দ্যা রিভেঞ্জ

দ্যা রিভেঞ্জ

হোস্টেলে ঢুকেই দেখলাম বুয়া রুম ঝাড়ু দিচ্ছে।বুয়াকে খালা বলে ডাকি ভালবাসার খাতিরে।সোহান,তাহসিন,সিনহা কেউই নেই রুমে।তারা এখনো আসেনি।আমি চলে এসেছি।

সপ্তাহে দুদিন ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য বিকেল পর্যন্ত মতিঝিল থেকে যেতে হয়।এই দুদিন তাই দুপুরে থিউরি ক্লাস শেষ করে আর বাসায় ফিরিনা।সোহানদের হোস্টেলে গিয়ে গল্প গুজব করি চারজন মিলে।আমার দুপুরের খাবারের মিলটা আগেরদিনই সোহান দিয়ে দেয়।দু এক ঘণ্টা হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়ে ভালোই কেটে যায়।

আজ তারা এখনো আসেনি।অবশ্য আমি যেদিন আসি,প্রায়ই আমি আগে চলে আসি।রুমের চাবি খালার কাছেও একটা রাখা থাকে।সেই সুবাদেই রুমে ঢুকতে পারি বাকিদের অনুপস্থিতিতেও।

খালার সাথে আমার ভাব মোটামুটি ভালোই।এটার কারণও আছে যথেষ্ঠ।প্রথম প্রথম রুমে এসেই তাকে জিজ্ঞেস করতাম নানান কথা।কখনো খালা কেমন আছো,কখনো তোমার ছেলে কেমন আছে,কখনো ভাত খাওয়া হয়েছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।খালা অতি দরিদ্র।তবে সৎ।বিশ্বস্ত।মুখে তার সবসময় ক্লান্তির ছাপ।তবুও কর্ম করে খায়,চুরি করে না।মাঝেমাঝে তার মুখ থেকে শুনতে পাই তার পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থার কথা।তখন খুব মায়া হয়।বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষগুলোর উপর আমার স্বভাবগতভাবেই ভালবাসা একটু বেশি।দু তিন বার খালার মুখে তার দরিদ্রতায় গ্রাস করা সংসারের টান টান,যায় যায় অবস্থার কথা শুনে তাকে পঞ্চাশ,একশ টাকা দিয়েছিও।নিতে চায়নি,তবুও দিয়েছে জোর করে।যাইহোক,এভাবেই সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খালার সাথে আমার পরিচয়-কথাবার্তা মোটামুটি ভালই হয়ে ওঠে।

আজকে রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলাম,”খালা কেমন আছ?”খালা আমায় দেখে একটু খুশি হলেন মনে হলো।হাসি মুখে জবাব দিল,”এইতো বাবা,আল্লাহই রাখছে।তুমি?” “এইতো চলছে একরকম।বাসায় তোমার ছেলে কেমন আছে?” “আছে মাশাল্লাহ,ভালো।জানো বাবা,মানুষের কাম সঠিকভাবে করলেও মানুষ শান্তি দেয়না।সারাদিন বকাঝকা করে,গায়েও হাত তুলবার চায় কেউ কেউ।” আমি কিঞ্চিৎ অবাক হলাম।ব্যস্ত গলায় বললাম,”কী হয়েছে খালা?” খালা আবার বলতে শুরু করল,”সারাদিন বকাঝকা করলে ভালা লাগে?কারণে অকারণে বকে।একবারের কাম তিনবার করায়।তারপরেও বলে হয় নাই,আবার কর।কিন্তু আল্লাহ তো আমাগোরে কিছু বলার অধিকার দেয় নাই।শুধু শুনবার লাগি কান দিয়াছে।পেটের দায়।কামটা ছাড়তেও পারিনা আর ভালা মনে করতেও পারিনা।তারপরেও রাগ হয়।তাই গত কয়দিন ধইরা একখান মজার কাম কইরা আসতেছি নিজের রাগ কমানের লাইগা।”

খালার কথা পরিষ্কার বুঝতে না পেরে বললাম,”কী হয়েছে খালা।খুলে বলো তো!” “জানো বাবা,আমি এক বাসায় কাম করি।সারাক্ষণ খালি বকে।বেডিও বকে।ব্যাডাও বকে।তাগো পোলা মাইয়াও খারাপ ব্যবহার করে আমার লগে।কিছু হারাইলে আমারে চোর কইয়াও দুই একবার গালি দেয় মাঝেমাঝে।তোমরা তো আমারে চিনো,আমি কি খারাপ বাবা?কথা শুনাইলে খারাপ লাগে না?কও তো!আমি তো তাও কামটা ছাড়বার পারিনা।কারণ আমি গরিব।আল্লাহই আমারে গরিব বানাইছে।কাম কইরা আর এইসব শুইনাই আমারে চলতে হইবো।কিন্তু আমার কী সম্মান নাই?আমার লাগে না?আমি বুঝি প্রতিবাদ করবার পারি না?আমিও পারি।তাই গত কদিন ধইরা দিতেছে একদম।”

আমি তো অবাক!খালার বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে ভাবলাম,হাই হাই!কাকে আবার কী করে বসল খালা!উত্তেজিত হয়ে বললাম,”কী দিতেছো খালা?” খালা একটু হাসি দিয়ে বলল,”আমি একটা বুদ্ধি করিছি মাথায়।কী জানো?তারা যখন আমারে বকে,যখন কথা শুইনা শুইনা আমার কান জ্বইলা যায়,যখন রাগ উঠে,তখন কী করি শুইনবা?”

বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললাম,”কী করো?”

“তখন ঐ যে বাথরুম আছে না?বাথরুম পরিষ্কার করবার লাইগা যখন ব্রাশ দিয়া কমোড ডলা দিই,তখন ভিতরের তাক থেইকা তাগো দাঁত মাজনের ব্রাশ লইয়া,সেইটাও কয়েকবার কমোডে ঘষা দিয়া দিই।তার মনে মনে কই,তোরা আমারে মুখে কছ।কিন্তু আমি কইবার পারিনা।তাতে কী!তোরা যেই মুখে আমারে গালি দিবি,সেই মুখে ধর, আমি ঘু খাওয়াইয়া দিলাম।”

আমি তো হতবাক!খালার মতো এত সোজা সরল মানুষ এসব কী বলছে?দিলাম হো হো করে জোরে হেসে।কৌতুহল নিয়ে বললাম,”কী খালা!সত্যিই?” খালাও দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল,”হ বাবা,সত্যই।এরপর থেইকা আমারে যত বেশি গালি দেয়,আমি তাগো দাঁতের ব্রাশ তত বেশি কমোডে ডলা দিই।আর মনে মনে খুশিতে কই,আমারে যত বেশি গালি দিবি,তোগোরে তত বেশি ঘু খাবামু।আইজ তোগোরে খাবাইছি,আস্তে আস্তে তোগো চৌদ্দগোষ্টিরে খাবামু।”

আমি তো থ!খালা এইটা কী বলল!এটা তো ফাস্টক্লাস একটা বুদ্ধি।বাহ!কিন্তু তবুও বিশ্বাস করতে পারিনি।খালার মতো মানুষ এইকাজ জীবনেও করতে পারে কিনা ভাবছি।হয়ত আমাকে একটু হাসানোর জন্য এসব বলেছে।সে যাই হোক,খালা করুক আর না করুক,আমি যে বেশ মারাত্মক রকমের মজা পেয়েছি আর অবাক হয়েছি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।আর এইরকম প্রতিবাদ আমাদের সমাজের তথাকথিত বড়লোক মাটির মানুষদের জন্য আসলেই দরকার,হাহাহা।

সেদিন আর বেশি ভাত খেতে পারিনি।মাথায় সারাক্ষণ খালার কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিলো আর হাসছিলাম।কী বুদ্ধি হ্যাঁ!একদম ঘু খাইয়ে ছেড়ে দিল।কী জানি,আসলেই সত্যি নাকি আসলেই মজা করেছে!তবে বুদ্ধিটা চরম।

বিষয়টা নিয়ে অনেক মজা করলাম।হাসি ঠাট্টা করলাম সোহান,তাহসিনদের সাথেও।সেদিন ব্যবহারিক ক্লাস শেষ করে যখন বাসায় যাচ্ছিলাম তখন সারাপথ হেসেছি,আর অপেক্ষায় ছিলাম কখন বাসায় গিয়ে আম্মুদের সবাইকে ঘটনটা বলে নীতিবাক্য প্রদান করব যে,”অস্ত্র সকলেরই আছে,শুধু ব্যবহার জানতে হয়।”হাহাহা।

বাসায় গিয়েই দেখলাম মেইন দরজা খোলা।তাই কলিংবেল বাজানোর দরকার পড়ল না।সোজা ভেতরে ঢুকে পড়লাম।অবাক কাণ্ড!ব্যাপারটা কী?কতটা কাকতালীয় বিষয়টা!ঢুকেই ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি আমাদের বাথরুমের দরজা খোলা।বাসার বুয়া বাথরুম পরিষ্কার করছে,আর আম্মু তাকে নির্দেশনা দিচ্ছে কীভাবে ভালো করে পরিষ্কার করতে হয়।তার আমার ছোট ভাইটা?সে কী করছে জানো?সে মুখে ব্রাশ নিয়ে সারা ঘরে ঘরে দৌড়াচ্ছে।এটা কীভাবে সম্ভব!আমি যেন থম দিয়ে গেলাম।হাসব নাকি কাঁদব বুঝে উঠতে পারছি না।যদিও আমার আম্মুর সাথে বুয়াদের,বিশেষ করে দরিদ্রদের সম্পর্ক চির অমায়িক,চির ভালবাসার,তবুও আজকের ঘটনাটা শোনার পর আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি হাসতে হাসতে।

নিজের মনের হাসিটা হঠাৎই থামিয়ে ঠাস করে আমার চার বছরের ভাইটার নিরপরাধ গালে জোরে এক চড় বসিয়ে ধমক দিয়ে বললাম,”এটা ব্রাশ করার সময়???কোন টাইমে ব্রাশ করছিস?আর আম্মু!তুমি শোন,খালাকে এত নির্দেশনা দিতে হবেনা,খালার যেইভাবে ভালো লাগে খালা সেইভাবে কাজ করুক।তাতেই চলবে।

 

——সমাপ্ত——

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত