারনা আমার জানা নেই, যে কিভাবে কফিন সহ উনার সম্প্রদায়ের মানুষকে কবরস্থ করা হয়। আমিও শুনছিলাম কারন হতে পারে উনার সাথে যে দু চারজন লোক কাউকেই চিনি না। তারা আমার প্রতি বিরক্ত কিনা তাও জানি না। সেখানে যে কফিন দেখলাম তা খুবই পাতলা, চাপাতা বাধার জন্য র্যাক থাকে কিছুটা সেরকম। চাপাতার শব্দটাও কেন মনে আসলো তাও বিষ্ময়কর, শব্দরা কি তাহলে জেনে যায় আমাদের মনের খবর? স্যামুয়েল সাহেবের পছন্দ হচ্ছে না কফিন। উনি খালি জিগ্যেস করেন, আর কোথায় এইসব পাওয়া যাবে? সাধারণ দোকানদাররা এইসব খবর দিতে চান না, তাও কেউ কেউ উদ্দেশ্যহীন ভাবে আঙ্গুল তুলে বলেন সামনে দেখেন। তার এরকম অদ্ভুত সৌজন্যতার কৃতজ্ঞতা কেউ জানায় না। এদিকে কফিন পাওয়া না গেলেও এম্বুলেন্সের খবর মিলছে। অনেকেই উদগ্রীব, এদের বেশীর ভাগের মুখ থেকেই ব্রাশ না করা মুখের গন্ধ। আমাদের আলোচনা শুনে শুনে এক হুজুর আসলো, আমাদের এক দিকে নিয়ে গেল একটু ভেতরে। জানালেন গাড়ী দেয়া যাবে সাশ্রয়ীমুল্যে, তাদের গাড়ী এখনই প্রস্তুত। দুটো গাড়ী লাগবে, একটি লাশবাহী আরো একটা সাধারণ মাইক্রো। গাড়ী পছন্দ হলো, কিন্তু দামাদামিতে আরো কথা হচ্ছে, এক ফাকে জঘন্য লেবু চা আসলো ভদ্রতার খাতিরে গিলতে হলো। এইসব ফ্লাস্কের চা মানুষ কিভাবে খায়, তা বিষ্ময়! বৈরাগী বলতেছে- দাম কিছু কমান, ওরা যা কমায় বৈরাগীর তা পছন্দ না। এই করে করে আশ্বাস দিয়ে বের হয়ে গেল সবাই। দলের একজন কালো মতন বলছিলেন কাঠ এনে কফিন বানানো যায় না। সবার এই আইডিয়াটাও পছন্দ হলো। মধু নামের এক কাঠমিস্ত্রিকে ফোন দেয়া হলো,সব ছোট কমিউনিটি একটা আলাদা পৃথিবী থাকে, তাদের বোধ হয় সবই থাকে। কিন্তু মধু হতাশ করলো, বললো ছ’মিল থেকে কাঠ কিনে বানাতে সময় লাগবে অনেক। লাশ ততক্ষণ এই গরমে কি করবে? সত্যিই তো লাশের কিছু করার নাই, সে ক্যান্ডিক্রাশ কিংবা ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান মোবাইলে খেলে সময় কাটাতে পারবে না। আমাদের পেছনে যে লোক লেগেই আছে তা আমরা কেউই খেয়াল করি নাই। আরেক হুজুর আমাদের মসজিদের কাছে নিয়ে গেল। বললো ‘কফিন আছে তাদের, তবে দানের। খ্রিষ্টান ধর্মে এই নিয়ে বলা আছে কিনা?’ বৈরাগী তার চুলের বেনী ঠিক করতে করতে বললো দেখান আগে। কফিনটা ময়লা, দেখতে কিছুটা সাদাটে। তবে সুন্দর ও মজবুত, ময়লায় রং হারিয়েছে। হুজুর বারবার জানাচ্ছেন এটা দানের, বিদেশ থেকে আসা। আমরা সবাই প্রিটেন্ড করি- হ্যা বিদেশ থেকে আসা কিন্তু কিভাবে আসা তা ভাবতে চাই না। তবে দামে খুব সস্তা। এত সস্তায় কফিন মিলে যাবে তা জানা ছিল না কারো। তবে বৈরাগী চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে দাম আরো কমাতে চাচ্ছে। এদিকে সবার হয়তো এই সময়টা নাস্তা খাওয়ার, তারা প্রেশার দিচ্ছে জলদি করতে হবে। আমার কোনও তাড়া নেই, আমি তাকিয়ে আছে কফিনের দিকে।
সব ফাইনাল প্রায়। শম্ভুকে মোবাইলে জানানো হয় সব। শম্ভু খুবই শোকগ্রস্থ। কিন্তু তার শোককে নরমালি নিলো না আমার সাথে থাকা কেউই। কারন শম্ভুর নাকি একমাত্র ভরসা ছিল দুলাল সাহেব। দুলাল সাহেব কখনোই বাড়ীর কিছু চাইতো না, উল্টো শম্ভুকে টাকা দিত। আর দুলাল সাহেবের স্ত্রী যেহেতু সরকারি হাসপাতালের নার্স তাই তার অবস্থা শম্ভুর মত খারাপ নয়। আমাদের সবার ভেতরে এই ধারনা ক্রমশোই গ্রাস করলো যে সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে শম্ভু হয়তো ভেঙ্গে পড়েছে। আবার সকলে দল বেধে চা খাবে, সকাল সকাল মৃত্যু উপলক্ষ্যে টি পার্টির এত কি কারন তা বোঝা গেল না। এবার খেলাম দুধ চা, পাতলা লিকারে দুধ চিনি বেশী দেয়া, এই ধরনের চা খেলে বমি আসে, তাও আজ কেন হলো না তা জানা নাই। হতে পারে অবচেতন মনে মৃত্যু নিয়ে আমিও প্যানিকড। একজন প্রশ্ন করলো, ‘কইতেছে দানের, আসলে তো বিদেশ থেকে লাশ আইছিল, কফিন আর ফেরত নেয় নাই মসজিদ থেকে, ইউজড কফিন দেয়া কি ঠিক হবে?’ প্রশ্নটা আমাদের সবাইকে ভাবালো, কেউ কোনও জবাব দিল না, সবাই চায় এই ঝামেলা থেকে মুক্তি। এমনও হতে পারে সেই কবে বিদেশ থেকে কোনও অসুস্থ বা এক্সিডেন্টে নিহত মানুষের লাশ এসেছিল কফিনে, পড়েছিল এমনিতেই, মওকা পেয়ে তা বিক্রি করতে উদগ্রীব এই মসজিদ। ড্রাইভার আসলো, আমাদের নিয়ে গেল দুলালের অস্থায়ী নিবাসের দিকে, সেখান থেকেই পাঠানো হবে গোপালগঞ্জ। আমাকে যেতে বললো, আমি অফিসের কথা বললাম তাই যেতে হবে। কবি কুমার চক্রবর্তীর এক লেখার কথা ভাবছিলাম যেখানে লেখা ছিল, তার থিম হলো এমন– আমরা মনে করি মৃত্যু ব্যাপারটাই অন্যদের, আমাদের নিকট আসবে না সহসাই, তাই অন্যের মৃত্যু আমাদের শোকাহত করলেও জীবন নিয়ে আশাহত করে না। আমি ভাবছিলাম কফিনটার কথা, কফিন বড় অসাম্প্রদায়িক বস্তু, সবাইকে এক চোখে দেখে নিজের ভেতরে আশ্রয় দেয়। এরকম মাতৃস্থানীয় ব্যাপার আর কোন কোন বস্তুতে আছে তা নিয়ে চিন্তা করা যায়। একদিন দুলাল সাহেবের মেয়েকেও দেখতে হবে, মিলিয়ে দেখবো তার বাবার চেহারা কেমন। চেহারা যেটা মাথায় আসছে তা শোয়েব নামে আমার এক বন্ধুর বাবার। একজন বেঁচে থাকা লোককে আমি এইভাবে মনে মনে মেরে ফেলতে পারি না, জীবন যতই ঠুনকো হোক।
এমন দিন গুলোতে বারেকের দোকানে যেতে পারলে অনেক জাজমেন্ট শোনা যায়। কিন্তু ব্যস্ততার কারনে যাওয়া হয় নাই। কেমন কথা শোনা যায় তার অনুমান করতে পারি, যেমন আলি মাঝি নামের এক ব্যাক্তি বলবেন,৩৯ বছর ধরে এই এলাকায়, ওই লোককে কোনোদিন চা খেতে দেখি নাই। খ্রিষ্টান পল বাবু বলবে, জন্মের সুদ খাইতো রে ভাই, আল্লাহ বেহেশত নসীব করুক। স্মৃতিচারণে স্যামুয়েল বৈরাগী বলবে হয়তো কোন এক ইস্টার সানডের গল্প কিংবা কমিউনিটির কোনো অভ্যন্তরীণ গুটবাজীর গল্প। এইজন্য আমার অনেক আগে থেকে ধারণা সামাজিক জীবন না থাকাই ভালো। অন্তত কেউ জানবে না আমার কিছু। আর আরেক সুবিধা হলো বিত্তবানদের, তারা মারা গেলে সবাই বলে কে কিভাবে তাদের দ্বারা উপকৃত হয়েছে সেই কথা জানায়, কে কিভাবে টাকা নষ্ট করেছে তা নিয়ে বলে এমন ভাবে যেন একই বাসায় থাকতো সেই ভদ্রলোক। এইভাবেই মৃত্যু গুলো এসে যায় খুবই সাধারণ মাত্রায় যেন ব্যাপারটা প্রতিদিন ঘটে, খুব সামনেই হয়তো বেঞ্জামিন দুলাল ফিরবে এই শহরে।